পশ্চিমবঙ্গ ভেঙে উত্তরবঙ্গ, রাড়বঙ্গের পর এবার দাবি উঠল বঙ্গভূমি রাজ্যর। মতুয়া অধ্যুষিত হরিণঘাটার বিজেপি বিধায়ক লোককবি অসীম সরকার পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থী-উদ্বাস্তুদের জন্য আলাদা বঙ্গভূমি রাজ্যর দাবি তুললেন। শুধু তাই নয়, রানাঘাটের বিজেপি সাংসদ জগন্নাথ সরকারকে মুখ্যমন্ত্রী করে পৃথক নদিয়া রাজ্যরও দাবি উঠেছে! পশ্চিমবঙ্গ ভেঙে একের পর এক রাজ্য ভাগের দাবি নিয়ে সরব হওয়া গেরুয়া শিবিরের সাংসদ, বিধায়কদের নিয়ে যথেষ্ট ব্যাকফুটে বঙ্গ বিজেপি।
গত সোমবার নিজের ফেসবুক পেজে পোস্ট করে বঙ্গভূমি রাজ্যের জন্য সমর্থন আদায়ে প্রচার শুরু করেছেন উদ্বাস্তু আন্দোলনের নেতা বলে পরিচিত বিজেপি বিধায়ক অসীম সরকার। তিনি তার পোস্টে লিখেছেন, ‘উত্তরবঙ্গ এবং জঙ্গলমহল যদি আলাদা রাজ্য দাবি করতে পারে, তাহলে নদিয়া দক্ষিণ এবং বনগাঁ লোকসভার ১২টি বিধানসভা নিয়ে উদ্বাস্তুদের জন্য আমি বঙ্গভূমি রাজ্য দাবি করছি।’
এই পোস্ট ঘিরে নানা আপত্তি উঠলে অসীম সরকার পালটা বলেছেন, ‘মূল কথাটা সবাই বোঝার চেষ্টা করলে ভালো হয়। এই সব দাবি ওঠার মূল কারণটা কোথায়? মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পশ্চিমবঙ্গকে সামগ্রিকভাবে সাজিয়ে তোলার যে উদ্দেশ্য ও মানসিকতা তাকে আমি স্যালুট জানাই। কিন্তু তৃণমূল পার্টি এবার ভোটে বিপুল আসন পেয়ে জয়লাভ করার পরে তাদের কিছু হারমাদ বহিনী সারা পশ্চিমবঙ্গজুড়ে বিরোধীদের প্রতি তথা বিজেপিকে সমর্থন করার অপরাধে সাধারণ মানুষের ওপরে যে অমানবিক, পাশবিক, নজিরবিহীন অত্যাচার করে চলেছে, তাতে মুখ পুড়ছে কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের এবং পুলিশ প্রসাশনের। এখানেই দুঃখ। যে রাজ্যে বসবাস করে জনগণ সংবিধানের মৌলিক অধিকার প্রয়োগ করতে গেলে মা-বোনদের ইজ্জত যাচ্ছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, খুন হতে হচ্ছে, বাড়ি থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে, জনগণের স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার হতে তাদের বঞ্চিত হচ্ছে। বিজেপিকে ভোট দেওয়ার অপরাধে সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে। প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানাতে গেলে উল্টো মিথ্যা কেসে ফাঁসিয়ে দিয়ে জেলে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। রাজা যতোই ভালো হোক, তার পারিষদ বর্গ যদি এই ধরনের আচরণে লিপ্ত হয়, তাহলে আর সেই রাজার রাজ্যে বসবাস করে কী লাভ?’
এরপরেই অসীম সরকার বঙ্গভূমি রাজ্য দাবিকে সমর্থন করার জন্য আবেদন জানিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের যদি কোনও সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারই না থাকে তাহলে আমরা কেন সেখানে থাকবো? আমরাও উদ্বাস্তুদের জন্য আলাদা রাজ্যের দাবি রাখছি। হাজার হাজার শেয়ার করুন। আপনাদের মতামত জানালে খুশি হব। আমি সমগ্র উদ্বাস্তুদের মুক্তির জন্যই আন্দোলনটা করেছি এবং সেই অনুযায়ী দাবিটাও রেখেছি।’
পশ্চিমবঙ্গের অন্য জেলায় ছড়িয়ে থাকা উদ্বাস্তদের এই রাজ্যে নিয়ে আসা হবে জনবিনিময়ের মধ্য এমন মতও তিনি পোস্টে প্রকাশ করেছেন। এদিকে, ওয়েস্ট বেঙ্গল বিজেপি সাপোর্টার নামক একটি পেজ থেকে আবার মঙ্গলবার পৃথক নদিয়া রাজ্যর দাবিতে পোস্ট করা হয়েছে। এই পোস্টে লেখা হয়েছে, ‘আমাদের দাবি পৃথক নদিয়া রাজ্য। মুখ্যমন্ত্রী হবেন জগন্নাথ সরকার।’
উল্লেখ্য, বঙ্গভূমি নামটা নতুন নয়। বাংলাদেশের ছয়টি জেলা খুলনা, যশোর, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, বরিশাল এবং পটুয়াখালী। এই ছয়টি জেলা নিয়েই ২৫ মার্চ ১৯৮২ ঘোষিত হয়েছিল তথাকথিত ‘স্বাধীন বঙ্গভূমি’ রাষ্ট্র। এই বঙ্গভূমি আন্দোলনের সংগঠক ছিল দেশভাগ ও পরবর্তীতে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসা উদ্বাস্তুদের সংগঠন নিখিল বঙ্গ নাগরিক সংঘ। ১৯৮৮ সালে ২৩ নভেম্বর ‘বঙ্গভূমি’ দখলের জন্য বনগাঁ সীমান্ত অভিযান করেন তারা। কিন্তু কালের প্রভাবে এই আন্দোলন একটা সময় হারিয়ে যায়।
উদ্বাস্তু আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অসীম সরকারের এই দাবিকে উড়িয়ে দিয়েছেন বঙ্গ বিজেপির উদ্বাস্তু সেলের আহ্বায়ক অধ্যাপক মোহিত রায়। তিনি বলেন,‘পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অংশের আলাদা রাজ্যের দাবি আদৌও সমর্থন যোগ্য নয়। বিভিন্ন অংশে উন্নয়নের অভাবে এসব কথা হতাশা থেকে উঠে এসেছে মাত্র। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিয়েছে, এজন্য উদ্বাস্তুদের সব প্রজন্মের চিরকৃতজ্ঞ থাকা উচিত। তাদের এখানে না পোষালে মুরোদ থাকলে বাংলাদেশে নিজেদের ফেলে আসা জমিতে গিয়ে বঙ্গভূমি বানান।’
এদিকে আলাদা রাজ্যর দাবিতে নিজের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ রানাঘাটের বিজেপি সাংসদ জগন্নাথ সরকার। তিনি বিজেপি বিধায়ক অসীমস সরকারকে কটাক্ষ করে বলেন, ‘বঙ্গভূমি চাইতে গেলে বাংলাদেশে গিয়ে আন্দোলন করুন। বিজেপি জাতপাতভিত্তিক রাজ্যভাগের বিরুদ্ধে। যারা বিজেপির আর্দশ জানে না, বোঝে না তারাই এসব দাবি তুলতে পারে। আর আমরা নাম করে যে প্রচার শুরু হয়েছে সেটা তৃণমূলের ষড়যন্ত্র। আমাকে বদনাম করার জন্য এসব পোস্ট করা হয়েছে।’
নিখিল ভারত বাঙালি সমন্বয় সমিতির সর্বভারতীয় সভাপতি সুবোধ বিশ্বাস বলেন, ‘বাংলা ভাগে আমরা সর্বস্ব হারিয়েছি। পশ্চিমবঙ্গ ভাগের তীব্র প্রতিবাদ করি। এধরণের উগ্র আঞ্চলিকতাবাদ বাঙালি জাতিসত্বাকে বিপন্ন করবে। দ্রুত বিচ্ছিন্নতাবাদের প্রতিবাদে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। যেসব নেতারা শ্যামাপ্রসাদকে আদর্শ হিসেবে মানেন,তারাই শ্যামাপ্রসাদের পশ্চিমবঙ্গকে ভাগ করতে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করছেন, একটা নিতান্ত দুঃখের এবং লজ্জার। বিভাজন নয়, দাবি হোক বৃহত্তর বঙ্গের।’
অল ইন্ডিয়া মতুয়া মহাসংঘের সাধারণ সম্পাদক মহিতোষ বৈদ্য বলেন, ‘এই দাবির সঙ্গে আমরা মতুয়ারা একমত নই। অসীমবাবু আমাদের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও, এটা তার নিজস্ব বক্তব্য। দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গ গঠনে শ্যামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে একত্রে কাজ করেছিলেন আমাদের সংঘের প্রতিষ্টা প্রথমরঞ্জন ঠাকুর। তার নেতৃত্বেই ওপার থেকে আসা মতুয়ারা প্রথম সংঘঠিত হয়। আমরা কোনও মতেই বাংলা ভাগ চাই না। আমাদের একটাই দাবি নাগরিকত্বের অধিকার।’
আমরা বাঙালি অসম শাখা সচিব সাধন পুরকায়স্থ বলেন, ‘আমরা পশ্চিমবঙ্গ ভাগের বিপক্ষে। আমরা ১৯৪৬ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের যে সীমানা ছিল তার ভিত্তিতে যুক্তবঙ্গের পক্ষে। তার মধ্যে অসমের অবিভক্ত গোয়ালপাড়া, কাছাড় জেলা, নেপালের ঝাঁপা জেলা, আন্দামান, মনিপুরের জিরিবাম, ঝাড়খণ্ড,ওড়িশা এবং বিহারের বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে বাঙালিস্থান রাজ্যের পক্ষে। এধরণের দাবি কোনও মতেই আমরা মানব না।’