X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল ও তার কবিতা

মাইনুল ইসলাম মানিক
১৩ আগস্ট ২০১৭, ১৫:১৭আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০১৭, ১৬:২১

গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল ও তার কবিতা
আমার মাংসমজ্জা মিশে যাক তোমার শরীরে

থেমে যাক উদ্বেগ, বুকের কম্পন

তোমাতেই মুদে যাক আমার চক্ষুদ্বয়

আমার হৃদয়, সেও ঘুমিয়ে যাক তোমার ভিতর।

(অপ্রসন্ন জননী : গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল)

গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল প্রেমে পড়েছিলেন। সতেরো বছর বয়সে। প্রেমের বয়স তিন বছর হতে না হতেই আত্মহত্যা করলেন প্রেমিক যুবক রোমিও উরেতো। মৃত্যুর সময় তার পকেটে মিস্ত্রালের লেখা একটি চিঠি ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি। রোমিও চলে গেলেন মিস্ত্রালের সমূহ আবেগকে ভূমিকম্পের মতো নাড়া দিয়ে। হৃদয়ে সুপ্ত যে কবিতার আগ্নেয়গিরি, মিস্ত্রাল তার উদগিরণ ঘটালেন ‘মৃত্যুর সনেট’ কাব্য প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এরপরই তার জীবনে নেয় এক নাটকীয় মোড়। লাতিন আমেরিকা তথা পুরো দুনিয়াকে কাঁপিয়ে দেন তার কবিতার শৈলী দিয়ে। প্রথম লাতিন কবি হিসেবে নোবেল পুরস্কারের পাশাপাশি অসংখ্য মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার অর্জন করেন এই কবি ও শিক্ষাবিদ।

মিস্ত্রালের সাথে বিখ্যাত ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের একটি বিষয়ে দারুণ সাদৃশ্য ছিলো। হেমিংওয়ে স্বীকার করেছিলেন, প্রতিটি লেখাকে তিনি বারবার সংশোধন করতেন। তার দ্য ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি  উপন্যাসের শেষ অংশটি ছাপা হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি মোট ছত্রিশ বার সংশোধন করেছিলেন। মিস্ত্রালও তার লেখার উৎকর্ষতার ব্যাপারে ছিলেন আপোষহীন। লেখা শেষ করার পর সেটিকে তিনি বারবার সংশোধন করতেন। যখন সেটিকে প্রকাশ উপযোগী মনে হতো, শুধুমাত্র তখনই সেটিকে ছাপতে দিতেন। তিনি প্রায় আটশত কবিতা লিখেছিলেন, অথচ জীবদ্দশায় ছাপতে দিয়েছিলেন মাত্র ৩৭৯টি। অবশিষ্ট কবিতাগুলো প্রকাশের যোগ্য মনে না হওয়ায় তিনি সেগুলো ছাপতে দেননি। যদিও তার মৃত্যুর পর সেসব কবিতা অপ্রকাশিত থাকেনি। 

কবি যেটুকু প্রত্যক্ষ করেন, ধারণ করেন অন্ত্রে ও তন্ত্রে; কলমের কালিতে অঙ্কন করেন তারই প্রতিরূপ। জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা স্থান করে নেয় তার কবিতার বিষয়বস্তুতে। প্রকৃতি, প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা, মাতৃস্নেহ, দুঃখবোধ এবং তা থেকে নিস্কৃতি পাওয়ার প্রক্রিয়া হয়ে ওঠে তার কবিতার অনুসঙ্গ। তিনিই প্রথম দেশীয়, আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান প্রভাবের মিশ্রণের কবিতাকে বিশ্বের সাথে পরিচিত করে তোলেন। যাদের হাত ধরে লাতিন কবিতা আধুনিকতার যুগে প্রবেশ করে মিস্ত্রাল তাদের অন্যতম। পাবলো নেরুদা কৈশোরে মিস্ত্রালের কবিতা দ্বারা ব্যাপক প্রভাবিত হয়েছিলেন। নেরুদা অবশ্য সেসব অকপটে স্বীকারও করেছিলেন। নেরুদার মতো লাতিন আমেরিকার অনেক আধুনিক কবিরই রোল মডেল ছিলেন মিস্ত্রাল।

কবিতা লেখার অপরাধে সেকেন্ডারি স্কুলে পড়তে দেয়া হয়নি মিস্ত্রালকে। স্কুল কর্তৃপক্ষের ভয় ছিলো, জ্ঞান অর্জনের সাথে সাথে তিনি প্রকৃতিপ্রেমিক হয়ে উঠতে পারেন এবং যিশুর প্রতি তার আস্থা হারিয়ে যেতে পারে। ষোল বছর বয়স পর্যন্ত বাধ্য হয়ে ঘরে তার শিক্ষিকা বোনের কাছে পড়াশোনা করতে হয়েছিলো। অথচ উপেক্ষিত মিস্ত্রালই একদিন চিলির জাতীয় শিক্ষক হয়েছিলেন এবং চিলি, মেক্সিকোসহ অসংখ্য দেশের শিক্ষার পলিসি নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। তিনি শৈশবে শিক্ষার অধিকার বঞ্চিত হয়েছিলেন, পিতৃস্নেহ বঞ্চিত হয়েছিলেন। তাই শিশুদের বঞ্চনায় তিনি মর্মাহত হতেন। মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করে গেছেন সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের জন্য, উৎসাহিত করেছেন চারপাশের মানুষকে। তিনি বলতেন, ‘শিশুর কল্যাণে কিছু করবার উদ্দেশ্যে আগামিকালের জন্য অপেক্ষা করা উচিৎ নয়, আগামিকাল খুব কাছাকাছি নয়, সেটা অনেক দূরে, যা করার তা আজই শুরু করতে হবে, এখনই, এই মুহূর্তেই।’

তরুণ প্রেমিকের মৃত্যুর পর জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলোতে আর কোনো পুরুষের সাথে সখ্য গড়ে ওঠেনি মিস্ত্রালের। বিয়ে না করলেও লালন করতেন ইয়েন নামের এক পালক শিশুকে। বিশ বছরের ইয়েন একদিন আর্সেনিক খেয়ে আত্মহত্যা করে। এতে খুব ভেঙে পড়েন মিস্ত্রাল। তিনি এটিকে আত্মহত্যা হিসেবে কখনোই বিশ্বাস করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, বিরুদ্ধবাদীরা তার সন্তানকে হত্যা করেছেন। ইয়েনের মৃত্যুতে তিনি এতোটা ঘোরের মধ্যে চলে যান যে, তিনি বাস্তবতার পাশাপাশি এক ঘোরের জগতেও বসবাস করতে শুরু করেন। এরপর থেকে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। এর কিছুদিন পর প্যানক্রিয়াসে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে ৬৭ বছর বয়সে তিনি পৃথিবী ত্যাগ করেন।                

গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের কবিতা

 

গোধূলী

টের পাচ্ছি, কোমল হৃদয়

গলে যাচ্ছে মোমের মতো

রক্ত শিরায় প্রবাহিত যেনো

মদ নয়, মন্থর তেলের ধারা।

টের পাচ্ছি, শান্ত অচঞ্চল হরিণীর মতো

পালিয়ে যাচ্ছে জীবন।

 

সহোদরা

আজ লাঙলের ফলায় ভূমি কর্ষণরত এক রমনীকে দেখলাম

তার ছিলো প্রণয়গ্রাহী চওড়া নিতম্ব, আমার মতোন

আর সে ঝুঁকে ঝুঁকে একমনে কাজ করছিলো।

সযত্নে আমি তার কোমরে হাত রাখি; তাকে নিয়ে আসি বাড়ি।

সে আমার নিজস্ব গ্লাস হতে দুগ্ধপান করে,

পোহায় ভালোবাসার ছোঁয়ায় বাড়ন্ত ফলবর্তী কুঞ্জবনের ছায়া।

আর আমার স্তন যদি অনুর্বর হয়ে উঠে;

আমার সন্তান ঠোঁট রাখবে তার দুধালো স্তনে।

 

অপ্রসন্ন জননী

ঘুমোও, হে প্রিয়, ঘুমিয়ে থাকো

শঙ্কাহীন; কোনো ডরভয় নেই

যদিও আমার আত্মা থেকে যাবে নির্ঘুম

যদিও আমি নেবো নাকো বিশ্রাম।

 

ঘুমোও, ঘুমিয়ে থাকো, আর রাত্রিকালে

একটি ঘাসের কোমল পাতা

একটি ভেড়ার মসৃণ লোমের চেয়েও সুকোমল হোক তোমার নিশ্বাস।

 

আমার মাংসমজ্জা মিশে যাক তোমার শরীরে

থেমে যাক উদ্বেগ, বুকের কম্পন

তোমাতেই মুদে যাক আমার চক্ষুদ্বয়

আমার হৃদয়; সেও ঘুমিয়ে যাক তোমার ভিতর।




অলঙ্করণ : নরোত্তমা

 

সম্পর্কিত
প্রিয় দশ
দোআঁশে স্বভাব জানি
প্রিয় দশ
সর্বশেষ খবর
বিশ্বসাহিত্যের খবর
বিশ্বসাহিত্যের খবর
দেশজুড়ে এমপিরাজ শুরু হয়েছে: রিজভী
দেশজুড়ে এমপিরাজ শুরু হয়েছে: রিজভী
স্কুল ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত, রাফীর সিনেমাটি প্রদর্শনের অযোগ্য!
সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত, রাফীর সিনেমাটি প্রদর্শনের অযোগ্য!
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
২৪ ঘণ্টা পর আবার কমলো সোনার দাম
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের