ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত হওয়ার পর ছয় মাস কেটে গেছে। কাশ্মিরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরেছে তা এখনও বলা যাবে না। তবে নিয়ন্ত্রিত আকারে ল্যান্ডলাইন, মোবাইল ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সার্ভিস ধীরে ধীরে আবারও চালু হচ্ছে।
এর মধ্যে ওই ভূখণ্ডে শুধুমাত্র হাতেগোনা অল্প কয়েকজন বিদেশি নাগরিকেরই পা পড়েছে, যাদের মধ্যে আছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্য, আর বাছাই করা ১৫টি রাষ্ট্রের ভারতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতরা। আজ (বুধবার) সেখানে যাওয়ার কথা রয়েছে আরও প্রায় ২৫টি দেশের রাষ্ট্রদূতদের।
প্রথম ব্যাচের ১৫টি রাষ্ট্রের মধ্যে যেমন বাংলাদেশ ছিল – আবার ছিল যুক্তরাষ্ট্রও। বস্তুত, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে থেকে ওই দলে দিল্লিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের তৎকালীন (ভারপ্রাপ্ত) হাই কমিশনার ও মালদ্বীপের রাষ্ট্রদূত, এই দুজনই শুধু ছিলেন।
তবে গত ৯ ও ১০ জানুয়ারি শ্রীনগর, অনন্তনাগ, জম্মু ইত্যাদি স্থানে ওই সফরের পর তাদের অভিজ্ঞতা নিয়ে কোনও দেশের পক্ষ থেকেই কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া হয়নি— বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়।
তবে সেই সফরের একমাস পর কাশ্মিরি অ্যাক্টিভিস্ট মীর জুনায়েদ, যিনি বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে দেখা করে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন। তিনি এ সপ্তাহে কথা বলেছেন বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে। এই প্রতিবেদককে তিনি জানিয়েছেন, ঠিক কী ধরনের কথাবার্তা তার হয়েছিল ওই রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে।
শ্রীনগর থেকে মীর জুনায়েদ গত সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) টেলিফোনে বলছিলেন, ‘আমি রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠকে তাদের পরিষ্কার বলেছি দেখুন, ৩৭০ ধারার বিলোপ কাশ্মিরে অনেকে হয়তো মেনে নিতে পারেননি— আর এটা নিয়ে অনেকের নানা ভুল বোঝাবুঝিও আছে।’
‘কিন্তু মোদ্দা কথা হলো, এটা পুরোপুরি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এখানে পাকিস্তানের নাক গলানোর কোনও একতিয়ারই নেই।’
‘আমাকে একটা কথা বলুন, কাশ্মিরের বিষয় আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে তুলে ধরার কোনও অধিকার পাকিস্তানের আছে? আমার তো মনে হয়, পাকিস্তানের মতো একটা ব্যর্থ রাষ্ট্র যদি কাশ্মির ইস্যু নিয়ে দুনিয়ায় শোরগোল ফেলতে চায়, তাহলে কেউই সে কথা বিশ্বাস করতে চাইবে না।’
‘আর আমার এত বছরের জীবনে কাশ্মিরে জঙ্গি ঢোকানো, আর জঙ্গিদের ট্রেনিং দিয়ে বোমা হামলা করতে পাঠানো ছাড়া আমি তো দেখিনি, পাকিস্তান কাশ্মিরের কোনও কাজে এসেছে বলে! সেই কথাটাই আমি বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সরাসরি বলেছি’, জানান মধ্য-তিরিশের মীর জুনায়েদ।
তিনি আরও বলছেন, কাশ্মিরে জঙ্গি অনুপ্রবেশ অব্যাহত রেখে পাকিস্তানই আসলে সেখানকার পরিবেশকে বিষিয়ে তুলেছে। পাকিস্তান থেকে জঙ্গিদের আনাগোনা বন্ধ হলে কাশ্মিরের অর্থনীতি যে ‘ম্যাজিক করে দেখাতে পারে’, সে ব্যাপারেও এতটুকু সন্দেহ নেই মীর জুনায়েদের।
‘কোনও কোনও রাষ্ট্রদূত আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কাশ্মিরে কীভাবে শান্তি ফিরবে? উত্তরে আমি বলেছি, সবার আগে আপনারা পাকিস্তানকে বলুন কাশ্মিরে ‘দখলআন্দাজি’ (অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ) বন্ধ করতে।’
‘কাশ্মির নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের বিরোধ গত ৭০ বছর ধরে। দিল্লি আর ইসলামাবাদ সেটা মেটানোর চেষ্টা করুক, কিন্তু কাশ্মিরিরা শান্তিতে থাকতে চায়— সেটা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ, পাকিস্তানকে সেটা বুঝতে হবে’, বলছিলেন তিনি।
অনেকটা একই সুরে কাশ্মিরি যুবক তৌসিফ রায়নাও বলছিলেন, ‘কাশ্মিরে স্বাভাবিক অবস্থা ফেরানোটাই যে অগ্রাধিকার– সেটাই অনেকে ভুলে যায়।’
বারামুলার এই যুবক নিজেকে পরিচয় দেন ‘কাশ্মিরি পিসমেকার’ হিসেবে, বলেন ‘আমি সবার আগে শান্তির পক্ষে।’
আজ (১২ ফেব্রুয়ারি) থেকে ভারতে নিযুক্ত বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের যে দ্বিতীয় ব্যাচটির কাশ্মির সফর শুরু হয়েছে, তাদের সঙ্গে দেখা করার কথা রয়েছে তৌসিফের।
বারামুলা থেকে টেলিফোনে তিনি এদিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, ‘দেখুন, এখন নর্মালসি বা স্বাভাবিক পরিস্থিতি যে অনেকটাই ফিরে এসেছে, তা তো অস্বীকার করা যাবে না। ডাল লেকেও আবার শিকারা চলছে তার নিজস্ব ছন্দে।’
‘বাচ্চারা আবারও স্কুলে যাচ্ছে, কলেজে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। আমি চাই দেশ-বিদেশ থেকে পর্যটকরা আবারও কাশ্মিরে আসুন, নিশ্চিন্তে এই জান্নাতে (ভূস্বর্গ) ঘুরে বেড়ান!’
‘‘একটা ‘ট্রাবল পয়েন্ট’ হয়ে কাশ্মির আর কতদিন থাকবে বলুন তো?’’
‘আমাদের দু-তিনটে প্রজন্মর জীবন এভাবে ছারখার হয়ে যাচ্ছে, কাজেই আমি বলবো, বাইরে থেকে অনর্থক সহানুভূতি দেখানো বন্ধ করে আপনারা বরং এখানে পর্যটক হিসেবে আসুন– তাতেই কাশ্মিরের লাভ!’
প্রসঙ্গত, প্রথম ব্যাচে যেসব দেশের রাষ্ট্রদূত কাশ্মিরে গিয়েছিলেন তার মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়াও ছিল আমেরিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, মালদ্বীপ, মরক্কো, ফিজি, নরওয়ে, ফিলিপিন্স, আর্জেন্টিনা, পেরু, নিজার, নাইজেরিয়া, টোগো এবং গায়ানা।
দ্বিতীয় ব্যাচেও প্রায় ২৫টি দেশের রাষ্ট্রদূতরা রয়েছেন। ভারতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ডেলিগেশনের প্রধানও খুব সম্ভবত এই দলে থাকছেন।