X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

স্বপ্ন ছিল তারেকের নামে জাদুঘর হবে

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : মোস্তাক খান
১৩ আগস্ট ২০২২, ০৬:২১আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০২২, ০৮:২২

[পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার, লেখক এবং গীতিকার তারেক মাসুদের জন্ম ৬ ডিসেম্বর ১৯৫৬, ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার নূরপুর গ্রামে। তার নির্মিত সাড়াজাগানো চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘মুক্তির গান’, ‘মাটির ময়না’, ‘আদম সুরত’, ‘রানওয়ে’ অন্যতম। মাটির ময়না (২০০২)-এর জন্য তিনি ২০০২-এর কান চলচ্চিত্র উৎসবে ডিরেক্টরস ফোর্টনাইটসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। তার পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র সোনার বেড়ি (১৯৮৫) এবং পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র রানওয়ে (২০১০)-এর জন্য ২০১২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে। ‘কাগজের ফুল’ চলচ্চিত্রের শুটিংয়ের লোকেশন নির্বাচন শেষে গাড়িবহর নিয়ে ঢাকায় ফেরার সময় সড়ক দুর্ঘটনায় ২০১১ সালের ১৩ আগস্ট মারা যান। তার রত্নগর্ভা মা  নূরুন্নাহার মাসুদের সঙ্গে শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিসহ নানান বিষয়ে কথা বলেন মোস্তাক খান।]

কেমন আছেন?
নূরুন্নাহার মাসুদ : ভালো আছি। আল্লাহ ভালো রেখেছেন। 

তারেক মাসুদ বিশ্বনন্দিত চলচ্চিত্রনির্মাতা। আপনার কাছে এটা কেমন লাগে?
নূরুন্নাহার মাসুদ : আমার তারেককে একদিন বিশ্ব চিনবে আমি জানতাম। মা হিসেবে আমার গর্ববোধ হয়।

তারেক মাসুদ ছোটবেলায় মাদ্রাসায় পড়তেন। পরবর্তীতে চলচ্চিত্রে এলেন। এটা কিভাবে হলো?
নূরুন্নাহার মাসুদ : আসলে ওর বাবা ধার্মিক মানুষ ছিলেন। তার আগে তিনিও গান-বাজনা করতেন। কিন্তু হঠাৎ কি হলো, মনই পাল্টে গেল। আল্লাহর পথে চলে গেল। তাবলিগে তাবলিগে থাকত। তখন শরিয়তের নিয়মে সব চালাইত। সব ছেলেকেই মাদ্রাসায় ভর্তি করেছিল। কিন্তু মাদ্রাসায় তারেকের মন বসত না। পরে ঢাকা লালবাগ মাদ্রাসায় ভর্তি করাল। ওর বাবা বিদেশে যাইত তাবলিগে, এসে মাদ্রাসায় খোঁজ নিত। দেখত তারেক মাদ্রাসায় নাই। ওর চাচার বাসায় চইলা যাইত। তারা আবার আধুনিক ছিল। তাদের কাছে থাকতে তারেকের ভালো লাগত। এইভাবে মাদ্রাসা থেকে চলে যেতে দেখে তারেকের বাপ ওরে বাহিরদিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করল। তারপর তো যুদ্ধ লাগল, মাদ্রাসা ছুটি হলো। আর মাদ্রাসায় যায়নি। তারপর ওর বাপেরও মন নরম হলো, কৃষ্ণ স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে দিলো। পরে স্যারের কথামতো ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে ভালো পাস করল। ওর চাচাতভাই শানু, সে ওর মেধা দেখে ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে ভর্তি করল। এভাবেই ধীরে ধীরে চলচ্চিত্রে ঢুকে গেল।

তারেক মাসুদ যে চলচ্চিত্রে প্রবেশ করল, বাবা নিশ্চয় সেটা পছন্দ করতেন না। আপনি কি বাধা দিতেন?
নূরুন্নাহার মাসুদ : আসলে আমি তারেকের কোনো কাজেই বাঁধা দেইনি। আমার বিশ্বাস ছিল, তারেক যাই করুক ভালো করবে। ও মানুষের কথা ভাবত, দেশের কথা ভাবত। যুদ্ধের সময়ও লুকিয়ে লুকিয়ে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে যাইত। ওর চিন্তা ভালো ছিল তাই আমি বাধা দেইনি। আর যুদ্ধের পর ওর বাবারও মন পাল্টেছিল, সেও তারেককে বাধা দেয়নি। তারেক তো নিজের মতো করে ঢাকায় সব গুছাইছে। অনেক কষ্ট করছে জীবনে। খেয়ে না খেয়ে কাজ করত, রাত জাইগা পড়াশোনা করত। খাতার পর খাতা সারা রাত যে কী লিখত! আমি ঘুমাইতে বললেও ঘুমাইত না। 
তারেক তো ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু করেনি। ধর্ম দিয়ে মানুষকে যে ভুল বুঝাত তারেক সেই সত্যটাই ‘রানওয়েতে’ দেখিয়েছে। তবে ‘কাগজের ফুল’ ছবি বানাবার সময় ওর বাবা নিষেধ করেছিল, ‘এই ছবি তোমার বানাবার দরকার নাই, অত আগের ছবি বানানো লাগবে না।’

ক্যাথরিন মাসুদ একজন ভিনদেশি মানুষ। আপনার পরিবারের সদস্য হলো কীভাবে?
নূরুন্নাহার মাসুদ : ক্যাথরিন একটা সোনার মানুষ, আমার তারেকের একেবারে যোগ্য সঙ্গী। ক্যাথরিন কী গবেষণার কাজে বাংলাদেশে আসছিল। তখন তারেক এস এম সুলতানকে নিয়ে ছবি বানাচ্ছিল। ক্যাথরিন কীভাবে যেন সেই কাজে যুক্ত হয়ে গেছে। ওখানেই পরিচয়, দুইজন একসঙ্গে সিনেমা নিয়ে কাজ করে। সারা দেশ ঘুরে বেড়ায়। আহমদ ছফার কাছে দুইজন আড্ডা দিত। উনি ওদের দুইজনকে মিলিয়ে দিয়েছেন। আমরা শোনার পর ঢাকায় গেলাম তারেকের বাবা ক্যাথরিনকে জিগাইল, তোমরা যে একসাথে বেড়াও, তোমাদের পরিকল্পনা কী? ক্যাথরিন বলল, আমরা বিয়ে করতে চাই। তখন ওর বাবা বলল, তাহলে তোমার তো ইসলাম ধর্ম নেওয়া লাগবে। ক্যাথরিন রাজি হলো। কোর্টে গিয়ে ইসলাম নিল। ক্যাথরিনের নতুন নাম রাখা হলো আয়েশা। এরপর ইসলাম অনুযায়ী দুজনকে বিয়া দিলাম। একজন হুজুর বাসায় এনে আবার বিয়ে পড়াল। তারেক সব সময় বলত, ক্যাথরিনকে আমার কাজের জন্য খুব দরকার ছিল।

তারেক মাসুদ তো দেশের জন্য অনেক কিছু করে গেছেন। আজ এগারো বছর তিনি নেই। তার বাকি কাজগুলোর কী খবর?
নূরুন্নাহার মাসুদ : আমি বলতে পারব না, ক্যাথরিন কিছু কাজ করছে আর কত বছর তো ক্যাথরিন দেশে আসতে পারছে না। আর দেশের সরকারই-বা কী করল আমার তারেকের জন্য? দেশের জন্য তারেক কম কিছু করেছে? খেয়ে না খেয়ে দেশের কাজ করছে। যুদ্ধের সময় তারেকের চাচাতভাই বেনু গানের দল নিয়ে গান করত। সেই ছবি তুলেছিল আমেরিকার লেভিন নামের একজন। বেনুর কাছে শুনে সারা আমেরিকা তন্নতন্ন করে খুঁজে লেভিনকে বের করছে। সেই ফুটেজ এনে মুক্তির গান বানিয়েছে। দেশের দলিল দেশে এনেছে। শেখ হাসিনাও সেই ছবির শো দেখতে গিয়েছেন। 

সরকারের কী করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
নূরুন্নাহার মাসুদ : কী করা যায় সেটা সরকারের পরিকল্পনা থাকা উচিত। আমার তারেক কোনো দিন সরকারের কাছে কিছু চায়নি। নিজের টাকা দিয়ে, কষ্ট করে ছবি বানিয়েছে। তারেকের লাখ লাখ টাকার সম্পদ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ফার্মগেটের বাসায়। আমার তারেকের ব্যবহৃত জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে গেলে কোনো স্মৃতিই অবশিষ্ট থাকবে না। আমার স্বপ্ন ছিল তারেকের নামে জাদুঘর হবে। আমার তারেকের সবকিছু সেখানে থাকবে। পদ্মাসেতু চালু হয়েছে এখন হাজার হাজার মানুষ আসে তারেকের কবর দেখতে। তারা তারেকের জিনিসপত্র দেখতে চায়। দেখাতে পারি না। কবর দেখে চলে যায়। তাদের কোথাও বসতে দিতে পারি না। আমার বয়স হয়েছে আশির বেশি। কতদিন আছি আল্লাহ জানে! আমার জীবনে মনে হয় আমি দেখে যেতে পারব না। এগারো বছরেই কিছু হয়নি! আর কবে হবে? মাঝে মাঝে মনে হয় শেখ হাসিনার কাছে যাই। যদিও ছেলেরা এইভাবে বলতে আগ্রহ করে না। ক্যাথরিনের সাথে শেখ হাসিনার দেখা হয়েছে তারেকের মৃত্যুর পর, আবার নাহিদের সাথে দেখা হয়েছে। শেখ হাসিনা শেখ রেহানাকে বলে, ‘চেনো এই যে কে? আমাদের তারেক মাসুদের ছোটভাই।’ সেদিনও শেখ হাসিনা আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে গেছে। রাস্তায় সাইনবোর্ড দেখে কোনো দিন তো এলো না আমাকে দেখতে, আমি কেমন আছি। আমার তারেকের ‘মুক্তির কথা’ ছবি দেখে শেখ হাসিনা নগরকান্দা এসেছে। অথচ আমার তারেকের কবরটা দেখতে কোনো দিন এলো না! তাই আমার আর কিছু বলার নাই। সরকার যদি মনে করে কিছু করা উচিত তো করবে। আমরা আর কী বলব। সাংবাদিকরা এসব কথা বলতে পারে।

আমরাও চাই তারেক মাসুদের স্মৃতিরক্ষায় কিছু হোক...
নূরুন্নাহার মাসুদ : আমার তারেককে মানুষ ভালোবাসে। আমার তারেক আমাকে হাজার ছেলে উপহার দিয়ে গিয়েছে। প্রতিদিন আমার হাজার হাজার ছেলেমেয়ে আসে। ওরা আমার সাথে কথা বলে কিন্তু আমার তারেক আর আসবে না। আমার সোনার ছেলে চলে গিয়েছে। আমি তারেকের স্মৃতি নিয়ে আমি বাঁচি।

আপনি ভালো থাকবেন...
নূরুন্নাহার মাসুদ : তোমরাও ভালো থেকো।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক