X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

আদর্শের সমীকরণে রাজনৈতিক লেখচিত্র

মারুফ রসূল
২০ এপ্রিল ২০২১, ২০:০১আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০২১, ২০:০১

বাংলাদেশের সামনে এখন দু’টো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। একটি মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী, অন্যটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমীকরণ কতটা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের অনুগামী আর কতটুকুই বা তার বিচ্যুতি—, উল্লিখিত দু’টো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তার বিচার করতে পারবো। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে নানা টানাপড়েনের পরও মুক্তিযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের কাছে এই সত্য সুস্পষ্ট যে, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রপঞ্চের সংজ্ঞায়ন নিহিত আছে মুক্তিযুদ্ধের দার্ঢ্য চেতনার পাণ্ডুলিপিতে– বলা ভালো, বাংলাদেশের প্রশ্নে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে লিখিত সেই অমোঘ পরিচয়পত্রে- সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের বাংলাদেশ। আমাদের স্বপ্ন ও প্রত্যাশার সূচনা আর গন্তব্যবিন্দুও এখান থেকেই নির্ণীত।

বাংলাদেশ: রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক মানস
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু তাঁর সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে ‘স্বাধীনতা’ ও ‘মুক্তি’ শব্দ দু’টো আলাদাভাবে ব্যবহার করেছেন এবং নিঃসন্দেহে তার আলাদা দু’টো প্রত্যয়ও রয়েছে। ১৯৭১ সালের ষোলোই ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ভূ-খণ্ড হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে উদ্বোধিত হয় বটে কিন্তু একই সঙ্গে শুরু হয় তার রাষ্ট্র হয়ে ওঠার লড়াই। অর্থাৎ স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হবার পর বাংলাদেশ রাষ্ট্র হয়ে ওঠার যুদ্ধ শুরু করে বঙ্গবন্ধু সরকারের নেতৃত্বে। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট এ যুদ্ধের এক নির্মম ছেদচিহ্ন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পাঠ্যসূচিতে ১৯৭৫-১৯৯৬ সময়কালটি খুব বেশি আলোচিত হয় না, কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না- এই একুশ বছরে দু’টো প্রজন্ম বড় হয়েছে এবং বর্তমানে বাংলাদেশের নানামাত্রায় তারাও নেতৃত্ব প্রদান করছেন। এই যে পঁচাত্তর পরবর্তী রাজনৈতিক অভিঘাত– যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাতিল, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দায়মুক্তির অধ্যাদেশ, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির অন্ধকার যুগকে ফিরিয়ে আনা, সেনাতন্ত্রের শাসন কায়েম রাখার জন্য মোল্লাতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করা, রাষ্ট্রধর্মের মতো উদ্ভট বিষয়কে সংবিধানে ঠাঁই দেওয়া– এগুলো একদিকে যেমন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক চরিত্র নির্মাণ করেছে, তেমনই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তৎকালীন প্রজন্মের মনস্তত্ত্বকে প্রভাবিত করেছে। ফলে গোটা আশির দশক সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্র-জনতার সংগ্রামে মুখর থাকলেও নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের নায়করা শেষ পর্যন্ত আর নায়ক থাকলেন না। একটি বিকল্প রাজনৈতিক ধারা নির্মাণের বদলে তারা নিজেরাই হয়ে উঠলেন ক্যান্টনমেন্টকেন্দ্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর কাণ্ডারি। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সমীকরণটি ছিল ভিন্ন। পঁচাত্তরের পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বশূন্যতা দূর করতে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দলের হাল ধরেন। সেক্ষেত্রে প্রজন্মের মনস্তত্ত্ব তৈরির চেয়েও আওয়ামী লীগকে নিজের দলের হাল ধরে রাখাটিই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে বিএনপি এবং তার সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে থাকে যুদ্ধাপরাধীদের সংগঠন জামায়াতে ইসলামি।

পঁচাত্তর থেকে ছিয়ানব্বই পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক টাইমলাইনে একমাত্র ক্রান্তিবিন্দুটি ছিল শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলন। কারণ, স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাংলাদেশের ইতিহাসের মূলধারায় ফেরার তাগিদ সেখানে ছিল না। সেই তাগিদ ও স্ফুলিঙ্গ দু’টোই পরিব্যপ্ত হয়েছিল শহীদ জননীর আন্দোলনে। ফলে সরকারি সম্প্রচার মাধ্যম ও পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস বিকৃতির জঘন্য অপরাজনীতির বলি হওয়া নব্বই প্রজন্মের কৈশোর মানসে শহীদ জননী নির্মাণ করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধমুখী এক প্রতি রাজনৈতিক ধারা। তাঁর একাত্তরের দিনগুলো গেরিলা কমান্ডারের মতো ভেঙে ফেলেছিল আমাদের মগজের যাবতীয় ১৪৪ ধারা। সুতরাং, ভাষা আন্দোলন প্রজন্ম, ষাটের প্রজন্ম বা মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের মতো যদি নামকরণ করতেই হয় তবে আমাদের প্রজন্মের নাম হওয়া উচিত শহীদ জননীর প্রজন্ম।

রাজনৈতিক ভাষ্যে শাহবাগের গণজাগরণ
১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সরকার গঠনে এই শহীদ জননীর প্রজন্ম কোনও ভূমিকা পালন করেনি, এমনকি ২০০১ সালে বিএনপি-রাজাকার জোটের সরকার গঠনের দুঃসময়েও এই প্রজন্ম ছিল কেবলই পর্যবেক্ষক। কিন্তু এই পর্যবেক্ষণ বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। কারণ, এই পর্যবেক্ষণের একটি মূর্ত প্রতিফলনই ছিল বাংলা ব্লগের একেবারে শুরু থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গবেষণা ও লেখা শুরু করা। কিন্তু উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো– এই দাবি ছিল সম্পূর্ণভাবে একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণের দাবি; কেননা বাংলা ব্লগের একদিকে যেমন যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি আসতো তেমনি যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক অধিকার স্থগিতের বিষয়টিও উচ্চকিত ছিল। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিও বাংলা ব্লগে নানামাত্রিক যুক্তিতে উঠে এসেছে। অর্থাৎ শহীদ জননীর প্রজন্ম শাহবাগের গণআন্দোলনের যে রাজনৈতিক ভাষ্য নির্ধারণ করেছিল মোটা দাগে তা হলো– স্বাধীন বাংলাদেশে যে দলই রাজনীতি করুক না কেন মুক্তিযুদ্ধের মৌল প্রশ্নে তাদের একমত হতে হবে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতার প্রশ্নে তাদের শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে।

এই রাজনৈতিক ভাষ্য প্রতিষ্ঠার লড়াই হিসেবে শাহবাগ আন্দোলন একটি প্রতি-আক্রমণের নথি প্রস্তুত করেছিল, যার মূল বক্তব্য হলো– যুদ্ধাপরাধীদের সকল আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রায়ত্তকরণ করতে হবে, যুদ্ধাপরাধী, তাদের পরিবার ও দোসরদের নাগরিক অধিকার বাতিল করতে হবে। অর্থনীতির রাজনীতিকে শাহবাগ গুরুত্বপূর্ণ মনে করে বলেই তাদের ছয় দফা দাবিতে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক শূন্যস্থানকে তারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।

রাজনৈতিক সুঁচ ও আদর্শের সুতো: নকশীকাঁথার বাংলাদেশ
স্বাধীনতার এই সুবর্ণজয়ন্তীলগ্নে যদি এই প্রশ্ন করা হয় যে, বাংলাদেশ রাজনৈতিক অক্ষরেখার কোনদিকে দাঁড়িয়ে– তবে স্বভাবতই উত্তরটি হতাশাব্যঞ্জক হবে না। কারণ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি পরিবর্তন ঘটেছে। যে দেশে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বললেই একসময় রাজপথে নৈরাজ্যের ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠতো, সে দেশের জনগণ নৈরাজ্যের রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সাত বছর আগে জামাত-শিবির ও বিএনপি’র সন্ত্রাসী কার্যক্রমের জবাবে গণমানুষ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। শাহবাগ আন্দোলনের প্রতিফলন বোঝার জন্য আমরা পরবর্তী কয়েকটি আন্দোলন (ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন, ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন) নিয়ে গবেষণা করতে পারি। আন্দোলনের ভাষায় যেমন পরিবর্তন এসেছে, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিবর্তন এসেছে আন্দোলনে রাজনৈতিক ভাষ্য নির্মাণের প্রক্রিয়ায়। রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিটি সোপানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যে ভূমিকা আমরা দেখতে পাই, তা নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। এই পর্যালোচনার ওপর দাঁড়িয়ে আমরা যদি আগামীর বাংলাদেশের একটি সঞ্চারপথ নির্মাণ করি তবে দেখতে পাব– বর্তমান ও আগামী পৃথিবীর চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ একটি দক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। এই ধারাটি যেন অব্যাহত থাকে, সে লক্ষ্যেই আমাদের কাজ করতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির ভয়াবহকাল, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস, যুদ্ধাপরাধীদের আস্ফালন, নৈরাজ্য আর অপরাজনীতির খবরদারি পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন এক মাহেন্দ্রক্ষণের সামনে দাঁড়িয়ে। করতলে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস নিয়ে এক সূর্যমুখী রাজনৈতিক অভিযাত্রার পথে বাংলাদেশ। এই রাজনৈতিক অভিযাত্রাটি যেন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের অনুগামী হয়– সেটা নিশ্চিত করতেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে প্রবাহিত হচ্ছে একাত্তরের ইশতেহার।

যে দেশের জন্ম হয়েছে রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, সে দেশের প্রতিটি প্রজন্মই হোক স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের অতন্দ্র প্রহরী।

লেখক: ব্লগার ও গবেষক

/এসএএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
শহীদ জননী: আমাদের অনিবার্য ইশতেহার
সেই অবিনাশী উচ্চারণ
ফিফথ কলামের রাজনীতি
সর্বশেষ খবর
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’