ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান কঠোর না হওয়ার জবাব দিতে নিজেদের যুদ্ধবিরোধী অবস্থান জোরদার করেছে ভারত। কিন্তু একই সঙ্গে ইউক্রেনে আক্রমণের জন্য রাশিয়াকে দায়ী করা থেকে বিরত থেকেছে নয়া দিল্লি। ইঙ্গিত দিয়েছে, রাশিয়ার কাছ থেকে সস্তায় তেল ও কয়লা কেনার যে নীতি নিয়েছে তারা তা থেকে বিচ্যুত হবে না। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এখবর জানিয়েছে।
এই মাসের শুরুতে ইউক্রেনে রুশ আক্রমণের পর প্রথম মুখোমুখি বৈঠকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, আজকের যুগ কোনও যুদ্ধের যুগ নয়। ইউক্রেন সংঘাতে এটিই ভারতের সবচেয়ে স্পষ্ট অবস্থান।
গত সপ্তাহে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ইউক্রেন যুদ্ধকে ‘গুরুতর উদ্বেগের’ এবং পারমাণবিক উত্তেজনা বৃদ্ধিকে ‘বিশেষ উদ্বেগের’ বলে অভিহিত করেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের অবস্থানের বদল সূক্ষ্ণ হলেও যুদ্ধের কারণে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ক্ষতি ও ভারতে এর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগের প্রকাশ পেয়েছে।
সম্প্রতি রাশিয়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবার সেনা সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে। এতে করে সংঘাতটি নতুন মাত্রা পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমন সময় যুদ্ধের উত্তেজনা আরও বাড়ছেযখন বিশ্ব বাজারে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে এবং বৈশ্বিক মন্দার ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।
এছাড়া ভারতের উদ্বেগের আরেকটি কারণ হলো, তারা মনে করছে যুদ্ধের ফলে রাশিয়া আরও বেশি চীনের প্রতি ঝুঁকছে। চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খুব মসৃণ নয়। নতুন অবস্থানের মাধ্যমে ভারত আশা করছে পশ্চিমা মিত্ররা তাদের মস্কো ঘেঁষা বলে যে সমালোচনা করে আসছিল সেটি থেকে আপাতত মুক্তি পাওয়াযাবে।
ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও রাশিয়ায় নিযুক্ত দেশটির সাবেক রাষ্ট্রদূত পি.এস. রাঘবন বলছেন, ইউক্রেনে শত্রুতার অবসান সব সময় চেয়েছে ভারত। কিন্তু এখন প্রকাশ্যে স্পষ্ট অবস্থান নিচ্ছে।
রয়টার্সকে তিনি বলেন, রাশিয়াকে চীন ও ভারতের সমর্থনের বিষয়ে যে অবস্থান রয়েছে, এটি তার পাল্টা জবাব। আমাদের অবস্থান খুব ভিন্ন। এটি চোখ বন্ধ করে রাশিয়াকে সমর্থন করা নয়। রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের নির্দিষ্ট সহযোগিতার ধারা রয়েছে, যা আমরা অব্যাহত রেখেছি। প্রতিরক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, পেট্রোলজাত পণ্যও গুরুত্বপূর্ণ। সারের আমদানি বেড়েছে। মূলকথা হলো, আমরা যদি সস্তায় জ্বালানি পাই তাহলে আমরা তা কিনব।
কয়েক দশক ধরেই ভারত ও রাশিয়ার সম্পর্ক গভীর। ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ভারত অস্ত্র আমদানি করেছে ১২.৪ বিলিয়ন ডলারের। এর মধ্যে রাশিয়া থেকে আমদানি করা হয়েছে ৫.৫১ ডলার মূল্যের অস্ত্র।
এক সময় রাশিয়ার কাছ থেকে খুব বেশি তেল আমদানি করত না ভারত। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম তেল সরবরাহকারী দেশ হয়ে ওঠেছে রাশিয়া। এক বছর আগের তুলনায় ভারতের রুশ তেল আমদানি বেড়েছে ১০ গুণ। একই সময়ে রাশিয়া থেকে ভারতের কয়লা আমদানিও বেড়েছে চারগুণ।
রাঘবন বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে লেনদেনে আমাদের কিছু সুবিধা রয়েছে, আমাদের একটি অর্থনৈতিক সুবিধা রয়েছে। ফলে এটিই কাজে লাগাচ্ছি আমরা। তার মানে এই নয় যে, রাশিয়া যা করছে তা-ই আমরা সমর্থন করব।
‘শান্তির পক্ষ’
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ভারতের স্পষ্ট অবস্থান রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
নয়া দিল্লির ওবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের গবেষক নন্দন উন্নিকৃষ্ণনান বলেন, এই মুহূর্তে রাশিয়ার সঙ্গে পুরোপুরি সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতে চায় না ভারত। খুব শিগগিরই দুই দেশের বন্ধন ছিন্ন হবে না। তবে যা হতে পারে তা হলো বন্ধনের ঘনিষ্ঠতা কমতে পারে।
ভারতের অবস্থান নিয়ে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রয়টার্সের মন্তব্যের অনুরোধে সাড়া দেয়নি।
অবশ্য নিউ ইয়র্কে ভারত ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এক বৈঠকের পর রাশিয়া বলেছে, বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা শক্তিশালী করার অভিপ্রায়ে জোর দিয়েছেন দুই মন্ত্রী।
এই প্রতিবেদনের বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের কাছে মন্তব্যের জন্য ইমেইল পাঠালেও কোনও সাড়া পায়নি রয়টার্স। তবে শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তিনি বলেছেন, কূটনীতি ও সংলাপের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ভারত।
তিনি বলেন, ‘ইউক্রেনে সংঘাত যত গড়াচ্ছে আমাদের প্রায় জিজ্ঞেস করা হচ্ছে আমরা কোন পক্ষে।’ রাশিয়ার কথা উল্লেখ না করে তিনি বলেন, ‘ভারত শান্তির পক্ষে এবং দৃঢ়ভাবে এই অবস্থানে থাকবে।’
রাশিয়ার পক্ষ থেকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া না পাওয়া ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ভারতের সাম্প্রতিক মন্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই দেশের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য কূটনৈতিক ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান ধরে রাখা নয়া দিল্লির জন্য সব সময় সহজ ছিল না।
উন্নিকৃষ্ণনান বলেন, যাদের লক্ষ্য করে ভারতের এই অবস্থান-পশ্চিমা সরকারগুলো বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। এমনকি ভারতের সাধারণ মানুষও এই অবস্থানকে ইতিবাচক হিসেবেই গ্রহণ করেছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের উদ্বেগের বিষয় হলো যুদ্ধ আরও এগিয়ে যাওয়ার পর পুতিন যদি কোনঠাসা হয়ে পড়েন তাহলে মস্কো আরও বেশি চীন ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়বে। ২০২০ সালে পশ্চিম হিমালয়ে সীমান্ত সংঘাতের পর চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নাজুক অবস্থায় রয়েছে।
এসওএএস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ের সিনিয়র লেকচারার অভিনাশ পালিওয়াল বলেন, আমার মনে হয় রাশিয়া নিজের ক্ষতি করছে বলে ভারতে মনোভাব ক্রমেই বাড়ছে। সিনো-রাশিয়া সম্পর্কে বেইজিংয়ের সুবিধার পাল্লা ভারী। হিমালয়ে যদি গুরুতর সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে তাহলে রাশিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারবে না, এটিই ভারতের মূল উদ্বেগ।