X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

মুখোমুখি : হারুকি মুরাকামি

অনুবাদ : আলভী আহমেদ
২৪ ডিসেম্বর ২০২১, ১১:০৩আপডেট : ২৪ ডিসেম্বর ২০২১, ১১:০৩

পূর্বপ্রকাশের পর

২০০৮ সালে দ্য নিউইয়র্কার ফেস্টিভ্যালে হারুকি মুরাকামি আসবেন—এই ঘোষণা দেওয়ার প্রায় সাথে সাথেই সে অনুষ্ঠানের প্রায় সব টিকিট বিক্রি হয়ে যায়। জাপান, কোরিয়া ও অস্ট্রেলিয়া থেকে তাঁর অসংখ্য ভক্ত উড়ে আসে তাঁকে সামনাসামনি একনজর দেখার জন্য। সাধারণত মুরাকামি কোনো পাবলিক ইভেন্টে অংশগ্রহণ করেন না। এ ব্যাপারে তাঁর বিতৃষ্ণা কখনো লুকোনোরও চেষ্টা করেননি। তাই তিনি যখন ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণ করতে রাজি হয়েছিলেন, তখন তাঁর ভক্তরা এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি। 

২০০৮-এর ঠিক ১০ বছর পর ২০১৮-তে মুরাকামি আবার নিউইয়র্কার ফেস্টিভ্যালে যোগ দিয়েছিলেন। দুবারই ওই পত্রিকায় কর্মরত ব্রিটিশ ফিকশন এডিটর ডেবোরাহ ট্রিজম্যানের অসংখ্য প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। নিজে থেকেই বলেছেন অনেক কথা, দিয়েছেন স্পর্শকাতর অনেক প্রশ্নের উত্তর। স্বভাবসুলভ সহজ ভঙ্গিতে। 

 

মুরাকামি : শেষবার আমাদের কথা হয়েছিল ঠিক ১০ বছর আগে। মাঝের এই বছরগুলোতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঘটেছে। যেমন, আমার বয়স ১০ বছর বেড়েছে। এ ব্যাপারটা আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে প্রতিদিন আমি একটু একটু করে বুড়ো হচ্ছি। নিজের সম্বন্ধে আগে যেভাবে ভাবতাম এখন আর সেভাবে ভাবি না। সম্ভবত এখন আমি একজন ভদ্রলোক হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছি। যদিও এটা মোটেই সহজ কাজ নয়।

একজন মানুষের পক্ষে একই সাথে ঔপন্যাসিক এবং ভদ্রলোক হওয়া খুব কঠিন। ধরুন, একজন রাজনীতিবিদ একই সাথে বারাক ওবামা ও ডোনাল্ড ট্রাম্প হতে চাইল—বিষয়টা অনেকটা সে রকম। ভদ্রলোক ঔপন্যাসিকের একটা সংজ্ঞা আমার জানা আছে। প্রথমত, তিনি কত টাকা ইনকাম ট্যাক্স দিচ্ছেন, তা নিয়ে কখনো কথা বলেন না। দ্বিতীয়ত, তার এক্স গার্লফ্রেন্ড বা এক্স ওয়াইফের গল্প লিখতে বসে যান না। তৃতীয়ত, তিনি নোবেল প্রাইজ ব্যাপারটা নিয়ে ভাবেন না।

সুতরাং ডেবোরাহ, শুরুতেই আপনাকে বলে রাখি, এই তিনটা ব্যাপারে আমাকে প্রশ্ন করা যাবে না। বিপদে পড়ে যাব।

 

ডেবোরাহ ট্রিজমান : আমার প্রশ্নের ঝুলি তো শুরুতেই আপনি ফাঁকা করে দিলেন... আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি বরং আপনার সর্বশেষ উপন্যাস ‘কিলিং কমেন্ডেটর’ দিয়ে প্রশ্ন শুরু করি। বইয়ে একটা লোকের কথা আছে, যার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যায়। তারপর সে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। শেষে গিয়ে থিতু হয় এক পেইন্টারের বাড়িতে। সেই বাড়িতে এসে ওঠার পরই শুরু হয় অদ্ভুত সব ঘটনা। একটা গর্ত থেকে সবকিছু শুরু—অনেকটা পরিত্যক্ত কুয়ার মতো মাটির গভীরে এক গর্ত। আপনার কাছে আমার প্রথম জিজ্ঞাসা, এ ধরনের একটা ব্যাপার আপনার মাথায় কী করে এল?

মুরাকামি : আপনি যে বইটার কথা বলছেন সেটা বেশ মোটাসোটা একটা বই। লিখতে আমার দেড় বছর লেগেছে। শুরুটা কিন্তু হয়েছিল ছোট ছোট দুটো প্যারাগ্রাফ দিয়ে। সে দুটো প্যারাগ্রাফ লিখে আমি আমার দেরাজের ড্রয়ারে রেখে দিয়েছিলাম। এবং একসময় ভুলেও গিয়েছিলাম ও ধরনের কিছু লিখেছি। তারপর হঠাৎ একদিন হলো কি, আমি বুঝতে পারলাম ওই প্যারাগ্রাফ থেকে আমি একটা গোটা উপন্যাস লিখে ফেলতে পারি। এবং প্রায় সাথে সাথেই লিখতে বসে গেলাম। এ ব্যাপারে আমার কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছিল না। কোনো রুটিন করিনি, স্টোরিলাইন বলে কিছু আমার মাথায় ছিল না। আমি লিখতে শুরু করলাম। এবং গল্পটা আমাকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গেল। আপনি যদি আগে থেকেই জেনে যান শেষে কী হবে, তাহলে সেটা লিখে মজা পাওয়া যায় না। আমি অন্তত পাই না। একজন পেইন্টার যখন কোনো ছবি আঁকেন তখন আগে স্কেচ করে নেন। কিন্তু আমার লেখার বেলায় সে নিয়ম খাটে না। আমার সামনে একটা সাদা ক্যানভাস থাকে। এবং কোনো ধরনের স্কেচ না করেই সেখানে আমি ব্রাশ ঘষতে শুরু করি। ছবিটা এঁকে ফেলি।

 

ট্রিজমান : উপন্যাসে একটা চরিত্র আছে। চরিত্র না বলে সেটাকে আইডিয়াও বলা যায়। মোজার্ট অপেরা ‘ডন জিওভানি’র  কমেন্ডেটরের আদলে তৈরি সেই আইডিয়া। এই যে আইডিয়া বা চরিত্র যা-ই বলি না কেন, এটা বইয়ের একদম কেন্দ্রবিন্দু কী কারণে?

মুরাকামি : সাধারণত যখন আমি একটা বই লেখা শুরু করি, সে বইয়ের টাইটেল কী হবে, তা আগে ঠিক করে নিই। এ ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তা-ই ঘটেছে। আমি প্রথমে মনে মনে ঠিক করে নিলাম, যে উপন্যাসটা লিখতে যাচ্ছি তার নাম হবে ‘কিলিং কমেন্ডেটর’। আমার হাতে মোটামুটি দুটো জিনিস রেডি ছিল। উপন্যাসের টাইটেল এবং প্রথম দুটো প্যারাগ্রাফ। আমি ভাবছিলাম এ দুটো জিনিস থেকে আস্ত একটা উপন্যাস কী করে টেনে বের করব? জাপানে কমেন্ডেটর বলে কিছু নেই। কিন্তু শিরোনামটা আমার কাছে বেশ অদ্ভুত মনে হয়েছিল। এবং এটা যে অদ্ভুত শুধু এ কারণেই আমার সেটা পছন্দ হয়ে গেল।

 

ট্রিজমান : ‘ডন জিওভানি’ অপেরা কি আপনার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ?

মুরাকামি : চরিত্রটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সাধারণত আমি লেখালেখির ক্ষেত্রে কোনো মডেল ব্যবহার করি না। পুরো লেখকজীবনে মাত্র একজনকে বেছে নিয়েছিলাম মডেল হিসেবে। বেছে নেওয়ার কারণ ছিল সে একজন খারাপ লোক এবং তাকে আমি খুব একটা পছন্দ করতাম না। তাকে নিয়ে আমি গল্প লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওই একবারই। আর কখনো এমন কিছু করিনি। আমার গল্প-উপন্যাসের চরিত্রগুলো আমি শূন্য থেকে তৈরি করি। একটা শারীরিক আদল দিই। তারপর তারা নিজে থেকেই হাঁটতে-চলতে শুরু করে। তখন আমার আর খুব বেশি কিছু করার থাকে না। চুপচাপ বসে থেকে ওই চরিত্রগুলো কী করছে, কী বলছে সে ব্যাপারটা কাগজে-কলমে লিখে ফেলতে হয়। সিম্পল।

আমি একজন লেখক—লেখাই আমার কাজ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যখন লিখি, তখন কিন্তু আমি একজন পাঠকেও পরিণত হই। মনে হয়, আমি খুব মজার এবং এক্সাইটিং কিছু পড়ছি। সুতরাং বলা যায়, লেখালেখি ব্যাপারটা আমি বেশ ভালোই উপভোগ করি।

 

 ট্রিজমান : উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র অপেরা শোনে। একই সাথে আরও অনেক মিউজিক পিস নিয়েও তার আগ্রহ আছে। আপনার চরিত্রগুলোর মধ্যে সংগীত নিয়ে এই আগ্রহের ব্যাপারটা বারবার এসেছে। দেখা যায়, তারা কোনো নির্দিষ্ট ব্যান্ড বা জনরার মিউজিক শোনে। এটা কি কোনোভাবে আপনাকে সাহায্য করে চরিত্রটি গড়ে তুলতে? তারা কোন মিউজিক শুনছে, এ থেকে কি আপনি বুঝতে পারেন আসলে তারা কারা?

মুরাকামি : আমি যখন লিখি তখন মিউজিক শুনি। তাই মিউজিক ব্যাপারটা আমার লেখায় খুব স্বতঃস্ফূর্তভাবে চলে আসে। কী ধরনের মিউজিক শুনব, সেটা নিয়ে কখনো খুব বেশি ভাবি না। তবে এ কথা সত্যি যে সংগীত হচ্ছে আমার কাছে খাবারের মতো। এই খাবারটা খেলে আমি লেখার শক্তি পাই। মিউজিক নিয়ে আমি প্রচুর লিখেছি। যে মিউজিকগুলো আমার বেশি পছন্দ, সেগুলো নিয়ে বেশি লেখা হয়। বলতে পারেন, এ ব্যাপারটা আমার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

 

ট্রিজমান : সংগীত তাহলে আপনার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী?

মুরাকামি : হ্যাঁ। সংগীত এবং বিড়াল। এ দুটো জিনিস আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।

 

ট্রিজমান : আপনার ঠিক কতগুলো বিড়াল আছে?

মুরাকামি : একটাও না। তবে প্রতিদিন সকালে যখন জগিংয়ে বের হই তখন রাস্তার ধারে তিন-চারটা বিড়ালের সাথে আমার দেখা হয়। তারা আমার বেশ ভালো বন্ধু। আমি দৌড়াতে দৌড়াতে থেমে যাই এবং তাদের হ্যালো বলি। তারা তখন গুটিগুটি পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসে। আমরা পরস্পর পরস্পরকে খুব ভালোভাবে চিনি।

 

ট্রিজমান : ‘দ্য নিউইয়র্কার’-এ আপনার ‘কিলিং কমেন্ডেটর’ থেকে কিছু অংশ ছাপা হয়েছিল। তখন আপনার কাছে আপনার লেখার অবাস্তব জিনিসগুলো সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। আপনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি যখন উপন্যাস লিখি, বাস্তব এবং অবাস্তব জিনিসগুলো খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের মধ্যে মিশে যায়। এমন না যে আমি এটা প্ল্যান করে করি এবং সেই প্ল্যানমতো লিখি। সমস্যা হচ্ছে, আমি যতই বাস্তব জগতের বিষয়গুলো বাস্তবসম্মতভাবে লিখতে চাই ততই অবাস্তব বিষয়গুলো লেখার মধ্যে ঢুকে পড়ে। বাধা দিলেও খুব একটা লাভ হয় না। আমার কাছে লেখালেখি হলো একটা পার্টির মতো। যে চায় সে পার্টি জয়েন করে—লেখার মধ্যে ঢুকে পড়ে। এবং যে থাকতে চায় না, সে পার্টি ছেড়ে বেরিয়ে যায়। জোরাজুরি নেই কোনো।’

কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, সেই পার্টিতে আপনি লোকজনকে আমন্ত্রণ কী করে জানান? অথবা এমন কিছু কি ঘটে যখন চরিত্রগুলো আপনার আমন্ত্রণ ছাড়াই পার্টিতে চলে আসে? মানে হুট করে কেউ এসে নিজেকে উপন্যাসের চরিত্র বলে দাবি করে? তখন আপনি কী করেন? 

মুরাকামি : পাঠকেরা আমাকে প্রায়ই বলে আমার লেখার মধ্যে এক অবাস্তব জগৎ আছে। আমার তৈরি চরিত্রগুলো বাস্তব জগৎ থেকে সেই জগতে ঢুকে পড়ে, আবার প্রয়োজন মনে করলে বেরিয়ে যায়। সমস্যা হচ্ছে, এই বাস্তব ও অবাস্তব জগতের সীমারেখাটা আমি বুঝতে পারি না। আমার ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো সীমারেখা আসলে নেই।

জাপানে অন্য একটা সমান্তরাল দুনিয়া বাস্তব দুনিয়ার খুব কাছাকাছিই আছে। এবং আমরা যদি চাই সেই দুনিয়ায় ঢুকে যেতে পারি। সেটা খুব একটা কঠিন নয়। তবে পশ্চিমা জগতের কথা আলাদা। সেখানে এক জগৎ থেকে আরেক জগতে ঢুকে যাওয়াটা একটু কঠিন। এ কাজের জন্য সেখানে আপনাকে প্রচুর চেষ্টা করতে হবে। জাপানের ক্ষেত্রে বিষয়টা হচ্ছে, আপনি চাইলেই যেতে পারবেন। কোনো সমস্যা নেই। আমার গল্পে, চরিত্রগুলো যখন কুয়োর তলায় নেমে যায়, তারা নতুন দুনিয়ায় পৌঁছে যায়। এতে তাদের তেমন কোনো সমস্যা হয় না। এবং তারা যে অন্য কোনো দুনিয়ায় এসে পৌঁছেছে, এ ব্যাপারটাও তারা বুঝতে পারে না।

 

ট্রিজমান : অন্য দুনিয়াটা কী রকম? সেটা কি খুব অন্ধকার কোনো জায়গা? 

মুরাকামি : জরুরি নয় যে অন্ধকার হতেই হবে। তবে সে জায়গাটা নি:সন্দেহে কৌতূহল উদ্দীপক। ধরা যাক, আপনি একটা দরজা দেখতে পেলেন। আপনার মনে যদি কৌতূহল জাগে দরজার ওপাশে কী আছে তা দেখব, তাহলে হয়তো আপনি দরজাটা খুলবেন এবং অন্য পাশে চলে যাবেন। এই কাজটাই আমি করি। আমার উপন্যাস লেখার রুটিন হলো, ভোর চারটার সময় বিছানা থেকে উঠে পড়ি, ডেস্কে গিয়ে বসি এবং লিখতে শুরু করি। সে সময় বাস্তব দুনিয়ার কী চলছে? সেখানে হারুকি মুরাকামি নামে এক লোক কফি খাচ্ছে।

কিন্তু যখন আমি লিখতে শুরু করি, কফি খাওয়া বাদ দিয়ে ওই দরজাটা খুলে আমি অন্য পাশে চলে যাই। এবং ওপাশে কী আছে, তা দেখতে শুরু করি। সত্যি কথা বলতে কি, দরজার ওপাশে ওটা কি বাস্তব নাকি অবাস্তব দুনিয়া, তা নিয়ে আমার একেবারেই মাথাব্যথা নেই। ওই দুনিয়ার একটার পর একটা লেয়ার আমি পার হতে থাকি, গভীরে যাই। যত গভীরে যাই, লেখায় মনোনিবেশ আমার জন্য সহজ হয়—তরতর করে লেখা এগোতে থাকে। যতক্ষণ ওখানে থাকি অদ্ভুত সব জিনিসের মুখোমুখি হই। কিন্তু যখন দেখি তখন কিন্তু সেগুলোকে আমার একেবারেই অদ্ভুত মনে হয় না। মনে হয়, এটাই স্বাভাবিক।

আপনি যে জানতে চাইলেন, ওই জগতে অন্ধকার আছে কি না . . . হ্যাঁ, অন্ধকার হয়তো আছে। কিন্তু সে অন্ধকার হেঁটে হেঁটে আমার কাছে আসে। সে আমাকে কিছু একটা মেসেজ দিতে চায়। আমি সেই মেসেজটা মুঠো পাকিয়ে ধরার চেষ্টা করি। সেই জগতের চারদিকে তাকাই এবং যা দেখতে পাই, তা মনে রাখি। বাস্তব জগতে ফিরে আসার পর সেগুলো লিখে ফেলি। এই ফিরে আসাটা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি ফিরে আসতে না পারেন, পুরো ব্যাপারটা ভয়ংকর রূপ নিতে পারে। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি একজন প্রফেশনাল, ফিরে আসতে সমস্যা হয় না কোনো। 

 

 ট্রিজমান : সে সময় কি আপনি সাথে করে কিছু নিয়ে আসেন?

মুরাকামি : না, সে চেষ্টা করাটাও ভয়ংকর। দরজার ওপাশে যা আছে, তা ওদিকে থাকাই ভালো। সেগুলো আমি ধরার কোনো চেষ্টা করি না। যখন লিখি না, তখন কিন্তু আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ। রুটিন মেনে চলা আমার স্বভাব। আগেই বলেছি, আমি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠি। টিভিতে বেসবল খেলা না থাকলে রাত নয়টার মধ্যে ঘুমিয়ে যাই। আমি দৌড়াই এবং সাঁতার কাটি। আবারও বলছি, আমি খুব সাধারণ একজন লোক। মাঝেমধ্যে রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় কেউ একজন আমার নাম ধরে ডাকে। বলে, ‘এক্সকিউজ মি, মিস্টার মুরাকামি। আপনাকে দেখে খুব ভালো লাগছে।’

তখন আমার খুব অবাক লাগে। আমাকে দেখে অচেনা-অজানা একটা মানুষের কী কারণে ভালো লাগবে? সমস্যাটা কী? আমি কি বিশেষ কেউ? হ্যাঁ, যখন আমি লিখি তখন আমি অবশ্যই স্পেশাল। অথবা অদ্ভুতও বলা যায়।

 

ট্রিজমান : ৪০ বছর আগে বেসবল খেলা দেখতে গিয়ে হঠাৎ করে আপনার মনে হলো আপনি একটা উপন্যাস লিখবেন—এ গল্প আমরা অনেকবার শুনেছি। আপনি আপনার আত্মজীবনীমূলক বই ‘হোয়াট আই টক অ্যাবাউট হোয়েন আই টক অ্যাবাউট রানিং’-এ বলেছেন, ‘মনে হলো, আকাশ থেকে কিছু একটা ভাসতে ভাসতে আমার সামনে এল এবং আমি টুপ করে তা মুঠোবন্দী করলাম।’ ওই কিছু একটাই হলো লেখার ক্ষমতা। আপনার কি মনে হয়নি, ওই কিছু একটা সেদিন কেন এসেছিল আপনার কাছে? আপনার ভাষ্যমতে আপনি স্পেশাল কেউ নন। খুব সাধারণ একজন মানুষ। আপনি যদি সে রকম সাধারণ মানুষই হতেন তবে ওই কিছু একটা এত লোক থাকতে আপনার কাছে কেন আসবে?

মুরাকামি : এটা এপিফানির মতো—ঐশ্বরিক। 

 

ট্রিজমান : সেটা ছিল ৪০ বছর আগের কথা। এরপর লেখালেখি নিয়ে আপনার ভাবনা কি কখনো পরিবর্তন হয়েছে? হলে সেটা কীভাবে? 

মুরাকামি : এখন আমি অনেক বদলে গেছি। যখন লেখা শুরু করেছিলাম, জানতামই না কীভাবে লেখে। খুব অদ্ভুত একটা প্রক্রিয়ায় আমি লিখছিলাম। সে গল্প আমি বিভিন্ন জায়গায় বলেছি। যা-ই হোক, মানুষ কিন্তু আমার লেখা পছন্দ করেছিল। সত্যি কথা বলতে কি, প্রথম বই মানে ‘হিয়ার দ্য উইন্ড সিং’ নিয়ে এখন আর খুব বেশি উৎসাহ নেই আমার। মাঝেমধ্যে মনে হয়, তখন আমি একটু তাড়াহুড়ো করে ফেলেছিলাম। বইটা প্রকাশ করার জন্য ওটা সঠিক সময় ছিল না।

বেশ কয়েক বছর আগের একটা গল্প বলি। আমি ট্রেনে বসে ছিলাম টোকিওতে। একটা বই পড়ছিলাম। তখন খুব সুন্দরী এক তরুণী আমার সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, ‘আপনি কি মিস্টার মুরাকামি?’

 আমি উত্তর দিলাম, ‘হ্যাঁ। আমি।’

‘আমি আপনার লেখার খুব ভক্ত।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ। জেনে ভীষণ ভালো লাগল।’ 

‘আপনার কোন বইটা আমার সবচেয়ে পছন্দ জানেন? প্রথম বই, ‘হিয়ার দ্য উইন্ড সিং’। ওটাই সেরা বই আপনার।’

‘তাই মনে হয় আপনার!’

‘জি। এবং ওই লেখাটার পর থেকে দিন দিন আপনার লেখা খারাপ হচ্ছে।’

মেয়েটা আমার সমালোচনা করল। সেই সমালোচনায় আমি একমত হতে পারিনি। আমি বিশ্বাস করি না দিন দিন আমার লেখা খারাপ হচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম, আমি উন্নতি করছি। ৪০ বছর ধরে একটু একটু করে উন্নতি করার চেষ্টা করছি। এবং সম্ভবত সে কাজটা আমি করতে পেরেছি।

 ট্রেনের ওই মেয়েটা আমাকে এক জ্যাজ শিল্পীর কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল। তার নাম জিন কুইল—পঞ্চাশ-ষাটের দশকে স্যাক্সোফোন বাজিয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন। তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন আরেক বিখ্যাত জ্যাজ স্যাক্সোফোনিস্ট চার্লি পার্কারের মাধ্যমে। এক রাতে জিন কুইল নিউইয়র্কের এক জ্যাজ ক্লাবে পারফর্ম করলেন। মঞ্চ ত্যাগ করার ঠিক আগমুহূর্তে এক যুবক তার দিকে এগিয়ে এল এবং বলল, ‘আপনার তো কোনো নিজস্বতা নেই। আপনি দিনের পর দিন চার্লি পার্কারের মতোই বাজিয়ে যাচ্ছেন।’

জিন থমকে গেলেন। বললেন, ‘কী বললেন আপনি?’

‘বললাম, আপনি চার্লি পার্কারকে নকল করছেন।’

জিন কুইল তখনই তার হাতের অলটো স্যাক্স ওই যুবকের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে। আপনি না হয় আমাকে ওই চার্লি পার্কারের মতোই একটু বাজিয়ে শোনান। কাজটা যেহেতু সহজ, আপনি নিশ্চয়ই পারবেন।’

 এই ঘটনা থেকে আমরা তিনটা বিষয়ে ধারণা পাই। এক, সমালোচনা করা সহজ। দুই, মৌলিক কিছু সৃষ্টি করা আসলেই খুব কঠিন। এবং তিন, মৌলিক জিনিস সৃষ্টি কঠিন হলেও কাউকে না কাউকে কাজটা করতে হবে।

আমি ৪০ বছর ধরে তিন নম্বর কাজটা করার চেষ্টা করছি। এরপরও কেউ যদি আমাকে দুঃখ দিয়ে কিছু বলে, আমি জিন কুইলের মতো আমার ইন্সট্রুমেন্ট ওই লোকের হাতে দিয়ে বলব, ‘ভাই আপনি না হয় একটু বাজিয়ে শোনান।’ 

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
৩ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না কয়েকটি এলাকায়
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক