X
বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫
১৯ আষাঢ় ১৪৩২

পুঁজিবাদের মেশিনটাকে চিরতরে বিকল করে দিতে হবে

অরুন্ধতী রায়
১২ মে ২০২০, ১৮:৪০আপডেট : ১২ মে ২০২০, ১৯:২৪
image

প্রগতিশীল বামপন্থীদের আন্তর্জাতিক সংগঠন  প্রগ্রেসিভ ইন্টারন্যাশনাল। সংগঠনটির ওয়েবসাইটে 'আওয়ার টাস্ক ইজ টু ডিজ্যাবল দ্য ইঞ্জিন' শিরোনামে অরুন্ধতী রায়ের একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে। অরুন্ধতী প্রগ্রেসিভ ইন্টারন্যাশনাল-এর কাউন্সিল সদস্য। বিবৃতিতে কোভিড-১৯ আর সর্বাত্মক নজরদারিমূলক রাষ্ট্রপ্রণালীর ছায়াতলে থাকা পুঁজিবাদী বাজারব্যবস্থার সম্পর্কসূত্র বিশ্লেষণ করেছেন তিনি।  'পুঁজিবাদের মেশিনটাকে চিরতরে বিকল করে দিতে হবে' শিরোনামে এর ভাষান্তর করেছেন মোকাররম রানা। 

 

পুঁজিবাদের মেশিনটাকে চিরতরে বিকল করে দিতে হবে

পুঁজিবাদের মেশিনকে আচমকাই থামিয়ে দিয়েছে করোনা-মহামারী। তবে এটা কেবলই সাময়িক। মানবপ্রজাতি যখন ক্ষণিকের জন্য অবরুদ্ধ হয়ে আছে, পৃথিবী তখন নিজেকে সারিয়ে তোলার সক্ষমতার ইঙ্গিত দিয়েছে। মানুষ অসুস্থ হচ্ছে, প্রাণ হারাচ্ছে। আমাদের কিছুই করার নেই। তারপরও পৃথিবীর অপার বিস্ময়ের মাঝে সম্মিলিতভাবে শ্বাস নিতে পারছি আমরা। তবে পরিকল্পনা যেভাবে এগুচ্ছে, তাতে এ অপার বিস্ময়ও ধ্বংস হতে দেরি নেই। ভারতের কথাই ধরা যাক। এখানে এই অল্প কিছুদিনের মধ্যে বাঘদের জন্য সংরক্ষিত একটি অঞ্চলের বড় অংশকে কুম্ভ মেলা নামক এক ধর্মীয় জমায়েতের কেন্দ্রে পরিণত করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। কুম্ভমেলায় লাখ লাখ হিন্দু তীর্থযাত্রীর জমায়েত হয়ে থাকে। আসামে হাতিদের জন্য সংরক্ষিত একটি অঞ্চলকে কয়লা উত্তোলনের জন্য এবং অরুণাচল প্রদেশের হাজার হাজার একর আদি হিমালয় বন একটি নতুন জল বিদ্যুৎ বাঁধের জলাধারের পানিতে ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য চিহ্নিত করা হচ্ছে। এদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও কম যান না। চাঁদে খনন কাজ পরিচালনার অনুমতি দিয়ে একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন তিনি। 

করোনা ভাইরাস যেভাবে মানবদেহে প্রবেশ করেছে এবং বিদ্যমান অসুস্থতাগুলিকে বাড়িয়ে তুলেছে, ঠিক একইভাবে এটি দেশ এবং সমাজে প্রবেশ করেছে এবং তাদের কাঠামোগত জরা ও অসুস্থতাকে বাড়িয়ে তুলেছে। এটি অবিচার, সাম্প্রদায়িকতা, বর্ণবাদ, জাতিভেদ এবং সর্বোপরি বৈষম্যকে বাড়িয়ে তুলেছে।

রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার যে কাঠামো গরিব মানুষের দুর্ভোগের প্রতি উদাসীন ছিল এবং বরাবরই সে দুর্ভোগ বাড়িয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছে, একই সেই কাঠামোই এখন এ বাস্তবতা মেনে নিয়েছে যে দরিদ্রদের অসুস্থতা ধনীদের জন্য বাস্তব হুমকি। আর এ হুমকি মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত কোনও ঢাল নেই। তবে শিগগিরই একটি রক্ষাকবজ উপস্থিত হবে। হয়তো টিকা রূপে হাজির হবে তা। এর ছিপি কে আগে খুলবে তা নিয়ে ক্ষমতাবানেরা ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দিতে পারে। আর এর মধ্য দিয়ে আবারও দেখা যাবে পুরনো সে খেলা- ধনীদের বেঁচে থাকা।

একটি বিষয় আমার কাছে রহস্যজনক ঠেকছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার যে কাঠামোগুলো প্রগতি ও সভ্যতার নামে সবসময় বিনাশের পথ বেছে নিয়েছিল, তারাই এখন ভাইরাসটির ধ্বংসক্ষমতা নিয়ে গবেষণায় নেমেছে। পারমাণবিক, রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্র মজুত করার মধ্য দিয়ে তারাই একে আলিঙ্গন করেছে। স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে অন্য দেশের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ, গোটা জনগোষ্ঠীর জীবন রক্ষাকারী ওষুধ প্রাপ্তির অধিকার অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে তারা একে ডেকে এনেছে। তারা এই গ্রহের ধ্বংসকে তরান্বিত করার মধ্য দিয়ে একে বরণ করেছে। আর এ ধ্বংস প্রক্রিয়া (সত্যিকার অর্থে এরইমধ্যে এটি শুরু হয়েছে যদিও টিভিতে দেখা যাচ্ছে না)  এমনই বিধ্বংসী হবে যার কাছে কোভিড-১৯ কে একটি ছেলেখেলার মত মনে হবে। 

বর্তমানে যখন আমরা সবাই লকডাউনের মধ্যে আছি, তখন তারা তাদের দাবার ঘুঁটিগুলো বেশ দ্রুততার সাথে নাড়াচ্ছে। কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলির জন্য করোনাভাইরাস একটি উপহার হিসেবে এসেছে। বিশ্বব্যাপী মহামারী নতুন কিছু নয়। তবে ডিজিটাল যুগে এটি প্রথম মহামারী। আমরা জাতীয় পর্যায়ের কর্তৃত্ববাদীদের স্বার্থের সাথে দুর্যোগ নিয়ে মুনাফা করা আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী ও তথ্যদস্যুদের স্বার্থ মিলে যেতে দেখছি। এখানে, ভারতে এটি দ্রুততার সাথে ঘটছে। ভারতের বৃহত্তম মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক জিও’এর সঙ্গে চুক্তি করেছে ফেসবুক। এর মধ্য দিয়ে ৪০০ মিলিয়ন হোয়াটস এপ গ্রাহকের তথ্য (ইউজার বেজ) শেয়ার করবে তারা।

বিল গেটস প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রশংসা করেছেন; আশা  প্রকাশ করেছেন, যে প্রোটোকলই জারি হোক না কেন তাতে মুনাফা করা নিয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকবে না। এইরমধ্যে ৬ কোটিরও বেশি মানুষ নজরদারি/স্বাস্থ্য অ্যাপ ‘আরোগ্য সেতু’ ডাউনলোড করেছে। সরকারি চাকুরীজীবীদের জন্য এটি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

করোনা পূর্ববর্তী সময়ে আমরা একটি নজরদারির রাষ্ট্রে নির্বিকার জীবন-যাপন করেছি। আর এখন আমরা আতঙ্কের মধ্যে পড়ে সর্বময় ক্ষমতাধর-নজরদারি রাষ্ট্রের কব্জায় চলে যাচ্ছি। যেখানে আমাদের সমস্ত কিছু দিয়ে দিতে বলা হচ্ছে। উন্মুক্ত হচ্ছে আমাদের ব্যক্তিগত আব্রু, আমাদের মর্যাদা, আমাদের স্বাধীনতা। আমরা নিজেদেরকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত হতে দিচ্ছি। এমনকি লকডাউন তুলে নেওয়ার পরেও যদি আমরা দ্রুত সরে না আসি, তাহলে চিরকালের জন্য অন্তরীণ হয়ে যাব।

কীভাবে আমরা [পুঁজিবাদের] এই ইঞ্জিনটিকে বিকল করে দিতে পারি? সেটাই এখন ভাবতে হবে আমাদের।

 

লেখক ও অনুবাদক পরিচিতি: অরুন্ধতী রায় বুকারজয়ী ভারতীয় লেখক ও অ্যাকটিভিস্ট, মোকারকম রানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন, ফিল্ম অ্যান্ড ফটোগ্রাফি বিভাগের শিক্ষার্থী।

/এফইউ/বিএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বিচার-সংস্কার ও নতুন সংবিধান রচনা বাদে নির্বাচন হলে আমরা অংশ নেবো না: নাহিদ
বিচার-সংস্কার ও নতুন সংবিধান রচনা বাদে নির্বাচন হলে আমরা অংশ নেবো না: নাহিদ
ভোট ছাড়াই চেয়ার দখল করতে বগুড়া চেম্বারের কার্যালয়ে তালা
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিভোট ছাড়াই চেয়ার দখল করতে বগুড়া চেম্বারের কার্যালয়ে তালা
ফিরে দেখা: ৩ জুলাই ২০২৪
ফিরে দেখা: ৩ জুলাই ২০২৪
টিভিতে আজকের খেলা (৩ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (৩ জুলাই, ২০২৫)
সর্বাধিক পঠিত
নবম পে-কমিশন গঠনের কার্যক্রম শুরুর আশ্বাস অর্থ উপদেষ্টার
সংযুক্ত কর্মচারী প‌রিষ‌দের জরু‌রি সভানবম পে-কমিশন গঠনের কার্যক্রম শুরুর আশ্বাস অর্থ উপদেষ্টার
বরখাস্ত হলেন সেই ম্যাজিস্ট্রেট তাবাসসুম ঊর্মি
বরখাস্ত হলেন সেই ম্যাজিস্ট্রেট তাবাসসুম ঊর্মি
পরীক্ষার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, তদন্তে কমিটি
পরীক্ষার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, তদন্তে কমিটি
কার দোষে শ্রমবাজার বন্ধ হয় জানালেন আসিফ নজরুল
কার দোষে শ্রমবাজার বন্ধ হয় জানালেন আসিফ নজরুল
কেমন কেটেছিল ডিবি হেফাজতে ছয় সমন্বয়কের সাত দিন
কেমন কেটেছিল ডিবি হেফাজতে ছয় সমন্বয়কের সাত দিন