X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১
প্রদোষের কুঠুরী

ভারতবর্ষ ও ভি. এস. নাইপল

অমল চক্রবর্তী
১৬ নভেম্বর ২০১৬, ১৭:৫৯আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০১৬, ১৯:৩০

ভি. এস. নাইপল
ভারতীয় লেখক অমিত চৌধুরী অক্সফোর্ডে তার সুপারভাইজারকে জিজ্ঞেস করলেন নাইপলের নোবেল বিজয়ের সম্ভাবনা কতটুকু- তিনি বললেন সম্ভাবনা নাই বললেই চলে।কারণ কী? পুরস্কার দেবার সময় আলফ্রেড নোবেল শর্ত দিয়েছেন সাহিত্যের পুরস্কার তাকেই দেয়া যাবে যার মধ্যে ‘Idealistic content` থাকবে। সেই হিসেবে উত্তর-উপনিবেশের নেতিবাচক গাঁথার লেখক ভি. এস. নাইপলের নোবেল বিজয় আমাদের বিস্ময় ও কৌতুহলের জন্ম দেয়। কিন্তু নোবেল কমিটির ভাষায় তিনি সমসাময়িক জীবনে অসামান্য এক কাহিনিকার। ভারতবর্ষ নিয়ে নাইপলের সংকট ও প্রদোষ-প্রজ্ঞায় এই মহান নোবেল বিজয়ীর সামগ্রিক সাহিত্যিক যাত্রার নির্যাস পাই। নাইপলকে তার যাবতীয় সঙ্কট, দ্বন্দ্ব ও আত্মপরিচয় নির্মাণের সবচেতন প্রয়াস জানতে হলে নাইপলের এই ভারতবর্ষ জানা প্রয়োজন।

নাইপল ভারতকে নিয়ে তিনটি আলাদা ভ্রমণ কাহিনি লিখেছেন। অসংখ্য সাক্ষাৎকারে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। ফিরবেন না বলে শপথ করেও বারবার সেই ভারতে(পাকিস্তান ও বাংলাদেশসহ) ফিরছেন, নিজেকে গভীরভাবে বিশ্লেষণের চালুনিতে ছেঁকে নিচ্ছেন। নিজের নোবেলকে উৎসর্গ করেছেন আবার এই ভারতকেই। আনুষ্ঠানিক ভাষণে লিখছেন- ‘আমরা যখন আমাদের চিন্তা-ভাবনা পাল্টালাম এবং জানতে ইচ্ছা করলাম, ততদিনে কতটাই না পাল্টে গেছে সব কিছু!’




এই বারবার জানার চেষ্টাকে তার নিজেকে জানার এক প্রসঙ্গ হিসেবে ভাবা যেতে পারে। এই জানা হয়তো তাকে কোনো Ceatainty বা নিশ্চয়তার বর্ম দিতে পারেনি; কিন্তু এই প্রচেষ্টার আন্তরিকতা উপেক্ষণীয় নয়। ভারত নিয়ে নাইপলের প্রথম লেখা An area of Dakness বিতর্কের আগুন উস্কে দিয়েছিল যে, ভারত সরকার তেত্রিশ বছরের অক্সফোর্ড ফেরত তরুণের বই নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হল। নাইপলের উত্তর-উপনিবেশিক যাতনায় হতাশা ও আত্মরতির চরম বহিঃপ্রকাশ এই বইটিতে নাইপলের তীব্র ব্যঙ্গার্থক বর্ণনা-কাঠামোর পরিচয় পাই ১৯৭৭ সালে। আবার লিখলেন `India : A wounded Civilization` এখানেও নাইপল নিস্পৃহ নেতিবাচক ও কলোনীয় কেন্দ্রের প্রতিভূ। পরিশেষে ১৯৯০ সালে যখন লিখলেন India : A Million Mutinies Now. প্রথম দুটি গ্রন্থে যে হতাশা, ক্ষোভ ও নেতি আগুন হয়ে ঝরেছিল; এই শেষ গ্রন্থে তা নেই। এখানে বরং একটি সহানুভূতিশীল ও সংবেদনশীল মননের পরিচয় ফুটে উঠেছে। ভারত সম্পর্কে তার বীক্ষার একটি epistemological বা জ্ঞানতাত্ত্বিক আভাস ফুটে উঠবে সচেতন পাঠকের কাছে; তারপরও কথা থাকে তার প্রথম ও মূলত এখনো সর্ববিস্তারি দৃষ্টিভঙ্গি ঔপনিবেশিক প্রভুর সমর্থকের সময়ে নিয়ে যায়।
`An area of Darkness`-এ নাইপল ভারতের সাংস্কৃতিক জীবনের কঠোর সমালোচক হিসেবে প্রতিভাষ হয়ে আসেন। ইংরেজ শাষণের পর ভারতের (জওহরলাল নেহেরুর সময়ে) রাষ্ট নির্মাণ প্রক্রিয়া তার কাছে Colonial  Mimicry ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। তিনি বলেছেন-
এটি ভারতীয় ইংল্যান্ডের একটি দিক; এটি ভারতীয় ইতিহাসের অংশবিশেষ; যা এখন মৃত।(পৃ:৯০) এই বইয়ের ছত্রে ছত্রে তিনি ভারতকে চাবকেছেন বিদ্রুপ ও তুচ্ছামির ভাষায়। তিনি ভারতীয়দের ইতিহাসবোধের অভাব নিয়ে অনুযোগ করেছেন-
এটি ঠিক যে ভারতীয়রা সরাসরি দেশকে দেখতে অসমর্থ; কারণ এর ফলে যে ব্যথা ও বেদনার মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হবে তা তারা নিতে অক্ষম। আর এটা ঠিক যে তারা ইতিহাসবোধ গঠনে অসমর্থ। তা না হলে সর্বত্র তারা তাদের ঐতিহাসিক নিদর্শনের ধ্বংসাবশেষে বাহ্যি করে কীভাবে?
এই হতাশা তাকে ভারতীয়দের সাংস্কৃতিক জীবনে একাত্ম হয়ে আনন্দ পাবার চেয়ে বরং আত্মবিবরে গুটিয়ে নেবার তাগিদ দেয়। শেষ অধ্যায়ে তিনি ইউরোপের আরামদায়ক আবাসে নিজেকে সমর্পিত করতে আভাস দেন। তিনি লেখেন-
ভারতের যাদু আমার উপরে কিছু প্রভাব বিস্তার করেনি। বাল্যকালের দেশ হিসেবে অন্ধকারের অঞ্চল হিসেবে এটি রয়ে গেল। হিমালয়ের গভীর খাতের মতো এই দেশকে আমি কোনো দিনই ভেদ করতে পারব না।
তারপরও তিনি তার যাত্রা অব্যাহত রাখছেন। দ্বিতীয় গ্রন্থ India : A wounded Civilization-এ তিনি একই হতাশা ও নিরাসক্তির নির্বেদে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি আইন পরবর্তীতে স্থবির ভারতের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক নৈরাজ্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এখানেও তিনি ভারতকে দেখেছেন। অপ্রস্তুত বা Un Structured একটি জাতি রাষ্ট্র হিসেবে- যেখানে উত্তর-উপনিবেশিক নৈরাজ্য ছাড়া আর বলার মতো কিছুই থাকে না। আমরা ভীতির সাথে দেখি এই বইয়ের কোন কোন অংশে তিনি উগ্র দক্ষিণপন্থী সংগঠন ও তাদের সংকীর্ণ সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গির সমার্থন করছেন। ভারত নিয়ে নাইপলের তৃতীয় গ্রন্থ `India : A Million Mutinies Now (1990)' সেই হিসেবে অনেকটাই সহনীয় ও নরম সুরের সাংস্কৃতিক পর্যবেক্ষণ। এখানে ভারতবর্ষের ব্যাপকতা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে তিনি মূর্ত করেছেন পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনাশৈলীর মধ্যে দিয়ে। এক গবেষকের ভাষায় এই বইয়ে নাইপল একটি জাগরণের অপেক্ষায় থাকেন যা ভারতীয়দের হাজার বছর আগের আদি ভারত মাতার অপাপবিদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে নিয়ে যাবে। এই বইয়ের শেষে তিনি মন্তব্য করেছেন- স্তর থেকে স্তরে ব্যথা ও নিষ্ঠুরতার অবসান ঘটাতে হবে। 
নাইপলের তৃতীয় ও চূড়ান্ত এই গ্রন্থে ভারতের সংস্কৃতি ও চেতনার সাথে নাইপলের একটি সদার্থক ঐকান্তিকতা স্পৃহা দেখি।



সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
ব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
এনার্জি মাস্টার প্ল্যান সংশোধনের দাবিব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
তিন লাল কার্ডের ম্যাচ নিয়ে কে কী বললেন!
তিন লাল কার্ডের ম্যাচ নিয়ে কে কী বললেন!
সর্বাধিক পঠিত
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান