X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

আমি বুঝি এইসব, আমি বুঝি না

এমরান কবির
১৮ এপ্রিল ২০১৭, ১৬:৪৪আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০১৭, ১৬:৫০

noname
ওই তো ঝরে পড়লো একটি তারকা! তারকা নিচে নামতে থাকে! নিচে...! আরও নিচে...! অতঃপর পতিত হয় ঠিক সেই জায়গায় যেখানে একাকী ভূমির সাথে মিশে যাচ্ছিলো আমার শুক্রানু।
একটু পরেই আমি নবজাতকের কান্না শুনতে পাই।
আমি সেই কান্নার কাছে যাবার জন্য ব্যগ্রতা অনুভব করি। কেন করি তা জানি না। মানুষ কেন কান্না করে? সাধারণত কষ্ট পেলে কান্না করে। কিন্তু আমিতো আনন্দেও মানুষকে কান্না করতে দেখেছি! নবজাতকের অশ্রুহীন কান্না এই মহূর্তে এই সব প্রশ্নের পাশাপাশি আমাকে অধিকতর ব্যগ্র-বিহ্বল করে। কোথায়! কোথায় সেই কান্নার ধ্বনি! কত দূরে! আমি হাঁটতে থাকি। হাঁটতে থাকি পিরামিড পায়ে। যেন কোনো এক দ্রাবিড়া কন্যার প্রতি হেঁটে চলেছি শত-সহস্র বছর ধরে। প্রাচীন ঐতিহ্য পাঁয়ে গেঁথে হেঁটে চলেছি দূরাগত সেই পাহাড়ের পানে। যেখান থেকে উঠে আসছে নবজাতকের কান্না।
পরক্ষণেই আমার ভ্রান্তি দূর হয়ে যায়। অথবা নতুন ভ্রান্তিতে জড়িয়ে যাই! কারণ আমি ছিলাম এক জোসনা-বিহ্বল প্রান্তরে। আমার সাথে ছিলো আবিদ, আশিক, শিহাব। ছিলো পেন্ডুলাম। পেন্ডুলামের দুলে ওঠার পরিসংখ্যান। আশিকের দীর্ঘশ্বাস। ছিলো জাহাজ। জাহাজ থেকে বের হয়ে আসা জল। জলের ভেতরে ভিজে যাওয়া এই আমি কিংবা কাকতাড়ুয়া। কাকতাড়ুয়ার মাথা, প্যান্ট, বুক। ভিজে যাওয়া বুকের খড় ভারি হতে হতে ধপাস করে পড়ে যাওয়া শব্দ। ছিলো চাঁদের অপার্থিব আলো ভেদ করে জেগে ওঠা হঠাৎ এক সরাইখানা। হঠাৎ হঠাৎ বাবার হাত থেকে ফসকে যাওয়া দূরন্ত শৈশব। এসবের মধ্যে যখন নবজাতকের কান্না রচিত হয় তখন সংশয় না এসে কি পারে?
আরো সংশয়ী হয়ে উঠি যখন মনে পড়ে আমি এখানে কেন? একটু আগেই তো ছিলাম মতিঝিলের বিসিআইসি ভবনের তেরো তলায়। সেখানে ম্যারাডোনার সাথে দেখা হলো। সম্ভবত আগের রাতের বিপাশা বসু, কিংবা মল্লিকা শেরওয়াতও ছিলো। চলে আসার সময় রিসিপশনের মেয়েটি হঠাৎ বলে উঠলো সানিয়া মির্জা আপনার ফেবারিট?
আমি তখন আরো সংশয়ী হয়ে উঠি। আমি চমকে উঠি। দেখি রিসিপশনের মেয়েটি সানিয়া মির্জা হয়ে গেছে। আমি ভালো করে তার দিকে তাকাই। আবিষ্কার করার চেষ্টা করি কয়েক ফোটা পবিত্র শাদা পায়রা। কারণ গত কয়েকদিন বিপাশা বসু কিংবা মল্লিকা শেরওয়াত যা পারেনি সানিয়া মির্জা সেটা পেরেছিলো। আমি রচনা করেছিলাম বায়বীয় কাঠির ছন্দনৃত্য। আমি রচনা করতে চেয়েছিলাম লবণাক্ততা। আমি রচনা করতে চেয়েছিলাম ঘাম। সৌরঘামে চান্দ্রিক হতে হতে দেখি রচিত হচ্ছে পবিত্রতা। পবিত্রতা একসময় ঘণীভূত হয়। পবিত্রতা একসময় উন্মাদ হয়ে ওঠে। পবিত্রতা একসময় কাশফুলের মতো ঝরে পড়ে। পবিত্রতা যখন শিউলি ফুলের মতো ঝরে পড়ছিল সানিয়া মির্জার থুতনিতে তখন কি আমি শুনতে পেরেছিলাম কোনা এক নবজাতকের কান্নার ধ্বনি! আজ যখন রিসিপশনের মেয়েটির থুতনির দিকে পবিত্রতা খুঁজি তখন কী ভেবেছিলাম এইসব পবিত্রতা সাদা পায়রা হয়ে উড়ে যায়!
যখন আরো নিবিষ্ট হয়ে সেই মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে আমি কোনো কাশফুলের নিরুদ্দিষ্টতা খুঁজি তখন শত সহস্র সাদা সাদা পায়রা এসে আমার চোখে মুখে ঠোক্কর দিতে থাকে। ঠোক্করের কারণে আমি কষ্ট পেয়ে যখন পালাতে থাকি তখন কতটা পথ পেরিয়ে কোথায় এসে আমি পৌঁছাই তা বলতে পারি না। শুধু দেখি জোসনা-বিহবল প্রান্তর।
আমি একইসঙ্গে সংশয়ী ও আশাবাদী হয়ে উঠি। নবজাতকের কান্না আমাকে এইরূপ পরস্পর বিপরীত ধরনের প্রপঞ্চের মধ্যে নিপতিত করে। সংশয়ী এই জন্য যে এই চরাচরে নবজাতকের কান্না কেন আমার কানে আসবে? আশাবাদী এই জন্য যে নবজাতকের কান্না এলে তার উৎপাদক থাকবে। আর উৎপাদক থাকলে উৎপাদকের সাহায্যকারী থাকবে। যদি তাই হয় তাহলে তো এই চরাচরে আমি একা নই!
তাতে কী। এই প্রশ্নটিও ভাবতে থাকি। কিন্তু কান্নার শব্দ তো মিলিয়ে যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে খুব নিকট থেকে শব্দটা আসছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে অতি দূর থেকে আসছে শব্দটা। যেন দূরাগত পাহাড়ের কোল থেকে ভেসে আসছে এই কান্না কিংবা আর্তনাদ।
আমি ওই কান্নাকে কানে ধরে হাঁটতে থাকি। যেন শুনতে থাকি দূরাগত পাহাড়ের গান। যেন শুনতে থাকি মহাশূন্য থেকে ভেসে আসা দীর্ঘশ্বাসের পূর্বাভাস। আর হাঁটতে থাকি। হাঁটতে থাকি আর কী যেন ভুলতে থাকি।
ভুলে যাবার কষ্ট যখন একটু একটু বুকে বিঁধতে থাকে তখন এক অপার্থিব অন্ধকারে ছেয়ে যায় চারপাশ। আমার কেবলই মনে হয় আমি বলে ফেলব সেই কথাটি। আমার কেবলই মনে হয় আমি চিনতে পেরেছি ওই নবজাতককে। আমার কেবলই মনে হয় আমি বুঝতে পেরেছি ওই কান্নার কারণ। কিনতু সবকিছুকে দীর্ঘশ্বাসের উপকরণ বানিয়ে আমার সামনে সেই অপার্থিব অন্ধকার সরে গিয়ে ভেসে ওঠে আরেক আলো। আলোর ভেতর ধূলিকণা দেখা যায়। ধূলিকণার ভেতরে শত সহস্র পায়রা । তারা কাকে যেন খুঁজছে। তারা যেন শব্দ করছে। তাদের শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। একসময় আবার কান্নার ধ্বনি। নবজাতকের। তখন আমার সংশয় আরো ঘণীভূত হয়। তাহলে কী এক্ষুনি আমি কোনো নবজাতকের কান্নার শব্দ শুনিনি! আমি কি তাহলে এক্ষুণি ধূলিকণার ভেতরে তথাকথিত পায়রাগুলির কান্নার আওয়াজে বিভ্রান্ত হয়ে তাকে নবজাতকের কান্নার আওয়াজ বলে মনে করেছি! কিন্তু এইসব পায়রা পাখি তো জোসনার ভেতরের অন্ধকারেও ছিলো। সেখানে যখন অপার্থিব আলো এসে জড়িয়ে ধরলো তখন দেখা গেলো ধূলিকণার উড়াল। সেই উড়ালের ভেতর যদি তথাকথিত পায়রাগুলোর আওয়াজ এসে লেগেই থাকে তাহলে ওই কান্নার ধ্বনি দূরাগত হবে কেন?
এই সব যুক্তি আর পাল্টা যুক্তিতে যখন বিভ্রান্ত আমি নিজেই তখন হঠাৎ একটি প্রশ্ন মাথায় বিদ্যুচ্চমকের মতো খেলে গেলো। প্রশ্নটি হচ্ছে- জোসনা কী? যদি জোসনার আলোর ভেতরে ওই অপার্থিব অন্ধকার না আসতো, যদি ওই অপার্থিব অন্ধকারের ভেতরে দেখা না যেত ধূলিকণা, যতি ওই ধূলিকণার ভেতরে পায়রাগুলো না উড়ত, আর যদি ওই পায়রাগুলির কণ্ঠ থেকে নবজাতকের কান্নার আওয়াজের মতো শব্দ না আসতো তাহলে হয়তোবা এই ধরনের প্রশ্ন আমার ভেতরে খেলা করতো না।
এই প্রশ্নটি যখন আমার ভেতরে খেলা করতে শুরু করলো, আমি যখন ভাবতে শুরু করলাম তখন মনে পড়লো প্রীতির কথা। তখন এটাও মনে পড়লো যে এই প্রশ্নটির জনক আমি নই। এই প্রশ্নটির জনক প্রীতি নিজেই। জোসনার ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এই প্রশ্নটি সে করেছিলো। প্রশ্নটি করার পরই আমি আলোছায়ার এক কল্পচিত্র মেখে নিয়েছিলাম দুইচোখে। বলেছিলাম— জোসনা আসলে একধরনের সরাইখানা। বলেছিলাম— ধরো, শহরের কেথাও বৃষ্টি হলো। অন্য দিকে অনেক মেঘ। সাথে একটু একটু বাতাস। মন খারাপ করা মন নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যদি হঠাৎ তোমার সাথে দেখা হয়ে যায়, তখনকার বিহ্বলময় প্রাপ্তির মতো তার রূপরেখা। ধূলির মাঝে মায়ার মাঝে পড়ে থাকা শত সহস্র মানচিত্র ভেদ করে উঠে আসা ঘূর্ণি।
কিন্তু ওই ঘূর্নির মধ্যে কোনা শাদা পায়রা ছিলো না। ছিলো না কোনো তথাকথিত শাদা পায়রার আর্তনাদ কিংবা নবজাতকের কান্নার শব্দ। আমার ওই কথা শোনার পর সে তাকিয়েছিলো অনেকক্ষণ ধরে আমার চোখের দিকে। আমি বলেছিলাম, কী হলো । কী দেখো অমন করে। সে বলেছিলো- ইতিহাস।
তার এই দার্শনিকতা আমার ভালো লাগেনি। একটা অট্টহাসি দিয়ে তখন বিকেলের মৌন আলোর ভেতর দিয়ে দেখেছিলাম শাল-গজাারি বৃক্ষের বন। বনের পতনশীল পাতা। তাদের আর্তনাদও শুনেছিলাম।
ওই আর্তনাদের কথাও আমার খুব করে মনে পড়লো। আজকের এই নবজাতকের কান্নার ধ্বনি কি ওই আর্তনাদেরও এক অপভ্রংশ? অবচেতন মনে বহন করে চলা ওই স্মৃতিই কী আজ নবজাতকের কান্না হয়ে আমাকে তাড়া করছে?
এইসব বহুবিধ প্রশ্ন আসতে থাকে আমার মনে। প্রশ্নগুলোর হয়তোবা কার্যকারণ আছে। গভীর ব্যঞ্জনাও আছে অন্তরালে। কিন্তু আমার পরিপার্শ্বে যা কিছু ঘটে বা ঘটছে, কিংবা আমি যা যা দ্বারা তাড়িত হচ্ছি কিংবা আমি যে উৎস ধরে কিংবা উৎসের দিকে চলে যাচ্ছি তার উপসংহার কী? এই উৎস আর উৎসের উপসংহারে যেতে যেতে, এই আপাত নিকট কিংবা দূরের নবজাতকের কান্নার উৎস খুঁজতে খুঁজতে আমি যখন কিছুটা ক্লান্তি অনুভব করছি তখন হঠাৎ কানে কানে ভেসে এলো ঘন্টা ধ্বণির আওয়াজ। তখন কেন জানি মনে হলো আমি তো এই চরাচরে আর নেই। মনে হলো আমি যমুনা নদীর তীরে জেগে ওঠা পলিতে জন্ম নেয়া কাশফুলের মধ্যে হাঁটছি। জোসনা নেই। নীল নীল আলোর মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে আকাশ দেখার সাধ জেগে ওঠে। কত দিন আকাশ দেখা হয় না! আমি ঘাড় বাঁকা করে আকাশের দিকে তাকাই। আমরা দিনে দিনে কত দিন হারিয়ে ফেলি! দিনে দিনে এই সব দিন হারানোর মতোই আমার প্রশ্ন জাগে আচ্ছা আমি জীবনে কতবার আকাশের পানে তাকিয়েছি! মনে পড়ে না। মনে পড়ার পেছনে কোনো যুক্তিও নেই। তবুও খটকা লেগে থাকে মনের মধ্যে! আমি আকাশের মতো বিশাল একটা জিনেসের দিকে কতবার তাকিয়েছি তার কোনো পরিসংখ্যান নেই! পরিসংখ্যান নেই আমার মনের খাতায়! কিংবা পরিসংখ্যান নেই পৃথিবীর পৃষ্ঠাতেও! হারিয়ে ফেলেছি কত দিনের রোদ, কতদিনের গন্ধ। হারিয়ে ফেলেছি মনের জল-তরঙ্গের ঢেউ।
নিজেকে প্রশ্ন করেছি বহুবার। আত্মানুসন্ধানের চেষ্টা করেছি । আত্মসমালোচনার চেষ্টাও ছিল আমার। এসবের অংশ হিসেবে বহু কাজও করেছি। প্রশ্ন করেছি লক্ষ্যে। প্রশ্ন করেছি অলক্ষ্যে। প্রশ্ন করেছি সচেতনতায়। প্রশ্ন করেছি অসেচতনতায়। নিজেকে নিজেকে। বহুবার। কিন্তু এই সব প্রশ্নের সামষ্টিকতা কোনো ফলাফলই আনতে পারেনি। শেষে এসে আমি তাড়িত কিংবা বিতাড়িত হচ্ছি এক নবজাতকের কান্না দ্বারা।
কাশবনের মধ্য দিয়ে হাঁটছি নীল আলোর ভেতরে। কাশফুলগুলোতে নীলাভ আভা ছড়িয়ে আছে। ভেসে আসছে কাঠ-চেরাইয়ের শব্দ। আমি কিছুটা পুলকিত কিছুটা সংশয়িত হয়ে উঠি। পুলকিত হয়ে উঠি এই জন্য যে নবজাতকের কান্না আর ভেসে আসছে না। আর সংশয়িত হয়ে উঠি এই জন্য যে এই কাঠচেরাইয়ের শব্দগুলো আমার মনের বিভ্রান্তি কি-না। যে কান্নার দ্বারা তাড়িত হতে হতে, যে কান্নার দ্বারা বিহ্বল হতে হতে, যে কান্নার জন্য আমি জোসনা-বিধৌত চরাচরে হেঁটে চলেছি সময় থেকে সময়ের দিকে— সেই কান্না এতো সহজে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?
ঝুম বৃষ্টি নেমে এলো বোধহয়। এতক্ষণে ভুল ভাঙলো। কাঠচেরাইয়ের কোনো শব্দ ছিলো না আসলে। দূরে বৃষ্টি পড়ার শব্দ ছিলো বোধহয়। দুঃখজলে ভিজতে ভিজতে আমার মনে হলো মেঘ জমেছিলো মনের মধ্যে। মেঘ হালকা হয়েছিলো এক সময়। মেঘ সরে গিয়েছিলো একসময়। মেঘ দূরে গিয়েছিল একসময়। মেঘ ঘণীভূত হয়েছিল একসময়। কাশবনের বিশাল প্রান্তর পার হতে হতে আমি একটুও অবসন্ন হচ্ছি না যখন তখনই আমার মনের মেঘের সাথে দূরের মেঘের কোনো এক অলৌকিক সংযোগে বৃষ্টি নামলো বোধ হয়।
বৃষ্টি যখন অনেক বেগে শুরু হলো তখন মিলিয়ে গেল সকল শব্দ। তারপর ভেসে আসতে লাগলো আবারো সেই নবজাতকের কান্না। এইবার অবসন্ন হয়ে কাশফুলের বনের মধ্যেই বসে পড়লাম। আমার মনে হতে থাকলো এই নদী আমাকে বুঝলো না। আমার মনে হতে থাকলো এই নদীর চর আমাকে বুঝলো না। আমি কান্নার কাছে যেতে যেতে আমি কান্নার কথা ভুলে থাকতে চাইতে চাইতে, আমি বহুবিধ বৈপরীত্য নিয়ে, জোসনার প্রান্তর পেরিয়ে এই হু হু করা কাশফুলের মাঠে হাজির হয়েছি নদীকে সামনে রেখে। আমার এই অনুভবের অতলে ডুব দিয়ে আমি বুঝতে থাকলাম আমার নীরব কান্না নদী বুঝেনি। আমি হাঁটতে হাঁটতে সকাল হয়ে গেলাম। আমি হাঁটতে হাঁটতে দুপুর হয়ে গেলাম। আমি হাঁটতে হাঁটতে বিকেল হয়ে গেলাম। আমি হাঁটতে হাঁটতে সন্ধ্যা হয়ে গেলাম। আমি হাঁটতে হাঁটতে রাত হয়ে গেলাম। তারপর... ? তারপর রাতে রাতে হাঁটতে হাঁটতে আমি আর সকালের কাছে যেতে পারছি না। আমি জোসনা থেকে হাঁটতে হাঁটতে কাশফুলের বনে চলে এসেছি। কান্না আমার পিছু ছাড়ছে না। আমিও হয়তোবা পিছু ছাড়ছি না কান্নার। এই ছাড়া না-ছাড়ার মাঝে পড়ে আমি বিহ্বল হচ্ছি বারবার।
এইসময় আমার মনের ভেতরে আরেকটি প্রশ্ন জেগে উঠলো। প্রশ্নটি হলো- আসলে আমি কিসের জন্য বিহ্বল হচ্ছি এরকম? স্রেফ একটি কান্নার জন্য? না-কি কান্নাকারীর জন্য? সে কে? সে কী? কান্নার জন্যই বা আমার এতো ব্যগ্রতা কেন? কিংবা কান্নাকারীর জন্যই কেন আমার এতো অস্থিরতা? এই ব্যগ্রতা আর অস্থিরতা আমাকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? জোসনার ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, কত সহস্র বছর ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমি এখন নদীর পাড়ে কাশবনের ভেতরে।
হঠাৎ কাশবনের হালকা ছোঁয়ায় আমি কিছুটা সম্বিত ফিরে পাই। তখন লক্ষ্য করি বৃষ্টি হচ্ছে না। কোথাও কোনো শব্দ নেই। এমনকি নবজাতকের কান্নাও। আমি এবার আরো অস্থির হয়ে উঠি। আমার মনে হতে থাকে এই কান্নাকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। ভালোবেসে ফেলেছি এইসব দৃশ্যসমূহ। ভালোবেসে ফেলেছি এইসব পরিবেশ। ভালোবেসে ফেলেছি আমি বিবর্ণ চাঁদ। একা একা হাঁটতে হাঁটতে আমি কোথায় চলে এসেছি তাও জানি না। তাকাতে ইচ্ছে করছে না আর পেছনে। তবুও পেছনে ফিরে তাকাই। চোখ রাখি মহাশূন্যে। কত দূরে যায় আমার দৃষ্টি! যত দূরে দৃষ্টি যায় তত দূরে দেখি জ্যামিতিক আলো। আলোর ভেতরে যেন কোনো এক প্রাচীন পুরীর দৃশ্যসমূহ। ওইতো আমার খালি পা। খালি পায়ে হেঁটে যাওয়া শিশির মাখানো ঘাসের ছবি। ওইতো আমার বাংলা। ওইতো আমার ফেলে আসা কিংবা নিয়ে আসা চাঁদ! ওইতো আমার ফেলে আসা কিংবা নিয়ে আসা চাঁদের আলো। ওইতো আমার ফেলে আসা কিংবা নিয়ে আসা পেন্ডুলাম। ওইতো আমার ফেলে আসা কিংবা নিয়ে আসা তারকারাজি।
আমি এইসব দৃশ্যের মাঝেও কোলাহলের শব্দ শুনতে পাই। কোলাহলের শব্দ শুনে এইবার সেখানে যেতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে আবার জাগতিক হয় যাই। ইচ্ছে করে আবার পার্থিব হয়ে যাই। ইচ্ছে করে আবার অপার্থিব হয়ে যাই। ইচ্ছে করে এইসব টুকরো টুকরো মৃত্যুর কবল থেকে উদ্ধার হই। ইচ্ছে করে আলো আঁধারির এই ব্যপ্ত চরাচরে ওই কান্না করা নবজাতককে একবার চোখের দেখা দেখে ফিরে যাই।
কিন্তু চোখের দেখা দেখতে হলেও তো আলো লাগবে। এখন কেন জানি আলোটাও স্বল্প স্বল্প লাগছে। আলো-আঁধারি, আলো-আঁধারি ভাব। ঠিক ঠিক বুঝা যাচ্ছে না দিন না-কি রাত। যেন না-দিন না-রাত। যেন দিন-রাত্রির কোনো এক সন্ধিক্ষণ। গভীর ঘুম থেকে হঠাৎ জাগা পাওয়া মানুষ যেমন খেই হারিয়ে ফেলে তেমনি খেই হারিয়ে ফেলা অবস্থা যেন। মনে হচ্ছে আমি দাঁড়িয়ে আছে চিত্রশিল্পীর তুলি-রং-রেখার মধ্যে ডুবে যাওয়া কোনা এক আশ্চর্য অধ্যায়ে। অচেনা আলো। অচেনা আলোর ভেতরে অচেনা আঁধার। এতো এতো অচেনার ভেতরে আবারো সেই চেনা কান্নার স্বর। ওই নবজাতকের। চেনা এই কান্নার স্বরের সাথে সাথে সেই কোলাহলটাও শুনা যাচ্ছে এখন। কিন্তু এই কোলাহল টা যেন চেনা। যেন এই কোলাহলের অংশীদার ছিলাম কখনো। অথবা কোলাহলে যোগ দিয়েছিলাম কোনো একসময়! এই মনে হওয়াটা আমার ভেতরে এক কৌতুহলের জন্ম দিলো। একমাত্র নবজাতকের কান্না ছাড়া কোনো কিছুতেই কৌতুহল ছিলো না আমার। কৌতুহল আর অজানা এক অমোঘ টানে আমি নবজাতকের কান্নার দিকে হেঁটে চলেছি শত সহস্র বছর ধরে। জোসনা আর আলো-আঁধারি পেরিয়ে, বিশাল প্রান্তর পেরিয়ে, নদী, নদীর ঘাট, নদীর তীরে জেগে ওঠা কাশবন পেরিয়ে, কাশবনে ফুটে থাকা কাশফুলের দিকে তাকিয়ে, কাশবনের মাঝে ফুটে থাকা নীল আলোর ভেতর দিয়ে আমি হেঁটে চলেছি। হেঁটে চলেছি কান্নার দিকে।
খটকা লাগে মাঝে মাঝে, আসলেই কি আমি হেঁটে হেঁটে চলেছি! সত্যিই কি আমি এইসব নির্মম বর্ণিলতাকে সাথে করে কোনো এক সম্মোহনের দিকে এগিয়ে চলেছি! মাঝে মাঝে মনে হয় এইসব চাক্ষুষ আসলে কী? মূর্ত নাকি বিমূর্ত! না-কি শুধুই বিভ্রম! না-কি শুধুই প্রতিবিম্ব! প্রতিবিম্ব হলে সেটাই বা কিসের ইঙ্গিত বহন করে! এভাবে এভাবে মনের ভেতরে বইতে থাকে অনুকুল স্রোত। এ স্রোত কখনো চেনা লাগে। কখনো অচেনা লাগে। বিস্মিত হই। চিন্তিত হই। এগুলো কি কোনো কিছুর ইঙ্গিত। আর ভাবতে পারি না। ইচ্ছে করে প্রশ্নহীন হয়ে যাই। প্রশ্নহীন হয়ে যাবারই সময় এসে গেছে মনে হচ্ছে। কারণ ক্রমাগত প্রশ্নে প্রশ্নে আমি জর্জরিত হয়ে যাচ্ছি। এতটা জর্জরিত হলে জীবনটা হয়ে যাবে নিষ্ঠুর ধারাপাতের নামতা। ওই ছন্দ আমি বহন করতে পারবো না।
এইসব ভাবনার দোলাচালে দুলতে দুলতে যখন মনটা বিষাক্ত-মনোরোম হয়ে যাচ্ছিলো তখনই আবার কানে ভেসে এলো ওই কোলাহলের শব্দ। আমি ওই কোলাহলের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। একঝলক বাতাস এসে আমার সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে যায়। আমি হাঁটতে থাকি। কিন্তু এখন আর ক্রমাগত জোসনার আলো নেই। আলোগুলো যেন আাঁধারির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সমস্ত চারপাশকে। যেন গ্রাস করছে। কিন্তু কতক্ষণ হতে থাকবে এরকম! এটা তো সবসময় থাকার কথা নয়। হবার কথা নয় চিরস্থায়ী। কারণ কোনো কিছুই তো শেষ পর্যন্ত অন্ধকারে আচ্ছাদিত থাকে না। আলো এসে প্রলেপ মেখে দিয়ে যায়। এসবের মধ্যেই হাঁটতে থাকি। কতক্ষণ হেঁটেছি এভাবে? জানি না। কতক্ষণ আলো নিভে গেছে এভাবে? জানি না। কতক্ষণ প্রবাহিত হয়েছে সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে যাওয়া আউলা বাতাস? জানি না। কতটা বিচ্যূত হয়েছে আলোর প্রলেপ? জানি না। কিন্তু এতসব না-জানা সঙ্গে নিয়ে নিয়ে আমি যখন হেঁটেই চলেছি, কখন যে চলে এসেছি ওই কোলাহলের কাছে! বুঝতে পারি নি।
আরো বুঝতে পারিনি কখন আকাশের নীলগুলো হারিয়ে গেলো? আরো বুঝতে পারিনি এভাবে দিনে দিনে কতদিন হারিয়ে হারিয়ে আজ চলে আসতে পারলাম এই কোলাহলের কাছে? মনের খাতায় কিংবা পৃথিবীর পৃষ্ঠায় কি এর কোনো পরিসংখ্যান আছে? নেই। পরিসংখ্যান নেই এইসব হারিয়ে যাওয়া দিনের রোদের। পরিসংখ্যান নেই এইসব হারিয়ে যাওয়া দিনের গন্ধের। পরিসংখ্যান নেই এইসব হারিয়ে যাওয়া বিকেলের রঙের।
পরিসংখ্যানহীন এইসব বিষয়-আশয় নিয়েও পৌঁছে গেলাম কোলাহলের কাছে। আমাকে দেখে নিমিষেই কোলাহল থেমে গেলো। নিমেষেই সবাই জায়গা করে দিলো সামনের দিকে এগোবার। তখন নিমিষেই আবারো আগের মতো কোলাহল শুরু হলো। আমি এগিয়ে গেলাম কোলাহলের ভেতরে সৃষ্ট রাস্তা দিয়ে। এই রাস্তা দিয়ে আমি আবারো ক্রমাগত হাাঁটতে থাকলাম। হাঁটতে হাঁটতে হাঁটতে যখন পৌঁছুলাম কোলাহলের কেন্দ্রে, দেখলাম, একটা বনসাঁই বৃক্ষ কাঁপছে। তার কান্ড, পাতা, বাকল দিয়ে ঝরছে পানি।
নবজাতকের কান্নাটা ওই বনসাঁইয়ের গোড়া থেকেই আসছিলো। আমি বুঝলাম। অথবা বুঝলাম না।

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
শনিবার সকালে আবার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা বুয়েট শিক্ষার্থীদের
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ইসরায়েল যা যা অস্ত্র চেয়েছিল সব পায়নি: মার্কিন সেনাপ্রধান
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ছুটির দিনে নিউ মার্কেটে জনসমুদ্র
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
সর্বাধিক পঠিত
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ
২৪ ঘণ্টার মধ্যে মেট্রোরেল লাইনের ওপর থেকে ক্যাবল সরানোর অনুরোধ