তৃতীয় বছরে প্রবেশ করতে যাচ্ছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। এই যুদ্ধে প্রথম থেকেই ইউক্রেনকে অস্ত্র সহায়তা দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল কার্টিস টেলর জানান, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া রকেট দিয়ে রুশ সেনাদের ওপর হামলা চালিয়েছিল ইউক্রেন। ইলেকট্রনিক সঙ্কেতের মাধ্যমে চালানো ওই হামলায় অন্তত ৯০ রুশ সেনা নিহত হয়েছিল। কিন্তু সেই সময়ের তুলনায় বর্তমানে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের গতি প্রকৃতি পাল্টে গেছে।এর পেছনে অনেকগুলো কারন রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। তবে এসবের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে মোবাইল বা সেলফোনকে দায়ী করেছেন তিনি।
টেলর বর্ণনা করেছেন, একটি হামলার সময় পাইলট সফলভাবে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন। কারণ বিমানটি যে পথ ধরেছিল তা নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়েছিল শত্রু বাহিনী। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেছে,বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত সেলফোন ডেটা পরীক্ষা করে, মরুভূমি জুড়ে প্রতি ঘণ্টায় ১২০ মাইল বেগে ভ্রমণকারী একটি ডিভাইসের সঠিক অবস্থান নির্ণয় করা সক্ষম। আর সেটা সম্ভব করেছে রাশিযানরা।
তিনি বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সিগারেটের ধোঁয়া যেমন হুমকিস্বরূপ ছিল, এখন তেমনি হুমকিস্বরূপ এই সেলফোন এবং এর প্রতি আসক্তি। কারণ সেলফোনের মাধ্যমে তোলা ছবি বা ভিডিও একটি নির্দিষ্ট স্থানে জমা হয়। সেটি গবেষণা করেও,সেনাদের সঠিক অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব। তাই সেনাদের সেলফোন আসক্তি বন্ধে অনঢ় এই জেনারেল।
এছাড়া রেডিও, ড্রোন কন্ট্রোলার ও অন্য যানবাহনগুলোও যথেষ্ট পরিমাণে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক কার্যকলাপ এবং তাপ শক্তি উৎপন্ন করে যা সনাক্ত করা যায়। তাই তো শত্রুর নজরদারি বিভ্রান্ত করতে,সেনাদের সহজভাবে লুকিয়ে থাকতে শেখানো হচ্ছে।
ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে পেন্টাগন আরো যে শিক্ষা নিয়েছে তা হলো-ড্রোন থেকে ছোট ছোট যুদ্ধাস্ত্র নামানোর কৌশল। আরও উন্নত কাউন্টার-ড্রোন সিস্টেমের বিকাশও জরুরি হয়ে উঠেছে। অবশ্য ইউক্রেনীয়রা ড্রোন শনাক্ত করার জন্য কিছু উদ্ভাবনী সমাধান আবিষ্কার করেছে বলে জানিয়েছেন ইউরোপ ও আফ্রিকায় মার্কিন বিমান বাহিনীর অপারেশন প্রধান, জেনারেল জেমস বি. হেকার। স্মার্টফোন ও মাইক্রোফোন ব্যবহার করে শব্দ সনাক্ত করতে সক্ষম এক নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন দুই ইউক্রেনীয় সেনা। এই তথ্যটি তখন বিমান প্রতিরক্ষা সেনাদের কাছে পাঠানো হয় এবং পেন্টাগনের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা সংস্থাকেও জানানো হয়।
ইউক্রেন সেনাদের কাছ থেকে আরেকটি জিনিস শিখেছে মার্কিন সেনারা। আর তা হল পরিখা খনন করার গুরুত্ব। তাদের মতে, হয় খনন কর না হয় মর।
ইউক্রেন যুদ্ধের এক পর্যায়ে দেশটির প্রায় হাজার হাজার মডেম নষ্ট করে দিয়েছে রাশিয়ার হ্যাকাররা। ইউক্রেনের অনেক তথ্য চলে গেছে রুশ হ্যাকারদের কাছে। তাই সাইবার হামলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ তৃতীয় বছরে প্রবেশ করার পাশাপাশি এই সঙ্কেতও দিচ্ছে যে, সহসাই এ যুদ্ধ থামবে না। বরং চলতেই থাকবে। আর এই বিষয়টি পেন্টাগনকে স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, যুদ্ধক্ষেত্রের হিসেব-নিকেশ এ বছর মৌলিকভাবেই পরিবর্তিত হয়েছে। রাশিয়া বিপুল সংখ্যক সেনা মোতায়েন করছে। ইউক্রেনের কাছে অত্যাধুনিক অস্ত্র, ড্রোন ও ডিজিটাল নজরদারি যাই থাকুক না কেন, তারা এখন ঝুঁকির মধ্যেই রয়েছে। অবশ্য তাদের এসব অস্ত্র ও লোকবল দিন দিন কমছে।
অত্যাধুনিক অস্ত্রের কারণেই ইরাক, আফগানিস্তান বা মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ইরাক ও আফগানিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী বা জঙ্গি গোষ্ঠীর সাথে লড়াই করার চেয়ে চীন বা রাশিয়ার মতো শক্ত প্রতিদন্দ্বীর সাথে লড়াই করার বিষয়টি এখন বিশদভাবে পুনর্বিবেচনা করছে পেন্টাগন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সিনিয়র প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেছেন, যুদ্ধের চরিত্র পরিবর্তন হচ্ছে। সেন্টার ফর এ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি,থিঙ্ক ট্যাঙ্কের প্রতিরক্ষা প্রোগ্রামের পরিচালক স্টেসি পেটিজন বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধ পেন্টাগনের সমস্ত অনুমানকে চ্যালেঞ্জ করেছে। যুদ্ধটি এমন এক পর্যায়ে রয়েছে যেখানে প্রতিটি পক্ষ অপর পক্ষকে পরাস্ত করার চেষ্ট করছে।
পেন্টাগন বিশ্বাস করত, যুদ্ধ জয়ের জন্য অত্যাধুনিক,ব্যয়বহুল যুদ্ধাস্ত্র ও তার ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাদের এতোদিনের বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। ফলে ইউক্রেন যুদ্ধ ক্ষেত্র তাদের জন্য এক গবেষণার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। আর এই গবেষণা পেন্টাগনের পরবর্তী জাতীয় প্রতিরক্ষা কৌশল ঠিক করতে সাহায্য করবে। এরই মধ্যে একটি প্রকল্পের আওতায় ২০ কর্মকর্তা যুদ্ধের পাঁচটি ক্ষেত্র পরীক্ষা করছেন। ক্ষেত্রগুলো হলো- স্থল কৌশল, বিমান শক্তি, তথ্য যুদ্ধ, টেকসই ও ক্রমবর্ধমান বাহিনী এবং দূরপাল্লায় গুলি ছোড়ার সক্ষমতা।
সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট