X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

দেবেশ রায় প্রসঙ্গে হাসান আজিজুল হক

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : চন্দন আনোয়ার
১৮ নভেম্বর ২০২১, ১৫:১৮আপডেট : ১৮ নভেম্বর ২০২১, ১৫:৩১

[দেশভাগোত্তর বাংলা  কথাসাহিত্যে যে দুজন কিংবদন্তিতুল্য কথাসাহিত্যিকের নাম প্রথমেই ওঠে তাঁরা হলেন : পশ্চিমবঙ্গের দেবেশ রায় ও বাংলাদেশের হাসান আজিজুল হক। দেশভাগের কারণে সীমানাগতভাবে দুজন দুদেশের অধিবাসী হলেও বাস্তবজীবনে ও লেখায় তাঁরা কোনো সীমানাকেই মানেন না। তাঁরা দুজনেই এক অখণ্ড বাঙালি আত্মপরিচয়ে বিশ্বাসী ও সেই বিশ্বাসের বিশ্বস্ত বাহক। দুই বাংলায় দুজনেই সমানভাবে সমাদৃত ও পঠিত।  সাহিত্যপত্রিকা ‘কঙ্ক’র দেবেশ রায় সংখ্যায় এই দুই জীবন্ত কিংবদন্তির সাহিত্যচিন্তার যোগসূত্র রচনার উদ্দেশ্যেই এই আলাপচারিতার আয়োজন। দেবেশ রায় সম্পর্কে হাসান আজিজুল হকের চিন্তার সূত্রসমূহকে মুদ্রিতরূপ দেবার উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গের কবি ও প্রাবন্ধিক সব্যসাচী দেব কিছু প্রশ্ন তৈরি করেন। এই প্রশ্নগুলোর আলোকেই হাসান আজিজুল হকের বাসভবন উজান, বিহাস, রাজশাহীতে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয়। সাক্ষাৎকার গ্রহণের তারিখ : ১৩ নভেম্বর ২০১২ সন্ধ্যা ৬টা হতে রাত ৯টা পর্যন্ত, এবং ১৪ নভেম্বর ২০১২, দুপুর ১২টা হতে ২টা পর্যন্ত।]

প্রশ্ন : দেবেশ রায় লেখালেখি শুরু ছোটগল্প দিয়ে, অজস্র ছোটগল্প লিখেছেন তিনি। তারপর একেবারেই সরে এসেছেন উপন্যাসের দিকে। এখন তাঁর ঝোঁক বৃহদায়তন উপন্যাস লেখার দিকে। এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
হাসান আজিজুল হক : এ রকম ঘটতেই পারে। ছোটগল্প দিয়ে শুরু এবং ছোটগল্প দিয়েই শেষ এমন লেখক পৃথিবীতে খুব বেশি নেই। দুটো একসাথে মিলিয়ে লেখকরা খুব স্বাভাবিকভাইে কাজ করতে পারেন। রবীন্দ্রনাথের বেলাতে প্রায় একইরকম ঘটনা ঘটেছে। তরুণ বয়সেই তিনি তাঁর বেশিরভাগ গল্প লিখে ফেলেছিলেন। তারপরে গল্পের সংখ্যা ক্রমাগত কমতে থেকেছে। অন্যান্য রচনার সঙ্গে উপন্যাসের দিকেই ঝুঁকে পড়েছেন, গল্প আর বেশি লেখেননি। আমি নিজেও গল্পই লিখে গেছি টানা। এখন দুএকটি উপন্যাস লিখছি এবং মনে হচ্ছে আপাতত আর গল্প লেখার দিকে যাওয়া হবে না। দেবেশ রায় অসাধারণ সব ছোটগল্প লিখেছেন। উপন্যাসের দিকে এখন বেশি ঝুঁকেছেন বেশি বটে, তবে সমান দক্ষতায় মাঝে মাঝে ছোটগল্পও লিখছেন এবং তা এতই স্বাভাবিক  যে, মনে হচ্ছে তিনি হঠাৎ করে উপন্যাসের দিক থেকে মন ফিরিয়ে ছোটগল্প লেখার দিকে আবার চলে যেতেও পারেন। একমাত্র বড় লেখকরাই এরকম পারেন। দুহাতে তরবারি চালানোর মতো। আরেক কারণ আন্দাজ করতে পারি, জীবনের অভিজ্ঞতাগুলি যত পরিণতির দিকে যেতে চায়, ততই সমগ্রতার দিকে লেখকের দৃষ্টি ফেরে। তখন  সমাজ-রাষ্ট্র-ইতিহাস একাকার হয়ে যায়। বাস্তব জগতের এক পরিপূর্ণ চেহারার সঙ্গে লেখাকে মিলিয়ে দেবার কঠিন কাজটা হাতে নিতে ইচ্ছে হয়। হয়ত দেবেশ রায়ের ক্ষেত্রে এমনটাই কিছু ঘটেছে। এখন তাঁর হাতের তালুতে গোটা বাস্তবতা।

প্রশ্ন : আপনি নিজে ছোটগল্প লেখক। আপনার কী মনে হয় উপন্যাসই দেবেশ রায়ের নিজস্ব জায়গা?
হাসান আজিজুল হক : গল্প-উপন্যাস দুটিই তাঁর নিজস্ব জায়গা। আলাদা করার কিছু নেই। দেবেশের গল্প দেবেশের ছোটগল্পের দাবিই পূর্ণ করে। উপন্যাসের সঙ্গে তাকে গুলিয়ে ফেলার কোনো অবকাশ নেই।

প্রশ্ন : ১৯৫৭ সাল নাগাদ দেবেশ রায়ের লেখালেখি শুরু। তখন তিনি যেসব গল্প লিখেছেন, যেমন, ‘অপরাহ্নের কান্না’ বা ‘আহ্নিকগতি ও মাঝখানের দরজা’ বা পরেও ছোটগল্পে তাঁর রাজনীতি প্রসঙ্গ আসেনি। অথচ তখনই তিনি ছাত্র আন্দোলনের কর্মী, সেখান থেকে রাজনৈতিক দলে এসেছেন। সেই গল্পগুলিতে মূলত মধ্যবিত্ত জীবনের মানসিক ঘাত-প্রতিঘাতই মূল উপজীব্য। সে গল্পগুলি সম্পর্কে আপনার কী অভিমত?
হাসান আজিজুল হক : একজন লেখকের লেখার বিষয়কে কি এভাবে আলাদা আলাদা কক্ষে ভাগ করে দেওয়া ঠিক হবে? সময়ের মধ্যে জীবনযাপনের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে লেখককে এগোতে হয়। অজস্র কারণে বিভিন্ন বিষয় তাঁকে অধিকার করে। তবে মনে হয়, জীবনের প্রথম পর্বে লেখকের অভিজ্ঞতা অনেক সতেজ থাকে। লেখাগুলিতেও যেন সেই সতেজতার ছাপ পড়ে যায়। ফোটার মুহূর্তে পদ্মের গন্ধের সঙ্গে পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্মগন্ধের তফাৎ আছে এবং নেই। আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলি, একেবারে প্রথম যৌবনে রাজনৈতিক আন্দোলনে বা ছাত্ররাজনীতিতে প্রবলভাবে জড়িয়ে পড়লেও শেষপর্যন্ত ও পথে সরাসরি হাঁটিনি। ওটা আমার ‘হোম’ হলো না। কিন্তু রাজনীতি-ছাড়া কখনো হলাম না। নিজের জায়গাটি ঠিক কী হবে, লেখক নাকি রাজনৈতিক নেতাকর্মী এসব তখন ঠিক হয়নি। চারপাশের জীবনই তখন ঝেঁপে আসছে লেখাতে। তার ছাপও পড়ছে। আমার আরো মনে হয়, এই সময়ে কথাসাহিত্যিক পরিণত বয়সের উপন্যাসের বদলে তীব্র একেকটি ছোটগল্পই লিখে ফেলেন। পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে মধ্যবিত্ত জীবনের ক্লেদ, গ্লান্তি, নির্বেদ, অন্তর্ঘাতী বিষ, জীবনযাপনের বিকার প্রবল হয়ে উঠেছিল। দেবেশের গল্প তখন এইসব বিষয়কে অবলম্বন করেছে। একেবারেই শুরু দিকের গল্প ‘অপরাহ্নের কান্না’ বা ‘আহ্নিক গতি ও মাঝখানের দরজা’। এরপরেও, এমনকি আজও এরকম গল্প দেবেশ যে লেখেননি বা লিখছেন না তা নয়। কিন্তু এর মধ্যে সেই প্রথম আলো পুরনো ও নিবিড় হয়ে এসেছে। গল্পের আঁটন-বাঁধন অনেক বেড়েছে। ভাষার হাল এখন শক্ত হাতে।

প্রশ্ন : শুরুর সেই সময়ে ‘কী বলব’ তার থেকেও দেবেশ রায় ও তাঁর অন্য সহযোগীদের প্রধান ভাবনা ছিল ‘কীভাবে বলব’। তাঁরা এক নতুন রীতির সূচনা করেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন, এই নতুন রীতি কি সত্যিই নতুন ছিল? আপনি কী মনে করেন?
হাসান আজিজুল হক : এই তর্কটা পুরনো। তর্কটা নানা তত্ত্বে রূপ নিয়েছে। আমার মনে হয় লেখকের কাছে মূল জায়গা এটা নয়। ‘কী বলব’ এটা অস্পষ্টভাবে হয়তো ঠিক করে নেওয়া যায় কিন্তু তা জ্যামিতির প্রতিপাদ্যের মতো নয়। তেমনি ‘কীভাবে বলব’ সেটাকে ‘কী বলব’ থেকে একেবারে আলাদা করে আগে থেকে ঠিক করে নেয়া যায় না। যাঁরা তা করতে চান, তারা ‘কী বলবা’র ক্ষতি করেন এবং ‘কীভাবে বলব’ সদ্য লেখকের কাছে এ বিষয়টা একটু বড়ো হয়ে দেখা দিতেই পারে। বিশেষ করে, যাঁরা শিল্প-সাহিত্যেও জাবরকাটা গতানুগতিকতায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। তারুণের নতুন দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে বদলে যাওয়া সময়কে ধরবার ক্ষমতা আর অবশিষ্ট নেই সাহিত্যের বুড়ো বাঘদের। তারা আর শিকার ধরতে পারছি না। এরকম জায়গা থেকেই মাতামাতি। আমার কাছে মনে হয় লেখকের কাছে এ ব্যাপারটা একেবারে লেখকেরই নিজস্ব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তবে একথা ঠিক, যদি কিছুই বলার না থাকে তাহলে ‘কী বলব’ লেখার একটা কসরতে পরিণত হতে পারে। পুরনো পরিচিত কথা যতই নতুন বোতলে  ঢোকানো যাক সে পুরনোই থেকে যাবে। আর ‘কীভাবে বলব’ সেটা অনেকটাই নির্ভর করবে নতুন কিছু বলবার কথা ভেতরে জমা হয়েছে কিনা তার উপর। এটাই শেষ পর্যন্ত ভাষা বা স্টাইল বা লিখনভঙ্গিকে নিয়ন্ত্রণ করে। লেখার জায়গাটা যদি শূন্য হয় তাহলে ভাষাও কোথায়-ও দাঁড়ায় না। কুয়োয় জল থাকলে তবেই তাকে হাজার পাত্রে হাজার রকম করে তোলা যায়। আমি জানি, এই তর্ক ষাটের দশকের গোড়াতে খুব প্রবলভাবে উঠেছিল। তাতে আমরা নতুন লেখা অনেক পেয়েছি। তার মানে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সময়নিয়ন্ত্রিত অথচ মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তনশীল সমাজ ও রাষ্ট্রের চেহারা দেখতে পেয়েছি। এই দিক থেকেই নতুনরীতি কথাটাকে বিচার করা প্রয়োজন।

প্রশ্ন : ১৯৬১ সাল থেকে উপন্যাস লেখার ভাবনা তাঁর মধ্যে কাজ করে, দেবেশ রায় নিজেই বলেছেন একথা। আর প্রায় তখন থেকেই তাঁর লেখায় রাজনৈতিক প্রসঙ্গ জায়গা করে নিতে লাগল। এই চাহিদাই কি তাঁকে ছোটগল্প থেকে উপন্যাসে সরে আসতে প্ররোচিত করেছিল?
হাসান আজিজুল হক : এই প্রসঙ্গ নিয়ে কিছু কথা তো একটু আগেই হয়ে গেল। আমি লেখকের লেখার জায়গাটাকেই বড় করে দেখতে চাই। ছোটগল্প থেকে সরে উপন্যাসে যাওয়া বা উপন্যাস থেকে সরে ছোটগল্পে আসা, এটা একজন লেখকের লেখার গোটা ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। দুটিকে আলাদা করে দেখা ঠিক কিনা জানি না। তবে উপন্যাসে পূর্ণতর জীবনবৃত্তান্ত আসে। সেটা হয়তো পরিণত বয়সেই সম্ভব হয়।

প্রশ্ন : প্রসঙ্গ থাকুক আর না থাকুক তাঁর সব লেখাতেই প্রচ্ছন্ন থেকে যায় এক রাজনৈতিক ভাবনা। আপনার কি তাই মনে হয়?
হাসান আজিজুল হক : লেখকের রাজনীতির ভাবনা আর রাজনীতিবিদ বা রাজনৈতিক নেতার রাজনীতি-ভাবনা একরকম নয়। দেবেশ রায় রাজনীতিকে জীবনের সমগ্রতা থেকে আলাদা করে নেননি। দুধের মধ্যেই ঘি থাকে, সেই ঘি আলাদা করে নেয় রাজনীতিবিদরা বা নেতারা–দেবেশ তা করেননি। সমাজ, রাষ্ট্র, গোটা পৃথিবী আর তার মধ্যে মানুষের জীবনযাপন–এর মধ্যেই রাজনীতি মিশে আছে। দেবেশ সেই সমগ্র দৃষ্টি থেকেই রাজনীতিকে দেখেছেন বলে আমার মনে হয়েছে। উপন্যাসে এটাই খুব স্পষ্ট হয়ে উঠে এসেছে। আলাদা প্রসঙ্গ হিসেবে রাজনীতিকে আনবার প্রয়োজন হয়নি।

প্রশ্ন : এই সূত্রেই আমাদের জিজ্ঞাসা, কোন লেখকের লেখায় রাজনৈতিক ভাবনা কীভাবে কাজ করা উচিত বলে আপনার মনে হয়?
হাসান আজিজুল হক : আমার কথাটা বোধহয় এর মধ্যেই বলা হয়ে গেছে। দেবেশের অল্প বয়সের ছোটগল্পগুলিকে পুরোপুরি রাজনীতি-ভাবনা মুক্ত এ কথা বলা যায় না।

প্রশ্ন : এক বিশেষ রাজনৈতিক দর্শন তাঁর বিশ্বাস, সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গেও তাঁর যোগ ছিল। এগুলি কোনোভাবে তাঁর লেখাকে সংকীর্ণ বা উদ্দেশ্যমূলক করে তুলেছে বলে আপনার মনে হয় কী
হাসান আজিজুল হক : না, তা মনে হয় না। বিশেষ রাজনৈতিক দর্শন বলতে এখানে কী বোঝানো হচ্ছে? বস্তুমূলক দ্বন্দ্ববাদী দর্শন? মার্কসবাদী দর্শন? দর্শন হিসেবেই তো তা এখন নানা তত্ত্বে শতধা-বিদীর্ণ। এটাকে প্রয়োগ করার বাস্তব চেষ্টা ইতোমধ্যেই তো কিছু কিছু রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ঘটে গেছে। তাতেও খানিকটা বোঝা গেছে যে, তত্ত্ব আর প্রয়োগে আকাশ-পাতাল পার্থক্য থেকে যাওয়া সম্ভব। তবে খুব বড় করে ভাবলে যদি রাজনীতিকে মানুষ নামের প্রাণীটিকে সমাজবদ্ধ, রাষ্ট্রবদ্ধ, পার্থিব বাস্তবতাবদ্ধ একটি অস্তিত্বের কথা ভাবা যায়, তাহলে সম্ভবত এই দেখাটাকে গ্রহণযোগ্য মনে হতে পারে। একেই লেখকরা তাদের নিজস্ব ছোট-বড় নানা বৃত্তে প্রকাশ করার চেষ্টার করেন। তাঁর সাহিত্যে ও রাজনীতির ব্যবহার দেবেশ রায় অনেকটা এভাবেই করেছেনে বলে আমার বিশ্বাস।

প্রশ্ন : একটি অপেক্ষাকৃত কম আলোচিত উপন্যাস ‘মানুষ খুন করে কেন’। ‘যযাতি’ থেকে ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’-তে পৌঁছানোর এক মধ্যবর্তী ধাপ এই উপন্যাস বলে মনে হয়। এই লেখাটি সম্পর্কে আপনার প্রতিক্রিয়া কী?
হাসান আজিজুল হক : লেখার পথে ক্রমশ এগিয়ে যাবার একটা ইতিহাস থাকে। তাতে জীবন-অভিজ্ঞতার কারণেই অনেক স্তর সৃষ্টি হয়। সহজ কঠিন হয়, সরল জটিল হয়, বাঁশ গাঁটে গাঁটে শক্ত হয়ে ওঠে। ছোট বৃত্ত বড় হয়ে যায়। সংক্ষিপ্ত তখন বিস্তৃততর হতে বাধ্য।
দেবেশ রায়ের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছে। তাঁর লেখার ধাপগুলির দিকে নজর দিলেই বোঝা যায়, সরলতা অর্জন করতে হয়। সেটা জ্ঞানের পথ–তারুণ্য পেরিয়ে, জটিলতার গ্রন্থিগুলিকে খুলে এই সরলতা একসময় অর্জিত হয়। দেবেশ রায়ের প্রথম দিকের গল্পগুলিতে, ‘যযাতি’ পর্যায়ের উপন্যাসে তাঁর ভাষা নিরাভরণ, নমনীয়, ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে’ থেকে শুধু অনুপুঙ্ক্ষ নির্মাণ নয়, ভাষাকে চাপ দেওয়া হচ্ছে অভিজ্ঞতা, ভাবনা, উপলব্ধির কণা-অনুকণা দিয়ে ভরাভর্তি হতে। ঘোর জটিল বাক্যের দেখা পাওয়া যাবে এই সময়ের রচনাতে। ভ্রূকূটি-কূটিল ঘনকালো মেঘ জমে ওঠার মতো। এর পরের ধাপেই পাওয়া যাবে মহাকাব্যিক নতুন উপন্যাসগুলি–তিস্তাপারের বৃত্তান্ত, তিস্তাপুরাণ ইত্যাদি। মাঝের ধাপটায় ‘আপাত শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে’।
দেবেশ রায় খুব বড় লেখক। অসম্ভব বিষয়-বৈচিত্র্য তাঁর মধ্যে। তাঁর আয়ুধ-এর সংখ্যা অনেক। সম্প্রতি তাঁর কাছ থেকেই আমরা উপন্যাস হিসেবে ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’ পেয়েছি।

প্রশ্ন : দেবেশ রায়ের মতো বড়ো মাপের সাহিত্যকের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার প্রয়োজন কতটা? অভিজ্ঞতা কি লেখাকে কখনো ভারাক্রান্ত করে তোলে বলে আপনার মনে হয়?
হাসান আজিজুল হক : অবশ্যই অভিজ্ঞতার প্রয়োজন তবে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ এই দুই রকম অভিজ্ঞতার উপর খুব বেশি জোর দেওয়া উচিত নয়। প্রচুর জটিল অভিজ্ঞতা থাকলেই কেউ লেখক হয়ে ওঠে না। লেখালেখিতে একটা প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। সে প্রক্রিয়াটার মাপ লেখকের অভিজ্ঞতার ধারণ ক্ষমতা, তাকে সমন্বয় বিশ্লেষণ করার নৈপুণ্যের উপর নির্ভর করে। এখানে দেবেশ রায় অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী।
অভিজ্ঞতার কারণেই লেখা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে বলে আমার মনে হয় না। সেটা নির্ভর করে লেখকের লেখার নিজস্ব প্রক্রিয়ার উপর। আমার মনে হয়, দেবেশ রায় চিত্রণের সাহায্যেই লেখাকে এগিয়ে নিয়ে যান। এত অনুপুঙ্ক্ষ নির্মাণ, এত যথাযথ হবার মরিয়া চেষ্টা, তাঁর লেখাকে খুবই জটিল করে তুলবে তাতে সন্দেহ নেই। তিনি আবার এসব কিছুরই সরাসরি চিত্রণ করতে ইচ্ছুক। সেটা কীভাবে সম্ভব? যা চোখে দেখা যায় বা ইন্দ্রিয় সরাসরি প্রত্যক্ষ করা যায় তাকে ভাষা দিয়ে চিত্রে আনা সম্ভব। কিন্তু দেবেশ তো শুধু সেখানেই থেমে থাকেন না, তিনি যে চিত্রণ করতে চান তাঁর ভাবনারও জগতটাকে যা কোনো ইন্দ্রিয় দিয়ে প্রত্যক্ষ করা যায় না। দেবেশ এই অসম্ভব কাজে লিপ্ত থাকেন। ভাবনার চিত্রণ, অনুভবের চিত্রণ, উপলব্ধির চিত্রণ, বোধের চিত্রণ! এত দায় কি ভাষা নিতে পারবে? ভাষাকে দিয়েই তিনি এই অসাধ্য সাধন করিয়ে নেবার চেষ্টার করেন। ফলে চিত্রণমূলক লেখার যে চমৎকার সুবিধা আছে, সেই সুবিধা দেবেশ রায়ের লেখা পড়তে গেলে পাওয়া যাবে না। ভাষাই যেখানে সীমা সেখানে ভাষার ওপারে যার অস্তিত্ব তার ভাষায়ন দৃশ্যমান করতে গেলে ভাষার উপরে যে খুবই জোর খাটাতে হয়। এজন্যই আমরা দেখি, লেখকজীবনে দেবেশ যতই এগোচ্ছেন ততই তাঁর লেখা ঘোর জটিল হয়ে উঠছে। সরল বাক্যও তাঁর সহজতার সীমানা পার হয়ে প্রায় অবোধ্য একটা জটিলতার দিকে চলে যাচ্ছে। কখনো কখনো মনে হয় দেবেশ রায়ের একে একটি বাক্য যা ধরতে পারে, তার অতিরিক্ত ভার নিয়ে অনেক সময় টলমল করতে থাকে। আমার নিজের ধারণা, এটাকেই হয়তো আয়েশি পাঠক ভারাক্লিষ্টতা বলে মনে করে।

প্রশ্ন : ইতিহাস ও সমকালীনতা দেবেশ রায়ের লেখায় কীভাবে কাজ করে? এগুলি কি আলগাভাবে লেগে থাকে না রচনার মধ্যে মিশে থাকে?
হাসান আজিজুল হক : সর্বভাবে মিশিয়ে দেবার ক্ষমতাই তো দেবেশ রায়ের লেখার বৈশিষ্ট্য। ইতিহাস ও সমকালকে এভাবে মেশানোর যে লক্ষ্য তা অনেকটা অনেক উঁচুতে ক্ষুধার্ত সিংহের খাদ্যের মতো। প্রাণীটি বার বার লাফ দিচ্ছে। প্রতি লাফে এক ইঞ্চি করে বেশি উঁচুতে উঠছে কিন্তু খাবারটা ধরতে পারছে না। লেখকরা এই রকমই চেষ্টা করেন। দেবেশও তাই করে থাকেন।

প্রশ্ন : আপনি ছোটগল্প লেখক। দেবেশ রায়ের সার্থকতা কোথায় বেশি–ছোটগল্পে না উপন্যাসে?
হাসান আজিজুল হক : এই কথার উত্তর যুক্তিহীন পক্ষপাতে চলে যাবে। দেবেশ রায়ের উপন্যাসগুলির মহত্ত্ব আমি স্বীকার করি। কিন্তু তাঁর ছোটগল্পই আমার বেশি প্রিয়। অনেক গল্প বাংলা ভাষার চিরস্থায়ী সম্পদ।

প্রশ্ন : একজন পাঠক হিসেবে দেবেশ রায়ের লেখায় আপনার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি কী?
হাসান আজিজুল হক : প্রাপ্তি অনেক, প্রত্যাশা অসীম!

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
পূজা শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত
পূজা শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত
জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করছে পুলিশ: আইজিপি
জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করছে পুলিশ: আইজিপি
তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর দাবি
তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর দাবি
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া