কাচ আর ইস্পাত দিয়ে আধুনিক প্রযুক্তিতে বানানো বিমানবন্দরের যুগ এখন। যেমন একই কাঠামো, চকচকে ও চমকপ্রদ টার্মিনালগুলো মর্যাদার প্রতীক হয়ে উঠেছে। কিন্তু রাশিয়ার কাঠের তৈরি কিছু বিমানবন্দর ঠিক উল্টো। রুশ সুমেরুদেশ ও সাইবেরিয়ার মরুভূমিতে ভিন্ন এক সেকেলে পরিবেশ ধরে রেখেছে এগুলো।
পুরোপুরি অন্যরকম এসব বিমানবন্দর গড়ে ওঠে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিটি অঞ্চলে পৌঁছানোর উপায় ছিল বিমান পরিবহন। তবে এসব জায়গায় ডিউটি-ফ্রি শপ, ফাস্টফুডের দোকান কিংবা বিখ্যাত ফ্যাশন ব্র্যান্ডের শোরুম নেই। রানওয়েও অপরিচ্ছন্ন। টার্মিনাল দেখতে অনেকটা কুঁড়েঘর বা ঝুপড়ির মতো। তবে কাঠ দিয়ে বানানো বিমানবন্দরগুলোর সৌন্দর্য অন্যরকম।
কিছু বিমানবন্দর জীর্ণ। তবে ঠুনকো আর সাধারণ কাঠামোতেই অসাধারণ এগুলো। পর্যটকদের জেনে রাখা ভালো—এসব বিমানবন্দরের বেশিরভাগেই নিয়মিত বিমান সেবা চালু রয়েছে। সেসব স্থান একইসঙ্গে রোমাঞ্চকর। রাশিয়ার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাঠের বিমানবন্দরগুলোর গল্প বলা যাক।
সলোভকি
রাশিয়ার ইউরোপীয় অংশে সুমেরু বৃত্তের নিচে হোয়াইট সি বা শ্বেতসমুদ্রে সলোভেতস্কি দ্বীপের প্রবেশপথ বলা যায় সলোভকি বিমানবন্দরকে। সেখানে পঞ্চদশ শতকের আশ্রম দেখতে অনেক পর্যটক সমাগম হয়। ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট স্বীকৃতি পেয়েছে এটি। এর পুরোটাই কাঠের তৈরি। স্থাপত্যের এ এক আশ্চর্য! সলোভকি থেকে রাশিয়ার উত্তরাঞ্চলের বড় শহরগুলোর মধ্যে আরখানগেলস্কে নিয়মিত যাত্রীরা যাতায়াত করেন।
লেতিনিয়া জোলোতিৎসা
শ্বেতসমুদ্রের তীরে সলোভেতস্কি দ্বীপের অদূরে রয়েছে লেতিনিয়া জোলোতিৎসা বিমানবন্দর। এর ইংরেজি করলে দাঁড়ায় ‘সামার গোল্ড’। সেখানে হার্প সিল প্রাণী দেখতে পর্যটকরা ভিড় করেন।
মেজেন
রাশিয়ার উত্তরের দিকে আরখানগেলস্কে অবস্থিত মেজেন বিমানবন্দর। এর কাঠের কাঠামো ফ্যাকাশে নীল রঙে আঁকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নির্মিত এই স্থাপনা ঊনিশ শতক থেকে আবহাওয়া স্টেশন হিসেবে ব্যবহৃত হতো। বর্তমানে বছরে ৬ হাজার যাত্রী যাতায়াত করে এই বিমানবন্দরে। রাশিয়ার উত্তরের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে যেতে এর বিকল্প নেই।
সিমচেন
রাশিয়ার পূর্ব উপকূলে অবস্থিত মাগাদান একটি সুনসান প্রদেশ। সেখানে জনসংখ্যা মাত্র দেড় লাখের চেয়ে একটু বেশি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই স্থান পরিণত হয়েছিল ব্যস্ত এয়ার করিডোরে। আলাস্কা-সাইবেরিয়ান বিমান রুট দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রয়োজনীয় মালামাল পাঠানো হতো। ১৯৪২ সালের দিকে এটিকে মেরামত করে সিমচেন বিমানবন্দরে রূপ দেয় রুশ সরকার। এটি দেখতে যেন রূপকথার মতো মুগ্ধকর!
ইওরগালান
দূর থেকে দেখে মনে হবে এটি যেন পাহাড়ঘেঁষে নির্মাণ করা কোনও হোটেল। অধিকাংশ পর্যটকই এই ভুল করে থাকেন। হওয়াটাও স্বাভাবিক। কারণ, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন অনেক রিসোর্ট চোখে পড়ে। ইওরগালান বিমানবন্দর রাশিয়ার কনদিওর মাসিফ প্রদেশে পার্বত্য এলাকায় অবস্থিত। এটি কাঠের বিশেষ স্থাপনা। ভৌগোলিকভাবে রাশিয়ার বাদবাকি প্রদেশের মতো নয় জায়গাটি। এর পুরোটাই অগ্ন্যুৎপাতের সময়ে উৎপত্তি হওয়া পাহাড়-পর্বত দিয়ে ঘেরা। বছরে এই বিমানবন্দরে যাতায়াত করেন ৭ হাজার ২০০ যাত্রী।
খুজির
বৈকাল হ্রদের কথা কে না জানেন! সেখানে পর্যটকদের প্রিয় স্থান ওলখোন দ্বীপের কাছে খুজিরে আছে রুশ কাঠের বিমানবন্দরের আরেকটি স্থাপত্য। তবে ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এটি বন্ধ রয়েছে। এখন কালেভদ্রে স্পোর্টস প্লেন অনির্ধারিতভাবে সেখানকার রানওয়েতে নামে। এই বিমানবন্দরের দেখাশোনা করেন সাবেক পাইলট ভ্লাদিমির প্রোকোপিয়েভ ও তার স্ত্রী হেরোল্ডা।
ইগরিম
পশ্চিম সাইবেরিয়ার তেল ও গ্যাসের খনিতে আছে ইগরিম বিমানবন্দরের কাঠের টার্মিনাল। রাশিয়ায় বাণিজ্যিক অপারেশনস চালানো হয় এমন রানওয়ের মধ্যে সবচেয়ে অপরিচ্ছন্ন এটি। এখান থেকে শিডিউল ও মৌসুমি ফ্লাইট চলাচল করে।
শারা
অনেকটা ভৌতিক বাংলোর মতো দেখালেও এটি ঠিক উল্টো। প্রতি বছর প্রায় ৮ হাজার যাত্রী এই বিমানবন্দর হয়েই আকাশপথে পাড়ি জমান। তবে দিনের আলোতেই কেবল সেখান থেকে ফ্লাইট ছাড়ে। শারা বিমানবন্দর থেকে বৈকাল হ্রদের কাছে চিতায় শিডিউল ফ্লাইট পরিচালনা করে স্থানীয় আকাশসেবা প্রতিষ্ঠান আঙ্গারা এয়ারলাইনস
বেলায়া গোরা
সাখা প্রজাতন্ত্রে ১০ লাখের চেয়ে কিছুসংখ্যক কম মানুষের বসবাস। জায়গাটি ‘জাকুতিয়া’ নামেও পরিচিত। সাইবেরিয়া অঞ্চলের এই প্রদেশ পুরো ফ্রান্সের চেয়েও পাঁচগুণ বড়। এটি মূলত তাগা বনের বিস্তৃত অংশ। ফলে সেখানে আছে কাঠের তৈরি বেশ কয়েকটি বিমানবন্দর। এরমধ্যে বেলায়া গোরা অন্যতম।
খাতাঙ্গা বিমানবন্দর
খাতাঙ্গা বিমানবন্দরসহ মোট তিনটি কাঠের বিমানবন্দর রয়েছে সেখানে। অন্য দুটি হলো তুরুখানস্ক বিমানবন্দর ও ইয়েনিসেস্ক বিমানবন্দর।এরমধ্যে খাতাঙ্গা রাশিয়ার সুমেরু অঞ্চলের সবচেয়ে ব্যস্ত বিমানবন্দরের উপাধি পেয়েছে। গত বছর সেখানে ৩৪ হাজারেরও বেশি যাত্রী যাতায়াত করেছে। সেখানে মাঝারি আকারের উড়োজাহাজ অবতরণ করতে পারে। বিমানবন্দরটির অবকাঠামোর উন্নয়নের পরিকল্পনা চলছে।
* ভার্খনেভিলিউয়িস্কের সাড়ে ৬ হাজার গ্রামীণ বাসিন্দার যাতায়াত কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে এই বিমানবন্দর।
* রাশিয়ার পূর্বাঞ্চলের শেষ প্রান্তে খাবারোভস্ক ক্রাই এলাকায় অবস্থিত কাঠের তৈরি মার-কিউয়েল বিমানবন্দর।
* খাবারোভস্ক ক্রাই এলাকায় অবস্থিত কাঠের তৈরি আরেক স্থাপনা নেল’কান বিমানবন্দর।
* স্রেদনেকোলিমস্ক শহর থেকে এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই বিমানবন্দর। সেখানে মাছ চাষ ও হরিণ পালন স্থানীয়দের জীবিকার উৎস।
* তাগা বনের বিস্তৃত অংশে অবস্থিত আরেকটি বিমানবন্দর অলেনিওক।
* নিয়ার্বা শহরে ১০ হাজার মানুষ বসবাস করেন। তাদের জন্য রয়েছে এই বিমানবন্দর।
* উস্ত-কিউগা বিমানবন্দর ব্যবহার করে থাকেন সাখা প্রজাতন্ত্রের অন্তর্গত উস্ত-ইয়ানস্কি জেলার ১ হাজারেরও কম বাসিন্দা।
সূত্র: সিএনএন ট্রাভেল