X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

সিরিয়া আক্রমণে তুরস্কের হুমকির নেপথ্যে

বিদেশ ডেস্ক
০৩ জুন ২০২২, ১৮:০৫আপডেট : ০৩ জুন ২০২২, ২৩:৪১

সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় বাসিন্দারা একটি নতুন লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বিশ্বের মনোযোগ যখন ইউক্রেনের যুদ্ধে, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান ঘোষনা দিয়েছেন, সিরীয় কুর্দি যোদ্ধাদের পিছু হটিয়ে দিতে তিনি সিরিয়া একটি সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করছেন। তার এই অভিযানের লক্ষ্য, সীমান্ত এলাকায় একটি ‘বাফার জোন’ প্রতিষ্ঠা করা। এরদোয়ান দীর্ঘদিন ধরে এই লক্ষ্য লালন করছেন।

উত্তেজনা চরমে। যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সিরীয় কুর্দি যোদ্ধা এবং তুর্কি বাহিনী ও তুর্কি সমর্থিত সিরীয় বিদ্রোহী বন্দুকধারীদের মধ্যে প্রতিদিন গুলি বিনিময় হচ্ছে, একদিনও বাদ যাচ্ছে না।

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রতিবেশী সিরিয়ায় নিজের লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য এরদোয়ান ইউক্রেন যুদ্ধের সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছেন। এমনকি ন্যাটো সদস্য হিসেবে জোটে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনকে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে ভেটো ক্ষমতাকেও ব্যবহার করছেন নিজের স্বার্থে।

তারা বলছেন, সিরিয়ায় তুরস্কের বড় ধরনের সামরিক অভিযানে ঝুঁকি ও জটিলতা রয়েছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া, উভয়ের সঙ্গ আঙ্কারার সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। এমন অভিযানে যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলটিতে নতুন করে মানুষের ঘরবাড়ি হারানোর ঢেউ শুরু হতে পারে। অঞ্চলটিতে এখনও ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর মতো জঙ্গিরা লুকিয়ে আছে।

সিরিয়ায় তুর্কি ট্যাংক ও সেনারা

তুরস্কের উচ্চাকাঙ্ক্ষা

সিরিয়ায় অভিযান শুরুর পরিকল্পনার গত মাসে জানিয়েছেন এরদোয়ান। এই সামরিক পরিকল্পনার লক্ষ্য তুর্কি সীমান্তের সিরিয়ার অভ্যন্তরে ৩০ কিলোমিটার বাফার জোন তৈরি করা। ২০১৯ সালে এই জোন তৈরি করতে চেয়েছিলেন এরদোয়ান। কিন্তু ওই সময় সামরিক অভিযানে এই লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয় তুর্কি বাহিনী।

অভিযান শুরুর নির্দিষ্ট তারিখ না জানিয়ে এরদোয়ান বলেছেন, কোনও এক রাতে হুট করে আমরা তাদের ওপর আক্রমণ করব। এবং আমাদের তা অবশ্যই করা উচিত।

২০১৬ সাল থেকে সিরিয়ার অভ্যন্তরে তিনটি বড় ধরনের অভিযান চালিয়েছে তুরস্ক। সিরিয়ার প্রধান কুর্দি মিলিশিয়া, পিপল’স প্রটেকশন ইউনিটস বা ওয়াইপিজি– যে গোষ্ঠীকে তুরস্ক একটি সন্ত্রাসী সংগঠন এবং নিষিদ্ধঘোষিত কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি বা পিকেকে’র শাখা বলে মনে করে। কয়েক দশক ধরে পিকেকে তুরস্কের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করে আসছে।

কিন্তু সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর মেরুদণ্ড হলো এই ওয়াইপিজি। সিরিয়ায় তারা যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষিত মিত্র।

তুরস্ক সমর্থিত সিরীয় বিদ্রোহী

অতীতের তিনটি সামরিক অভিযানে সিরিয়ার বেশ কিছু ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তুরস্ক। এর মধ্যে রয়েছে আফরিন, তেল আবিয়াদ ও জারাব্লুস। ওই এলাকায় কয়েক হাজার বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে আঙ্কারার। এর মাধ্যমে তুরস্কে অবস্থানরত ৩.৭ মিলিয়ন শরণার্থীর মধ্যে ১ মিলিয়ন স্বেচ্ছায় এসব এলাকায় ফিরে আসবেন।

বুধবার এরদোয়ান বলেছেন, তুরস্কের সেনাবাহিনীর লক্ষ্য হলো নতুন এলাকা দখল করা। এরমধ্যে থাকবে তেল রিফাত ও মানবিজ।

তুরস্ক বলছে, সিরীয় কুর্দি যোদ্ধারা তেল রিফাতকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে তুর্কি সমর্থিত সিরীয় বিদ্রোহীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে।

এছাড়া ধারণা করা হচ্ছে, তুর্কি সেনারা কৌশলগত সীমান্ত শহর কোবানিতে প্রবেশ করতে পারে। এখানে ২০১৫ সালে মার্কিন সেনাবাহিনী ও কুর্দি যোদ্ধারা সম্মিলিতভাবে ইসলামিক স্টেটকে পরাজিত করে। এই শহরটি সিরীয় কুর্দিদের শক্তি ও সিরিয়ার এই ভূখণ্ডে নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতীক।

 

কেন এখন?

বিশ্লেষকরা বলছেন, এরদোয়ান সম্ভবত আন্তর্জাতিক ও দেশীয় পরিস্থিতির বিচারে সিরিয়ার অভিযানকে উপযুক্ত সময়ের বলে মনে করছেন। ইউক্রেনে যুদ্ধে লিপ্ত রাশিয়া এবং ন্যাটোতে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনকে অন্তর্ভুক্ত করতে তুরস্কে আপত্তি প্রত্যাহার প্রয়োজন যুক্তরাষ্ট্রের।

ফিলাডেলিপিয়া’র ফরেন পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের প্রধান গবেষক অ্যারন স্টেইন বলেন, পশ্চিমাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের একটি সুযোগ লাভের অনুভূতি তুর্কিদের মধ্যে রয়েছে।

তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান

সিরিয়ায় আক্রমণকে তুরস্কের জাতীয়তাবাদী ভোটারদের ক্ষমতাসীনদের পক্ষে টেনে আনার কাজেও ব্যবহার করা যাবে। যখন দেশটির অর্থনীতি নিম্নগামী এবং মূল্যস্ফীতি ৭৩.৫ শতাংশ। তুরস্কে আগামী বছর প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্টের নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। সিরিয়ায় আগের অভিযানগুলো ভোটে এরদোয়ানের সমর্থন বাড়িয়েছে।

এখন পর্যন্ত, কোনও সামরিক সমাবেশের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, যাতে আক্রমণ আসন্ন বলে মনে হতে পারে। যদিও তুর্কি সেনাবাহিনী দ্রুততার সঙ্গে আক্রমণে যেতে পারবে। সিরীয় কুর্দি যোদ্ধারা বলেছে, তারা তুরস্কের সর্বশেষ হুমকিকে গুরুত্ব দিচ্ছে এবং সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে।

কুর্দিরা সতর্ক করে বলেছে, আক্রমণের ফলে ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে তাদের চলমান লড়াই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, উত্তর সিরিয়ার কারাগার সুরক্ষিত করার সামর্থ্য সীমিত হবে। এখানে কয়েক হাজার জঙ্গি বন্দি রয়েছে, বেশিরভাগ বিদেশি নাগরিক। তিন বছর আগে ইসলামিক স্টেটকে পরাজিত করার পর থেকে এই জঙ্গিরা এখানে বন্দি অবস্থায় রয়েছে।

 

যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক

বড় ধরনের সামরিক অভিযান পরিচালনার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে এবং তা যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া উভয়কেই ক্ষুব্ধ করতে পারে। দেশ দুটিরই উত্তর সিরিয়ায় সামরিক উপস্থিতি রয়েছে।

সিরিয়ার ১১ বছরের সংঘাতে তুরস্ক ও রাশিয়া প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষকে সমর্থন দিয়েছে কিন্তু উত্তরাঞ্চলে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় রেখেছে। সম্প্রতি অঞ্চলটির তুর্কি সীমান্তবর্তী একটি ঘাঁটিতে যুদ্ধবিমান, হেলিকপ্টার গানশিপ পাঠিয়েছে রাশিয়া।

দামেস্ক-এর ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে সিরিয়ায় রাশিয়ার হস্তক্ষেপ যুদ্ধের গতি প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পক্ষে নিয়ে আসতে বড় ভূমিকা রেখেছে। ২০১১ সালে আরব বসন্তের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধের শুরু। সিরিয়ার বিরোধী যোদ্ধারা উত্তর-পশ্চিমে সরে যায় এবং তুরস্কের ছায়ায় আশ্রয় নেয়।

সিরিয়ার মানবিজে মোতায়েনকৃত তুর্কি সেনা

কিন্তু মস্কো এখন ইউক্রেন যুদ্ধে মনোযোগী হওয়ার কারণে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সিরিয়ায় এরদোয়ানের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা কম। বিশেষ করে তুরস্কের দক্ষিণ সীমান্তবর্তী এক টুকরো ভূখণ্ডের জন্য।

তবে বৃহস্পতিবার সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় এলাকায় অভিযান পরিচালনা না করতে তুরস্কের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে রাশিয়া।  রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেন, ‘আমরা আশা করি, আঙ্কারা এমন পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকবে যা সিরিয়ার বিদ্যমান কঠিন পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক অবনতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।’

মারিয়া জাখারোভা বলেন, সিরিয়ার বৈধ সরকারের অনুমতি ছাড়া এই ধরনের পদক্ষেপ হবে দেশটির সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার সরাসরি লঙ্ঘন। এটি সিরিয়ায় উত্তেজনা আরও বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। 

তুর্কি সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে ওয়াশিংটন। তারা বলেছে, এতে ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে অর্জিত জয় ঝুঁকিতে পড়বে।  

মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নেড প্রাইস বলেছেন, সীমান্তে তুরস্কের বৈধ উদ্বেগকে আমরা স্বীকার করি। কিন্তু আমরা যে কোনও নতুন আক্রমণ নিয়ে উদ্বিগ্ন, কারণ এতে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হবে।

বিশ্লেষক স্টেইন মনে করেন, সম্ভাব্য দুটি হটস্পট, কোবানি ও তেল রিফাতে রাশিয়ার উপস্থিতির কারণে তুরস্কের যে কোনও অভিযান জটিলতার মুখে পড়তে পারে।

কোনও অভিযান হবে কিনা তা নির্ভর করছে এরদোয়ান সিরিয়ায়, বিশেষ করে কোবানি এলাকায় কতদূর যেতে চান এবং ওয়াশিংটন ও মস্কোর সঙ্গে বিরোধে জড়াতে প্রস্তুত কিনা– এই দুটি প্রশ্নের ওপর।

স্টেইন বলেন, এরদোয়ান কতটা ঝুঁকি নিতে চান? আমাদের কাছে যে প্রমাণ আছে তাতে দেখা গেছে তিনি অনেক ঝুঁকি নেন।

এপি অবলম্বনে।

/এএ/
সম্পর্কিত
গাজায় আবিষ্কৃত গণকবরের স্বচ্ছ তদন্ত দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিমার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে ভিত্তিহীন তথ্য রয়েছে
ভারতের একটি হোটেলে অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৬
সর্বশেষ খবর
ওমরা পালনে সৌদি গেলেন পাটমন্ত্রী
ওমরা পালনে সৌদি গেলেন পাটমন্ত্রী
গাজায় আবিষ্কৃত গণকবরের স্বচ্ছ তদন্ত দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র
গাজায় আবিষ্কৃত গণকবরের স্বচ্ছ তদন্ত দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্র
খুলনায় এ যাবতকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এ যাবতকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে ভিত্তিহীন তথ্য রয়েছে
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিমার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে ভিত্তিহীন তথ্য রয়েছে
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা