X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

মানবিক সভ্যতার খোঁজে জফির সেতুর পদযাত্রা

শামীম রেজা
২১ ডিসেম্বর ২০২১, ১৫:২৫আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২১, ১৫:২৮

পাহাড় আর পাহাড়ের চা-বাগানের শ্রমিক, হাওড় আর তার গীতিকবি নদী আর তার সভ্যতা-সংস্কৃতির রূপ পান করে যে কবির জন্ম, তিনি বাংলা-বিহাড়-উড়িশা নয়, তিনি অসমের অনন্য স্বর্গভূমি শ্রীহট্ট সিলেটের ল্যান্ডস্কেপে বেড়ে উঠেছেন; শ্রীহট্টকে কল্পনার সেই প্রাচীন নগর সভ্যতার সিন্ধুনদের সৌন্দর্যের লীলাভূমির মতো প্রতিস্থাপন করেছেন ‘সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী’ কাব্যে; তিনি জফির সেতু। যেমন দক্ষিণের এস্পানিয়ার কবি হুয়ান রামোন হিমেনেথাকে পড়তে প্রাচীন আন্দালুসিয়ার পাহাড়, উপত্যকা নদী, সমুদ্র আর শস্যসুফলা জমিনের স্থাপত্যকলা জানা অনিবার্য তেমনি জফিরের কবিতা পাঠের পূর্বে সিন্ধু অববাহিকার খ্রিষ্টপূর্ব তিন হাজার বছর আগের নগর সভ্যতা, যা কিনা মিশর ও মেসোপটেমিয়ার সভ্যতাকে পূর্বের, তাদের সুপ্রাচীন সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা থাকা অনিবার্য। তেমনি পৃথিবীর যোনির মতো, সৌন্দর্যমণ্ডিত ভূস্বর্গ কাশ্মির আর কাশ্মিরীদের হৃদয়ছেঁড়া আর্তনাদ সম্পর্কে অনুভূতির ছোঁয়া মিলবে; ২১ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ বিজয় পতাকা হাতে স্বাধীন ভূ-খণ্ডে জন্ম নেয়া কবি জফির সেতুর কবিতা অনুধ্যানে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বহুবর্ণ রক্তবীজ’ ২০০৪ এ প্রকাশিত প্রথম কবিতা ‘মর্মজ্ঞান’ এর প্রথম চরণেই একজন প্রত্যয়দীপ্ত কবির প্রতিধ্বনি স্পষ্ট। “শীতের পাতা আর নদীর জল যেভাবে নাও তেমনই তোমাকে তুলে নাও/ হাতের মুঠোয়/ তোমার মেদমজ্জা যদি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তাও তুলে নাও নিবিড় মমতায়/ একবারই তুমি নিজেকে পাবে এমন মধুর মাটিতে/ নিজেকে থ্যাঁতলে দাও দুপায়ের নিচে, তোমার রক্তমেদ গড়িয়ে পড়ুক/ ধুলো ও ঘাসে/ এমন নিষ্ঠুর একবারই তোমাকে নেবে জগতের হরিৎ শস্যক্ষেত্রে/ আমাকে আমি একবার বহুবার হাতের মুঠোয় নিয়েছি/ আর থ্যাঁতলেও দিয়েছি/ চূড়ান্ত সংকটের মধ্যেও জীবনের অন্তর্লীন রহস্যকে স্বীকার করে তার খোঁজ শ্রদ্ধার সঙ্গে আত্মনিবেদন; কীভাবে একজন কবিকে ইঙ্গিতময়তা থেকে সরাসরি চিত্র-বাস্তবে উপস্থিত করেন তার প্রমাণ ‘মর্মজ্ঞান’ কবিতায়। ভীষণ আত্মসচেতন এই কবি পরিণত বয়সে (তেত্রিশ বছর বয়সে) প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থে নির্মোহভাবে বলেন যেন অমোঘ সত্য যে প্রেম একবারই ধরা দেয় স্বপ্নকল্পনায় ‘একবারই তুমি নিজেকে পাবে এমন মধুর মাটিতে’-নিজেকে একাভিভূত করতে ধুলো ও ঘামে এ যেন নিষ্ঠুর যজ্ঞ, যে যজ্ঞ প্রত্যেকেরই নিয়তি যেন; কবি জগতের হরিৎ শস্যক্ষেত্রে নিজেও একের মধ্যে বহুর বিস্তৃতিতে নীলকণ্ঠের মতো পান করেছেন এমন নিয়ামক।

অগ্রজের উত্তরাধিকার হিসেবে অনেকেই টিএস এলিয়টের সেই ট্রাডিশন এন্ড ইন্ডিভিজ্যুয়াল ট্যালেন্ডের কিছু কথাকে গ্রহণ করি―যেমন ‘যে কেবল কোনো সৎ কবিই পারেন কোনো পূর্ববর্তী কবিকে সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করে নিজেকে গড়ে তুলতে।’

সেক্ষেত্রে জফির সেতু প্রথম দিকে তার পূর্বপুরুষ জীবনানন্দকে ইন্দ্রিয়চেতনায় গ্রহণ করে চলে গেলেন নিজস্ব কাব্যলোকের খোঁজে। যেমন ‘বাঘ’ কবিতায় :

বনমুগ্ধরাতে বাঘ কি তবে মিলনোন্মুখ বাঘিনীর সাথে?
ছায়া ভেঙে আমি তার তত্ত্বতালাশে এতদূর এসেছি
অঘ্রাণের ধানকাটা রাতে যাদের চোখে জ্বলত তীব্র আগুন
আর তারাজ্বলা প্রহরে প্রাচীনারা যে-সিংহপুরুষদের
গল্পে ছিলেন বিভোর; পৃথিবীর সে-শিকারিরা নিজেই শিকার

এই কবিতায় জীবনানন্দের ঋণ স্বীকার করে ‘সহস্র ভোল্টের বাঘ’ (২০০৬) এবং ‘স্যানাটোরিয়াম’ (২০০৮) কাব্যগ্রন্থ নিজেকে ভিন্ন উচ্চতায় দাঁড় করালেন জফির। বিশেষ করে ‘তাঁবুর নিচে দূতাবাস’ (২০১১) কাব্যে এসে নিজস্ব মনন খুঁজে পেলেন যেন, পেলেন আপন শৈলীতে এবং বোধে দাঁড়ানোর জমিন। এই কবিতায় প্রবেশের পূর্বে কবিতা সম্পর্কীয় কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন।

কবিতা যেহেতু বিচিত্র ধরনের, কোনো কোনো কবি মনে করেন :

ক. চিত্রকল্পের সৌধ নির্মাণের মধ্যদিয়ে বোধের লক্ষ্যে পৌঁছানোই কবিতা
খ. কেউ কেউ ভাবনার বা বোধের বিকাশকল্পে সুরস্বর্গের খোঁজে নামেন
গ. কেউ কেউ শুধু রূপকল্পের বিকাশে বিন্যস্ত করেন কাঠামো
ঘ. কেউ-বা ভাবনার ভাষাকে পূর্বতনকে ছাড়িয়ে নিজস্ব কাব্যভাষার খোঁজে নিরন্তর লড়ে যান।
ঙ. কেউ কেউ সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমালোচক সরাসরি মেদহীন কবিতাচর্চায় বিশ্বাসী।
চ. রোম্যান্টিক মনে করতেন ঈশ্বর বা মানসদেবতা তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিচ্ছেন।
ছ. অনেকেই মনে করেন শিল্প সাধারণের জন্য নয়, এই মহার্ঘ্য সৃষ্টিশীল সেই লোকেদের একান্ত ফসল, যা শুধু বিশিষ্টজনরাই বুঝবে। তাই তো শিল্পের জন্য শিল্প দর্শনেরও জয়জয়কার হয়েছিল একসময়।

এটাও সত্য যে, এক শতকে আসলে কয়জন কবির মানবিকতার চরণ, যুগে যুগে অন্য যুগের পরিবর্তিত সমাজ বাস্তবতায় তার বাণী পৌঁছে যায়? যাকে আমরা চিরন্তন বলি, তাও তো ভুল প্রমাণিত হয় কখনও কখনও।

রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এমনকি ধর্মের ভেদাভেদ এটা এক যুগের তাচ্ছিল্যে অন্য যুগের আশীর্বাদ হিসেবে দেখা যায়। কয়জনই-বা সেতুবন্ধনের রূপকার হিসেবে পরবর্তী সময়ের চিরন্তন লেখকে পরিণত হতে পারেন?

কবিতা সম্পর্কীয় এই কথার যদি কোনো সমাধান পাওয়া যেত, তাহলে কেউ কবিতা লিখত না আর, ‘ভাষার’ও শতচ্ছিন্ন অবস্থা হয়ে যেত এতদিনে। জফির সম্পর্কে ফিরতে চেয়ে এত কথার অবতাড়নার কারণ তাকে কোন অভিধায় অভিষিক্ত করব? ইউরোসেন্ট্রিক কবিকে আমরা তৃতীয় কাব্যগ্রন্থের পর ভারতীয় সভ্যতার আলো বাতাসে পদচারণা করতে দেখি―দেখি নিজেকে আবিষ্কারের পথে তৃতীয় বিশ্বের দিকে অভিমুখ। তাঁবুর নিচে দূতাবাস (২০১১) কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতায় লিউপল সেদার সেঙ্গরের কবিতার মতোই তৃতীয়বিশ্বের কোনো এক মা; যেন আমার মায়ের আত্মযন্ত্রণার ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন ‘দুধগাছ’-এ।

‘দুধগাছ আমার মা/ না-হলে বাবা কী করে আমাদের/ এই বনের ভেতর পেলে-পুষে মানুষ করলেন/ নাঙ্গা সময়ের নিচে শিশুদের ভাতের জোগাড় ছিল না/ জন্মেছি রোগা-পটকা আমরা ন ভাইবোন/ মা ছিল হাড়-জিরজিরে কিন্তু বুকভরা দুধ/ আমরা ন ভাইবোন স্তন চুষে স্তন্য খেয়ে/ দুধের ফেনায় পুড়ে পুড়ে মা আমার ধনুক আর/ শস্যের দেবী হয়ে গমখেতে ধানখেতে সূর্যালোক হয়ে জ্বলে/ ফলবতী মাটিতে বিষণ্ন লাল ফুল হয়ে ঝরে/মা আমার চিরহরিৎ, অন্নপূর্ণা/ বাবা বিষগাছ-করুণ ওষধি।’

সত্যি তো ধ্বংস আর নির্মাণের মাঝে দাঁড়িয়ে কীভাবে জয়নুল আবেদিন তাঁর দুর্ভিক্ষের ছবিগুলি এঁকেছিলেন―আজ যা ঔপনিবেশিক শাসকদের শোষণের সর্বশেষ দলিল। আমাদের কাছে সংরক্ষিত এমন কবিতা তো কমই পাই যেখানে ‘দুধগাছ’ মা যেন গ্রাম বাংলার অনন্য প্রতিনিধি। যিনি আজকের সময়েও শস্যের দেবী হয়ে গমখেতে ধানখেতে সূর্যালোক হয়ে জ্বলছে; কি আশ্চর্য সব উপমা মা যেন ফলবতী মাটিতে বিষণ্ন লাল ফুল হয়ে এখনো ঝরে। মায়ের প্রতীকে চিরহরিৎ যে ভাস্কর্যের সন্ধান দেন সেখানে কিন্তু আন্তঃস্রোতে মাকে অন্নপূর্ণা হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থিত করেন আর সেখানে বাবা যেমন অক্ষম ‘বিষগাছ’ তেমনি আবার অপর পিঠে করুণ ওষধি।

এই যে চূড়ান্ত সত্য এই যে বৈপরীত্য এ যেন ঔপনিবেশিক শোষণের ফল কিংবা নারীকে পুরুষ থেকে একস্তরে নিচে অবস্থান করা জীব হিসেবে দেখা, সমাজকে আঘাত করা―তথাকথিত নারীবাদ নয়, এ কবির আপন অস্তিত্বের আকুতি মাকে-ভুবনঈশ্বরীর জায়গায়ই নয় শুধু, মাতৃভূমির অপার স্থানে দাঁড় করিয়ে যে চিত্রের মায়ায় উপস্থাপন করেছেন তা বাংলা কবিতার অনন্য সংযোজন বললে কোনোভাবে অত্যুক্তি হবে না। এ যেন বাংলা মা ‘মা ছিল হাড়-জিরজিরে কিন্তু বুকভরা দুধ/-এক কথায় তিন ফসলা খরাবন্যা পীড়িত মাতৃভূমির মতন।

এই বইয়ে ‘প্রতিকৃতি’ কবিতায় বন্ধু, শত্রু ও পরিজন নিয়ে অমৃত চরণ, তারই মায়া দেখি গান্ধারী এইসব হোমো স্যাপিয়েন্সে, মাঠাদের টিলা, দ্রৌপদী, খাজুরোহো অ্যাজটেক অহল্যায়। কবিতায় যেন যুদ্ধ, ঈর্ষা ও প্রেমের সারাৎসার লিপিবদ্ধ। ‘দুধগাছে’র মতো আর একটি কবিতা এই পর্বে আলোচনা করা অনিবার্য কবিতার শিরোনাম ‘আত্মীয়তা’

মা বলত তুই গঙ্গাফড়িং―দূর্বাদল তোর ঠিকানা
আজ আমি মায়ের কবরে সবুজ ছায়া দিই
বোন বলত তুই লাল সারস―প্রান্তর তোর নিত্যসঙ্গী
আজ আমি বোনের কবর পাখির পালকে ঢেকে রাখি
প্রেমিকা বলতো ঘাসের গন্ধে-ভরা তোমার সারাটা শরীর
আজ আমি তার কবরে আগুনমুখো ঘাস হয়ে জন্ম নিয়েছি।

জ্যাঁ আর্তুর র্যাঁবোর বীজমন্ত্র ইন্দ্রিয়বিপর্যয় dereglement de tous les sens) আঁরিও মিশোর―‘আত্মমগ্ন গোপনতা’ জীবনানন্দের জন্ম বৎসরে যে মিশোর জন্ম পল ক্লোদল ও স্যাঁ জন পার্সের গদ্যকবিতা বাইবেলীয়ও স্তোত্রধর্মী এদের কাছ থেকে কী বীজমন্ত্র নিয়েছেন জফির, তা আলোচনা সাপেক্ষে। কিন্তু জফির সেতু ফর্মের দিক থেকে হাঁটলেন লিপিকার রবীন্দ্রনাথ কিংবা অরুণ মিত্রের ‘অন্ধকার যতক্ষণ জেগে থাকের’ মতো করে নয়, অক্ষরবৃত্তের চালে, সকলকে আত্মস্থ করে নিজস্ব ভঙ্গিতে।

না পদ্যে না গদ্যে নিজস্ব স্বরের খোঁজে প্রত্ন রহস্যের খোঁজে ইন্দ্রিয় বিপর্যয়, আত্মমগ্ন গোপনতা নিয়ে প্রবেশ করলেন হরপ্পা মহেঞ্জোদারো সুমেরীয় সভ্যতার ভিতরে। ‘ঘোটকী দ্রাবিড়দের ময়ারানির মতো আজকের সমাজ বাস্তবতায় উপস্থাপন করলেন ভবিষ্যতের কবিতা রূপে ‘ঘোটকী’ মায়াবিনি প্রতীকে। যে আসলে আমাদের হাজার হাজার বছরের সাক্ষী, যার জীবানুক্রমিক ক্রমবিকাশ আরো দূর সময়ে গিয়ে সাক্ষ্য দেবে এই সময়ের বাস্তবতা সম্পর্কে। এই কবিতাগুলোতে জফির সেতু তো সেই স্বপ্নদ্রষ্টারই কাজ করেছেন টেড হিউসের ক্যালডার ভ্যালির মতো জফিরের জন্ম মেঘায়ের জৈন্তিয়া ভ্যালি যেন। তাই তো Cave Birds কিংবা Crowকে যেমন টেড প্রতীকায়িত করেন, তেমনি সিন্ধু অববাহিকার সেই প্রত্ন ঘোটকীকে আমাদের সামনে হাজির করেন জফির মায়াবাস্তবতায়।

ফরাসি কবি পিয়ের র‌্যভেরদিকে (১৮৮৯-১৯৬০) আলাদাভাবে নাও চোখে পড়তে পারে জফির সেতুর; তিনি স্যুররিয়ালিস্টদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে স্বীকৃত। কিউবিস্ট। কিউবিস্ট আন্দোলনে যিনি পিকাসো, হুয়ান গ্রি, জর্জ ব্রাক, অ্যাপোলিনের ও জাকভের সঙ্গী। যিনি ঘোষণা করেছিলেন সত্যিকারের কবিতা ‘ডানায় ভর দিয়ে উড়ে আসে, তাকে নির্মাণ করা অসম্ভব।’ স্যুররিয়ালিস্টদের এই মূলমন্ত্র থেকে যদিও সরে আসেন তিনি। পরে পাসকালের  আধ্যাত্মিকতা খুঁজে পাওয়া যায় যা আসলে আলোচিত কবির ব্যাপারে একদম বিরল। তবে সরাসরি ফরাসি থেকে চিন্ময় গুহের অনুবাদে একটি কবিতা এখানে পেশ করা যায়―

ঘোরদৌড়ের সময় সারা বিশ্ব সংসার টলছিল,
মনে হচ্ছিলো এই বুঝি ছাদটা ডান দিকে হেলে
আমাদের মাথায় এসে পড়বে; কিন্তু জানালাগুলো
লেগেই থাকলো আকাশে, আর রাত্তিরের দৃশ্য দেখা গেল।

ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একটা পেঁচাকেও আর দেখা
যাচ্ছিলো না, গাছ-গাছড়ার মধ্যে চাঁদের আলোও
আর নেই, কেবল কারখানার চিমনি আর চতুর্দিকে―
শুধু বাড়ি আর বাড়ি আর পেল্লায় ছাদ,
শোনা যাচ্ছিলো ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ সাগরের
রাতের অন্ধকারে তারা পৌঁছে দিচ্ছিলো
মৃত্যুর ধাতব চ্যাকরা পাড়ি

কোনো দূরান্বয়ী সম্পর্ক হয়তো ‘সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী’র কবিতা থেকে দেয়া যাবে, কিন্তু কবিতার যে ইঙ্গিতময়তা, কবিতার যে বিশ্বাস মহান কবিতা যে মৃত্যু... উপলব্ধি, ভিন্নরকম ব্যঞ্জনা যা মূলত জফির সেতুর কবিতার প্রধান বিবেচ্য বিষয়।

প্রধান অমোঘ শব্দ মৃত্যু কতভাবে চিত্রায়িত হয়েছে দেখা যাক সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী কাব্যগ্রন্থের ৪ নম্বর ৫ ও ১১ কবিতায়―

৪        তোমাকে প্রথম দেখি সন্ধ্যার ছায়ায়
          প্রার্থনার ভঙ্গিতে দেহখানি বেঁকে গেছে

আগন্তুক ঋতুর মতো তোমার সজ্জা ও পোশাক
ছোট্টবৃত্তে তুমি খেলা করে চলেছ বুনোশরীরে

পাইনের বনে যেভাবে বরফের বল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে
তোমাকে দেখা হলো মৃত মানুষের শহরে
স্মৃতিপূর্ণ নদীটির তীরে

সত্যিই তো মৃতমানুষের শহর সিন্ধুসভ্যতার সেই তিনহাজার খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দের শহরে কবি ‘ঘোটকীর’ প্রতীকে প্রেমিকাকে প্রার্থনার ভঙ্গিতে দেখেন সায়ংকাল অর্থাৎ সন্ধ্যার ছায়ায়। এক রোম্যান্টিক স্বপ্নবাস্তবের জগতে বুনোশরীর নিয়ে বাস্তব ঘোটকীর মতই ছোট্টবৃত্তে খেলা করে চলেছে―সে, সেই পাইন গাছের সারির আড়ালে যেখানে রবফের বল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে―এ আমাদের স্বপ্নের জগৎ, অচেনা জগতের সঙ্গে পরিচয় করাচ্ছেন কবি―এই মৃত মানুষের শহরে―কী আশ্চর্যভাবে মনের মধ্যে চিহ্ন করে এঁকে দেন ‘তোমাকে দেখা হলো মৃত মানুষের শহরে/ স্মৃতিপূর্ণ নদীটির তীরে’। এ যেন যে কোনো দেশের যেকোনো পাঠকের কবিতা করে তোলেন, আমাদের জফির সেতু; এখানেই তার পিয়ের র‌্যভেরদির মতো উচ্চারণ, এখানেই ফরাসি কবির সঙ্গে তার একান্ত অস্থানিক পরিব্রাজকীয়, বৈশ্বিক মিলন।

আমার পর্যটক চোখ ভাসছে বাতাসে
আর তুমি পাড়ি দিয়েছ নদী, পাহাড় ও নগর!
যারা মৃতদের পোশাক পরে ঘুরাফেরা করে
তাদের তুমি দূরস্পর্শী ভেবে আশ্রয় দিয়েছ
তারাই নাসারন্ধ্রে তোমার স্তনের মিষ্টি ঘ্রাণ নিয়ে
মদিরার অন্বেষণে লোকালয়ে, যুদ্ধক্ষেত্রে!

এক যে পর্যটক কবি যিনি আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন সেই সকল অভিশপ্ত মৃতদের যারা পবিত্র এই ঘোটকীর স্তন পান করছে; তাদেরকে মাতৃভূমির মতই প্রশ্রয় দিচ্ছে ঘোটকী দূরস্পর্শী ভেবে। অথচ তারো স্তনের মিষ্টি ঘ্রাণ নিয়ে আরো আরো দ্রাক্ষা মদিরার অন্বেষণে ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে, এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রে।

আমরা যদি ‘সিন্ধুদ্রাবিড়ের ঘোটকী’ কাব্যের শুরুর দুটি কবিতা পাঠ করি দেখতে পাবো ‘ঘোটকীকে’ প্রতীকায়িত মায়ায় প্রথমেই কবি বলেছেন মানুষের প্রথম প্রণয় জন্মেছিল তোমাকে দেখে―প্রণতি জানিয়েছিল! একদিন দক্ষিণের বাতাস আছড়ে পড়েছিল ময়দানের শ্যামদূর্বাঘাসে তুমি লাফিয়ে উঠেছিলে, তোমার গায়ের লোমও শিহরে―কেঁপে ওঠে/এই দৃশ্য দেখে মানুষের প্রথম আনন্দ ও আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছিল।’

এই যে একটি নিছক বন্যপ্রাণীকে মহিমাদানের মধ্যদিয়ে আনন্দ আর আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রে উপস্থাপন করা একজন মহৎ কবিই কেবল স্বপ্ন ব্যঞ্জনা আর শব্দের কুহকে সৃষ্টি করেন সব অসম্ভব সম্ভবকে মানুষের প্রথম আনন্দ ও আকাঙ্ক্ষার কথা বলে যে সৌন্দর্যের প্রকাশ তা অনন্য জফির দ্বিতীয় কবিতাতেই সভ্যতার অনন্য এক রূপায়ণ করেন―

একটা নদী গোপনে বলেছে তোমার কথা
বলেছে তোমার কেশর উল দিয়ে বোনা
...
আমাকে একটা জলের ধারা বলেছে নরম ভাষায়
সভ্যতার নগ্নতা তুমি বহন করে চলেছ নীরব-কটাক্ষে।

সত্যিই এই কবিতা পড়ার পর যতবার কোনো ঘোড়াকে দেখেছি ততবারই মনে হয়েছে―এই যে জিনবাহিত সেই ঘোড়া যে কিনা সিন্ধু সভ্যতার সেইসব দ্রাবিড় বীর হয়ে মায়া-আসটেক-মিশরের ফেরাউনের ঘোড়া মেসোপটেমিয়া হয়ে কল্পনা কুরুক্ষেত্রের অর্জুনের রথের মতো কখনো আলেকজান্ডার, কখনো সম্রাট বাবুর কখনো নেপোলিয়নকে বহনকারী সেই ঘোড়ার জন্মধাত্রী এই ঘোটকী নাকি? এ প্রশ্ন আমাদের?

যার চিবুকে লেগে আছে কান্নার দাগ
ভ্রাম্যমাণ মানুষের মতো যেই তুমি ধুতে গিয়েছ
প্রাচীন নদীটির পানি তখন বহুরঙে ছেয়ে গেছে।

এ যেন সেই ফোরাত কিংবা দজলা নদী-কারবালার কথা মনে পড়বে আমাদের হয়তো, আবার রবীন্দ্রনাথের মতো চেতনার রঙে ভিন্ন রং ধারণ করে প্রাচীন নদীটি হয়ে ওঠে চেনা নদী যেন। ৯ সংখ্যক কবিতায় দেখব―

তোমাকে প্রণয় জানিয়েছিল এক কৃষ্ণবর্ণ অশ্ব!
কিন্তু অতীতের প্রতি অদ্ভুত আকাঙ্ক্ষা তোমাকে
জাগিয়ে রেখেছে যেন তুমি এক কত্থকের দেবী
...
আর শ্মশানকালীর বিষ ও ভস্ম ভাসছিল এই পঞ্চশীল দেশে!

এই বর্ণ এই সেই ১৯৫৪ উদ্ভাবিত ভারতের জওহরলাল নেহরু ও চিনা প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই যে জোট নিরপেক্ষ বিদেশ নীতিতে স্বাক্ষর করেছিলেন সেই পঞ্চশীল নীতিতে এখন নাই কোনো দেশ। শ্মশানকালীর বিষও ভস্ম আমাদের জানান দেয় আজকে এই চুক্তি দুঃস্বপ্ন হয়ে গেছে ভারতবর্ষের মাটিতে। দূর কোন সভ্যতা থেকে আসা বিশেষ করে মরুভূমির বালি লেগে থাকা ঘোটকীর ঠোঁটে প্রণতি ও অন্ত্যোষ্টির চিহ্ন সমান্তরালভাবে এঁকে দেন যেন কবি। এই জমিন সেই সিল্করুটঘেঁষা হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর পাশের ভূমি, পাঞ্জাবঘেঁষা কিংবা সেই মরুভূমি আজ যা কিনা রাজস্থান নামে পরিচিত ভারতে। আপেলের কলি আসা গাছের পাশে আমরা মায়া-ঘোটকীকে দেখি বিমর্ষ, চাঁদজ্বলা রাতে এ আমাদের বাংলা ভূখণ্ডের পরিচিত দৃশ্য নয়, এ যে মহান ভারতবর্ষের সেই সকল স্থান। যেখানে কবিরই কেবল দেখা সম্ভব গভীর স্তব্ধতায় মায়াবিনী ঘোটকীকে, যে কিনা মৃত অরণ্যের ভিতর যেমন বাঘ উৎকর্ণ―থাকে তেমনি মৃত্যুকে হাতে নিয়ে একাকী দাঁড়িয়ে আছে সেই প্রণয়িনী। কবি অভিষিক্ত করেছেন তাকে―

তুমি তো সিন্ধুদ্রাবিড়ের মেয়ে/ তবে কেন এমন ক্লান্ত-ধ্বস্ত তামাটে দেহ আজ/ ভুলেছ তবে তোমার পিতাকে পৌরুষ ও হ্রেষাধ্বনি?

এই যে সভ্যতার প্রতীক হিসেবে আজো থাকে কবি কল্পনায় চাইছেন সেই পুনরুত্থান যা কিনা ঘোটকীর পায়ে এক দেখেছিল কবি স্বপ্নকল্প মৃগয়ার রাতে। কবি জানেন বিস্মরণের এই প্রহরেও স্বপ্নবোনা এই ঘোটকীর কপালে জ্বলছে রক্তবর্ণ রাজতিলক। এই যে কবির আশা নিয়ে বেঁচে থাকা, এই যে মহীয়সী হিসেবে রূপদান স্বপ্নের কোনো প্রাচীন সভ্যতার ঘোটকী প্রতীকে কোন নারীকে―এ যে নারীর ক্ষমতায়নের প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত। খুব কমই, প্রাচীন কিংবা আধুনিক কাব্যে এমন চরিত্রে বিন্যাস ঘটেছে শুধু ময়মনসিংহ গীতিকা ছাড়া―একইসঙ্গে একটি পশুকে মানবিক রূপে রূপদান এ আমরা দেখি। শামসেত তাবরেজীর সেই এগারো শতকের লেখায় পারস্য কবিতায় পাখির কথোপকথনে এবং টেড হিউসের কবিতায়। কিন্তু ঘোড়াকে প্রতীকায়িত না করে ঘোটকীকে প্রতীকায়িত করা মাতৃতান্ত্রিক সমাজ বাস্তবতাকে, নারীকে যথার্থ সম্মানের জায়গায় দেখার মধ্যে অনন্য এক কৃতিত্ব এই কবি দেখিয়েছেন মুন্সিয়ানার সঙ্গে, এই দীর্ঘ কবিতায়―চুয়াত্তরটি কবিতায় মূলত একটি কবিতা হিসেবে যদি দেখি তাতে বিশ্লেষণে সুবিধে হয় বটে আমাদের।

দীর্ঘকবিতায় যে দ্যোতনা, যে টান টান আন্তস্রোতে বয়ে যাওয়া বোধের ধ্বনি তা ভাষার নিরবচ্ছিন্ন অক্ষরবৃত্তের যোজনায় মানবীয় হয়ে ওঠে, যখন দেখি ‘তোমার লালচে চুলে কারা গেঁথে রেখেছে/ মানুষের পাঁজর ও হাড়, তুমি তার খবর রাখোনি।

...দীর্ঘভ্রমণের পর যখন স্নানকাতর হয়ে ওঠো তখন। এই যে পরাবাস্তব ভ্রমণ এই যে ঘোটকীকে চুলে গেঁথে থাকা মানুষের পাঁজর ও হাড় যেন সত্যি সত্যি পাঠকের কষ্ট কল্পনায় চিত্রময়তা যেন নয়, এ যেন প্রত্নঘোটকীর জন্য সত্যি বাস্তব করে তোলেন জফির, এখানেই নিজের সঙ্গে নিজে লড়াইয়ে জিতে থাকেন কবি। আর সত্যি যখন তিনি ঘোটকীর চোখের ভেতরে একটি চেরির বাগান দেখান, দেখি ট্রয়ের সেই নারীকে যিনি আলুথালু ঘুরে বেরিয়েছে দেশ থেকে দেশে তখন হেলেন কিংবা কাসান্দ্রাকে কিন্তু মনে পড়ছে না, এ যেন কোনো ভারতবর্ষীয় নারীই যেন। মহাকালের বিচ্ছুরিত আলো যার চোখে সে তো অন্য কেউ যার শরীরে নীলকান্তমনি সে এই ভূখণ্ডের কেউ না হয়েও যেন প্রত্নরহস্যের সেই পিতামহী যার প্রতি পাঠকের আকর্ষণও দুর্নিবার। স্পষ্ট করে কবি বলছেন ‘তোমার পূর্বপুরুষরা এসেছিল পশ্চিম দেশ থেকে/তাই তুমি পূর্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে চাও আজ!/তোমার রক্তে শুধু গ্রিস-রোম আর ব্যাবিলনের নেশা।

সত্যিই তো ঘোটকীর জন্ম মরুদেশে এমন পাললিক ভূমিতে নয়, তবু কবি বলছেন এখানে তুমি থেকে যাবে জানি এই যে শান্তিপ্রিয় আমার ভূমি, এখানে থেকে যাবে ঘোটক যতই কাঁদুক হ্রেষাধ্বনি করে।

আম্রপালির পৌরাণিক কাহিনি জানি, প্রাচীন ভারতে বৈশালী নগরের (বর্তমান বিহার রাজ্যের তিরহুত) সৌন্দর্যের সঙ্গে রাজনর্তকী আম্রপালির দুর্দান্ত সকল গল্প আছে, যা জৈন ধর্মের মহাবীরের সময়কালে প্রচলিত ছিল। সেই আম্রপালির নামেও ঘোটকীকে দেখতে পায় কবি আম্রবর্ণপথে। কখনো চাবুকের নিচে যজ্ঞযাত্রাকালে ঠেলে দিয়েছিল আবার কখনও যজ্ঞের অগ্নিকুণ্ড থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছে ঘোটকীকে। কী দারুণভাবে স্বপ্ন ঘোটকীকে প্রতিস্থাপন করেন আজকের বাস্তবতায় ‘তোমার চোখে এত শিহরন তবু ভ্রু-ভঙ্গিতে/ অতীতের মৃত্যু ও বিচ্ছেদ লেগে আছে। আসলে প্রতিটি মানুষ প্রতিটি মুহূর্তে বহন করেই চলে মৃত্যু, বিচ্ছেদ আর আনন্দের হ্রেষাধ্বনি―যা জফির বারবার আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেন, সৌন্দর্যের বর্ণনায় আমরা দেখি ঘোটকীর স্তনে টিউলিপ ফুলের সমারোহ, কিন্তু যখন তিনি ‘নিঃশঙ্ক আর টকটকে লালের কথা বলেন তখনই এই লালে দুধের ধারা বইতে দেখলেও অবচেতনে রক্তের ঘ্রাণও নাকে লাগে যেন।

আমরা স্পষ্টই যেন বুঝতে পারি জফির গ্রিক, রোমান আর ভারতীয় পুরাণ একাকার করে ভিন্নমাত্রা দিয়েছেন―

তোমার শ্যামউরুতে উরু সংযোগ করেছিল ট্রয়যুদ্ধ
যেই হেক্টর, কুরুক্ষেত্রে সেই একই অভিমন্যু ও অর্জুন

এরপরে পঙক্তিতেই বলেন―‘তোমার নাভিতে আমার প্রণয়ের চিহ্ন লেগে আছে’―এই যে পৌরাণিক সময়কে পৌরাণিক যোদ্ধাদের প্রণয়ের মহার্ঘ্য দিয়ে আজকের করে তোলা―নিজেকেও একই সারিতে দাঁড় করানোকেই তো বলব সমকালীনতা জীবনের বিচিত্র সংজ্ঞার মধ্যে নতুন এক জীবনভাবনা, আলতামিরা গুহায় তোমাকে এঁকেছিল এক নিয়ানডার্থাল পুরুষ/ তার জায়গায় আজ আমি যাযাবর মানুষ! শিখেছি তোমার কাছে/ হে ঘোটকী, প্রতিটি জীবন আসলে একটি অপরটির মতো!’

নদী যদি সায়ংকালে দুঃখ হয়, তার নামও মধুরা। কী সুন্দর করে আর্য অনার্যদের ভেদাভেদ মুছে ফেলেন―‘জাভানারীর গর্ভে তোমার জন্ম হয়েছে কি হে আর্য-অনার্যের দুহিতা?’ নিজেকে কিরাঞ্জন, প্রাকৃত পুরুষ হিসেবে আস্থায় রেখে পদ্মার মাছের কাছে পৌঁছে দিয়েই আবার যোজনগন্ধ্যা সভ্যতার কাছে পৌঁছে যান এবং আবিষ্কার করেন নিজেকে কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ  রূপে... নিজেকে, এ যে প্রকৃত কবিরই অহং।

প্রণয়িনীর মতো করে কখনো সুজাতা, কখনো বিদর্ভের রমণী, ভূমিকন্যা বেহুলা আবার দ্রৌপদী, জানকী ভেবেছেন, যাকে পট্টবস্ত্র ও ফিনফিনে মসলিনে সাজিয়ে দেখেছেন যদিও ট্রয় সুন্দরীর সহচরী হিসেবেও ঘোটকীকে কবি―প্রাণেশ্বর স্থান দিয়েছেন তার চরণে। জীবনানন্দের নরম নদীর দেশেও শ্যামাতন্বী শরীরের এই সিন্ধুকন্যাকে কবি ৫১ নম্বর কবিতায় নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করেছেন, ‘বলো রক্তজবা কুমারী, যজ্ঞের মেয়ে, আমাকে ভালোবাসো? ভালবাসার কাঙ্গাল প্রতিটি হৃদয়ের খোঁজ জানেন প্রকৃত কবি, আসলে কি জানেন? এই প্রশ্ন চিরায়ত, জফির যখন কাঠগড়ায় দাঁড় করান ঔপনিবেশিক শ্বেতাঙ্গদের, তখন আত্মপরিচয়ের খোঁজে আমরাও যেন তার কণ্ঠে বলে উঠি―

আমার মাকে তুলে নিয়ে গেছে জলদস্যু আর বাবাকে ফাঁসিকাষ্ঠে/ ঝুলিয়েছে শ্বেতাঙ্গ দানব! শবাক্রান্ত মহাদেশে এসেছি মাকে খুঁজতে/ আমাকে হত্যা করতে চাও? হে ঘোটকী/ যজ্ঞযাত্রায় মস্তক খণ্ডিত/ করবে আমার ও যখন দাঁড়িয়েছি তোমার যাত্রা ও ঋদ্ধির পথে।

এই যে মাকে খুঁজতে বের হওয়া এ যেন জন্মভূমির নিজস্ব ইতিহাস ঐতিহ্যের খোঁজে, যে ঘোটকীকে এতক্ষণ কবি প্রেয়সী ভেবেছেন তাকে শোষকের স্থানে বসিয়ে আপন অস্তিত্ব জানান দিচ্ছেন কবি ভিন্ন কাব্যগ্রন্থে।

মানুষ সম্পর্কীয় খোঁজ, গোপনসঞ্চারী যে মনুষ্য মন তাকে জানতে কী পেরেছে মানুষ নিজে বা এই ঘোটকী প্রতীকে, রূপকে বার বার পৃথিবীতে জন্ম নেয়া ঘোটকী। ‘যে কী-না প্রেম, সৌন্দর্য ও শক্তি দিয়ে গেছে আপন বাহুরেখা ধরে। কবি নিজেও নিজকে প্রশ্ন করেন―মানুষ সম্পর্কে? উত্তর খুঁজতে গিয়ে বলেন―‘মানুষ নিজেকে জানে ঈশ্বরের সন্তান যদিও/ পদ্মপাতা ফুঁড়ে তার জন্ম হয়েছে আর মুখে নিয়েছে কচ্ছপের দুধ!

এরপরই দেখি কী দারুণ চিত্রকল্পে লেখা সেই সকল সৌন্দর্য―

‘আমার পূর্বপুরুষেরা সূর্যের সুতো দিয়ে বুনত মানুষের জামা
যদিও চাবুকের আঘাতে তাদের শরীরে ফুটে উঠত রক্তিম ফুল!’

দারুণ এই মানুষি স্বপ্ন-কল্পনা, আনন্দ যন্ত্রণার ইতিহাস এই কাব্যগ্রন্থ, গৌতমবুদ্ধের নির্বাণ বা নির্জ্ঞানের পথে যাত্রাকে ভিন্ন বিক্ষণে তুলে ধরেন কবি। আমাদেরকে প্রশ্নের মধ্যে রেখে সচিত্র প্রতিবেদন দেন যেন প্রশ্ন-উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আমরা তার কবিতায় ধ্যানস্থ হই, এখানেই জফির সেতু অনন্য এবং আলাদা হয়ে ওঠেন তার সময় থেকে, এখানে মানুষ জন্মের বৈচিত্র্যের উৎস সন্ধানে আবার ফিরে তাকাই নিজের দিকে, প্রশ্ন করি গৌতম কি সমাজ, রাষ্ট্র থেকে পালিয়েছিলেন তাহলে? দারুণ প্রশ্নের মুখে রাখেন কবি―

‘ঘোটকী’ সেই প্রতীকি মহাকালের দেবীকা আগামী কালেও যিনি বর্তমান চেতন অবচেতনে-জাগ্রত থাকতে চায়...

‘তুমিও কিন্তু বুদ্ধের মতো? নির্জ্ঞানের পথে নিজেকে করোনি ঘোষণা
আত্মরক্ষার খাতিরে বেছে নাওনি জামগাছের নিচের আসন ঘোরের?
কথা মনে করে বোঝেনি কি প্রেম ও সহানুভূতিই জীবনের আসল সত্য?
তুমি জেনেছিলে, মানুষ সহজে আত্ম-পরিত্যাগের বার্তা শুনতে চায় না
এমনকি মানুষ অনেক কিছুই বুঝতে পারে না/ বোধিবৃক্ষের লাল ফুল
ঝরে পড়ল তোমার ওপর আর তুমি ফিরে তাকালে যন্ত্রণায়
তলিয়ে যাওয়া মানুষের দিকে―আর চিৎকার করে উঠলে, কোন্দন্না জানে, কোন্দন্না জানে!
হে ঘোটকী, হরিণবাণ সেদিন আমিও স্রোতে প্রবেশকারীদের সঙ্গে ছিলাম।’

চেতন অবচেতনের এই ঘোটকীকে হতাশরে স্পষ্ট বার্তাও জানান দিচ্ছেন জফির। যুদ্ধ ও প্রেমের খবর দিতে গিয়ে ভূ-রাজনৈতিক উশৃঙ্খল-বিশৃঙ্খলতায় আপাতত মানুষের মুক্তি দেখতে পান না তিনি। তবুও আবার আলো জ্বালিয়ে করুণায় ও প্রেমে সমর্পণ করেছেন পাঠককেও নিজেকেও। কবি ভবিষ্যতের প্রেম প্রত্যাশী পৃথিবীর মায়ায় ঘোটকী রূপকে যেন ভালোবাসার সাম্পান হাতে অবতরণ করেন এই অববাহিকায় যা কিনা বাংলা কবিতার অনন্য সংযোজন হয়ে ইতিহাস হবে একদিন।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
তিন নম্বরে থেকে সুপার লিগে মোহামেডান
তিন নম্বরে থেকে সুপার লিগে মোহামেডান
মুখ থুবড়ে পড়েছে ইউক্রেনের অস্ত্র খাত
মুখ থুবড়ে পড়েছে ইউক্রেনের অস্ত্র খাত
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
লোকসভা নির্বাচন: মণিপুরে ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষ
লোকসভা নির্বাচন: মণিপুরে ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষ
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?