X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১
উড়িষ্যার লোককথা : পর্ব- ১০

চার উপদেশ

অনুবাদ : ‍দিদার মুহাম্মদ
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১০:৫৪আপডেট : ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১১:১৮

চার উপদেশ

এক ছিল এক কুঁড়ে ব্রাহ্মণ। কোন কাজেই তার না ছিল আগ্রহ, না ছিল দক্ষতা। সামান্য কিছু জমি ছিল তারও আবার না ছিল রেজিস্ট্রি না ছিল কাগজ-পত্র। একেবারে হাড়-ভাতে কপর্দকশুন্য। কী করে তার দিন গুজরান হবে? তার তো ভবিষ্যৎ পুরো অন্ধকার। ব্রাহ্মণ বৌ বলে, ‘কত লোক কত কাজ করে, কত উপার্জন করে, তুমি পারো না? আমার গয়নাগুলোও বন্ধক দিলে। এখন কেমন করে চলবে সংসার?’ ব্রাহ্মণ দেখলো এত বেলা গড়িয়ে গেছে কিন্তু বৌ কিছুই রান্না করেনি। নিজের উপর রাগ হলো ব্রাহ্মণের। গম গম করে কী কী মন্ত্র পড়ে পুজা দিয়ে সাই সাই করে বাড়ির বাইরে চলে গেল।

দীর্ঘ সময় হেঁটে ব্রাহ্মণ ক্লান্ত হয়ে পড়ল। তার পক্ষে আর হাঁটা সম্ভব নয়। ক্লান্তি আর ক্ষুধায় তার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। এমন সময় সে এক মহাত্মার দেখা পেল যিনি জিজ্ঞেস করলেন ব্রাহ্মণ কোথায় যাচ্ছে। ব্রাহ্মণ বলে, ‘প্রভূ, আমি জানি না কোথায় যাই। যেখানে আমার কপাল আর আমার পা আমাকে নিয়ে যাবে সেখানেই যাব, প্রভূ?’ মহাত্মারা অন্যের মন পড়তে পারেন। তিনি ব্রাহ্মণের জন্য ব্যথিত হলেন। ব্রাহ্মণ মহাত্মার সাথে একটি মঠে কয়েকদিন কাটাল। মহাত্মা নিজেই ভিক্ষা করে দিন গুজরান করতেন। তিনি আর কয়দিন ব্রাহ্মণের যত্ন নিবেন? তিনি একদিন ব্রাহ্মণকে ডেকে বললেন, ‘তোমাকে আয়-রোজগারের জন্য কিছু করতে হবে। তুমি বুদ্ধিমান আর শক্তিও আছে তোমার। মাত্র দুইটা পেটের ভাত তুমি যোগার করতে পারবে না? আমি তোমায় চারটি উপদেশ দিচ্ছি। যদি তুমি জান, বুঝ কিভাবে এই উপদেশ কাজে লাগবে তবে তোমাকে কখনই অনাহারে থাকতে হবে না। সেগুলো হল- আয় করবে মেথরের মত, খাবে রাজারাজরার মত, সর্বদা-সর্বত্র বৌকে মিথ্যা বলবে আর আজীবন রাজার কাছে সত্য বলবে।’ ব্রাহ্মণ সামান্য কিছু চাল নিয়ে বাড়ি ফিরল। সে ছিল খুবই ক্ষুধার্ত। তার বৌ বিগত কিছুদিন আসলে এক প্রকার অনাহারেই ছিল। বাড়িতে দানা-পানি কিচ্ছু নেই। স্বামীকে দেখে ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মত সে চিৎকার করে উঠল। ব্রাহ্মণ কোন মতে রাতটা পার করে পরদিন সকালেই বের হয়ে গেল। এবার সে যে করেই হোক কিছু পয়সা-কড়ি আয় করেই ফিরবে। যেতে যেতে সে দেখল কিছু লোকের জটলা। বুঝল তার কোন বিপদে পড়েছে। কাছে গিয়ে দেখল গ্রামের এক সন্যাসী পরলোক গমন করেছে। সমস্যা হল সন্যাসী আসলে কোন জাতের তা কেউ জানে না। কে তাকে ছোঁবে, শশ্মানে নিয়ে যাবে, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করবে? কেউ এগিয়ে আসে না, পাছে কার জাত যায়! ব্রাহ্মণ বলল, ‘আমি কী করছি তা নিয়ে আমার মাথা ব্যথা নেই। পেট বাঁচানোর জন্য আমি সব করতে পারি। আমি এই মরদেহ শশ্মানে নিয়ে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করব। আমাকে তোমরা কী দিবে?’ লোকজন দেখল এই উপায় হাত ছাড়া করলে জাত বাঁচানো যাবে না। তারা সবাই তক্ষণি কিছু কিছু চাঁদা তুলে মোট পাঁচ আনা দিল। ব্রাহ্মণ বলল, ‘হু। ঠিক আছে। আমি রাজি। কপালে আমার যা আছে তাই করতে হবে।’ সে মরদেহ তুলে শশ্মান ঘাটের দিকে রওনা দিল। এই তো গতকাল মহাত্মা বলেছিল মেথরের মত উপার্জন করতে। তবে আয়-রোজগারের জন্য কেন সে জাত-বর্ণ নিয়ে ভাববে? সে মরদেহ নিয়ে শশ্মান ঘাটে পৌঁছে চিতায় আগুন দিল।

সন্যাসী ছিল জটাধারী। সেই চুলের জটা ছিল বার হাত লম্বা। যখন তার জটায় আগুন ধরল, সঙ্গে সঙ্গে এক অভূতপূর্ব কাণ্ড ঘটল। আগুন ধরার পর দেখা গেল সেই জটা পুড়ছে আর একের পর এক স্বর্ণমুদ্রা ঝরে পড়ছে। আসলে চোরের ভয়ে সন্যাসী তার স্বর্ণমুদ্রা জটার মধ্যে লুকিয়ে রাখত। ব্রাহ্মণ তো মহা ‍খুশি! সে বুঝল দেবতারা সন্তুষ্ট হলে দু-হাত ভরে দেন, আর এই স্বর্ণমুদ্রা তারই প্রমাণ।

স্বর্ণমুদ্রাগুলো গামছার কোণায় বেঁধে ব্রাহ্মণ বাড়ি ফিরল। বউকে কিছুই বলল না। একটা স্বর্ণমুদ্রা দিয়েই সে চাল, ডাল, ঘি, মাছ আর ঘরের সমস্ত বাজার করে আনল। বৌ ভীষণ খুশি হল এই ভেবে যে তার স্বামী এখন আয়রোজগার করছে। তাই লক্ষ্মী বৌয়ের মত স্বামীর আদর যত্ন শুরু করে দিল সে। অল্পদিনেই তারা ধনী হয়ে গেল। একটা বড় বাড়ি আর বেশ জায়গা জমি কিনে ফেলল তারা। ব্রাহ্মণ কোন টাকা পয়সা জমানোর চেষ্টা করল না তবে রাজার হালে বাস করতে লাগল। কারণ সেই মহাত্মা তাকে এটাই বলেছিল। যার কিছু পয়সা আছে সে-ই না কিছু পায়। সে বৌয়ের জন্য সুস্বাদু খাবার আর অলঙ্কারাদি কিনে আনল। এভাবেই বেশ সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ভাবনাহীন দিন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু চারদিকে কথা উঠল, যে ব্রাহ্মণের একবেলা খাবারের পয়সা ছিল না সে কি করে রাতারাতি ধনী হয়ে গেল! গুজব ছড়াল সে সোনার কলস পেয়েছে। কেউ বলল ‘যক্ষ তাহার উনুনে অধিষ্ঠানপূর্বক স্বর্ণপ্রদীপ প্রজ্বলন করিয়াছেন।’ আরও নানান কথা।

ব্রাহ্মণ সবই এমুখে ওমুখে শুনল কিন্তু কানে নিল না। কেউই কিছুই জানল না। ব্রাহ্মণ-বৌয়ের এক সখি ছিল গ্রামে। তাদের ছিল গলায় গলায় ভাব। একদিন সেই সখি ব্রাহ্মণ বৌকে প্রশ্ন করল, ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব, বলবে সখি?’ ব্রাহ্মণ-বৌ পেছন ফিরে চোখ বাঁকিয়ে বলল, ‘যেন তোমার কাছে আমি কোন কথা লুকাই?’ সখি বলল, ‘দু-দিন আগেও তো তোমাদের কত অর্থকষ্ট ছিল। কিন্তু এখন তুমি রাণীর মত থাক। এত অর্থকড়ি কোথায় পেলে বলত!’ ব্রাহ্মণ বৌয়ের কখনই এমন প্রশ্ন মাথায় আসেনি তাই স্বামীকেও জিজ্ঞেস করা হয়নি। সে বলল স্বামীর কাছ থেকে জেনে কাল সখিকে জানাবে।

ব্রাহ্মণ যখন বাড়ি ফিরল দেখল তার বৌ গোমড়া মুখে বসে আছে। কারণ জিজ্ঞেস করলে বৌ বলল, ‘তুমি আমায় মোটেও বিশ্বাস কর না। নইলে কেন তুমি এতদিনেও বলনি এত ধন-সম্পদ আমরা কোথায় পেলাম! আমি তো তোমার বৌ তাই না!’ ব্রাহ্মণ বলল, ‘এই ছোট বিষয় নিয়ে তুমি আমার উপর রাগ করেছ? তুমি আগে জিজ্ঞেস করলে তো আগেই বলতাম। এক মহাত্মা আমায় একটা দাওয়াই বানাতে শিখিয়েছে। কেউ যখন সেই দাওয়াই খাবে তখন তার পেট থেকে সোনার পয়সা বেরুবে। তেলাকুচার ফল আর ঝোলাগুড় দিয়ে থেকে বানাতে হয়। এটা তুমি কাউকেই বলবে না এই কথা। নইলে তারা পীড়াপীড়ি করবে। এই গোপন কথা কাওকেই বলবে না। এই কথা যেন ঘরের বাইরে না যায়। বৌ মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেও ভোর হওয়ার অপেক্ষায় উদ্বিষ উদ্বিষ করল। পরদিন সকালেই পুষ্করিনীতে স্নান করতে গিয়ে তার প্রাণের সখিকে সব গড়গড় করে বলে দিল। আবার সাবধান করল, ‘সখি, আমি যদি মিথ্যা বলি তো আমি আমার বাপ-মার মাথা খাই। আমার মাথা খাও, কাওকেউ এই গোপন কথা বল না। নইলে আমার স্বামী আমায় লাথি মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিবে। কেউ যেন এই কথা না জানে।’

সখি তাড়াতাড়ি করে বাড়ি গিয়ে তার স্বামীকে বলল, ‘তোমার ব্রাহ্মণবন্ধু কত অর্থকড়ির মালিক হয়েছে এই সামান্য দাওয়াই খেয়ে। তার মত ধনী গ্রামে কি আর একজন আছে? তাহলে আমরা কেন গরিব থাকব? আমি তার বৌয়ের কাছ থেকে এই দাওয়াই নিয়ে এসেছি। এটা খাও। তবে কাওকেই বলবে না। আমরা যে জেনেছি ব্রাহ্মণ যদি তা জানতে পারে তাবে সে তার বৌকে কেটে কুচি কুচি করে ফেলবে। কালই দেখবে আমাদের জীবন বদলে যাবে।’ আসলে তার বৌ নিজেই তেলাকুচার পাতা আর ঝোলাগুড় দিয়ে একটা দাওয়াই বানিয়ে তার স্বামীকে দিয়েছে। তার স্বামী রাতের বেলা কাঁদতে লাগল পেটের ব্যথায়। তার পেট ফুলে উঠেছে। তার বৌ এদিকে ভাবছে এখনি স্বর্ণমুদ্রা প্রসব করবে তার স্বামী। প্রচণ্ড পেট ব্যথায় স্বামীর চোখ উল্টে গেল, হাত-পা ঠাণ্ডা বরফ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর সব শান্ত হয়ে গেল। তারপর তার বৌয়ের চিৎকারে পাড়ার সবাই তার বাড়িতে জড়ো হলে। কী হল! যে লোক সন্ধ্যাবেলায়ও দিব্যি সুস্থ্য সে কেমন করে মধ্যরাতেই পেটফুলে মরল? সবাই তার বৌকে দোষ দিল। তার বৌ তাকে নিশ্চিয় বিষ খাইয়েছিল। গ্রাম প্রধান রাজার কাছে বিষ প্রয়োগে স্বামী হত্যার অভিযোগ জানাল। রাজার আদেশে বিধবাকে গ্রেফতার করে রাজদরবারে বিচারের জন্য হাজির করা হল। রাজা জিজ্ঞেস করল, ‘তাহলে তুমি বিষ প্রয়োগ করে তোমার স্বামীকে হত্যা করেছ? সে বিষ তুমি কোথায় পেলে?’ বিধবা বলল, ‘মহারাজ! আমি বড় হতভাগী। আপনার যা খুশি আমায় সাজা দিন। আমার এই নির্লজ্জ অভিশপ্ত জীবনের বেঁচে থাকার কোন মানে নেই। আমার সখি আগে যে ছিল গরিব, সে এখন ধনী। তাকে জিজ্ঞেস করে ছিলাম তারা এত অর্থকড়ি কোথায় পেল। সে তার স্বামীর কাছে থেকে শুনে তেলাকুচা আর ঝোলগুড়ের দাওয়াই খাওয়ার কথা বলে। সে বলে, যে সেই দাওয়াই খাবে তার পেট থেকে স্বর্ণমুদ্রা বেরুবে। আমি সে রকম দাওয়াই বানিয়ে আমার স্বামীকে দিয়েছিলাম। আহ! কি করেছি আমি! আমি লোভ করেছিলাম। হায়! আমি কী করলাম! আমার আর কী হবে বেঁচে থেকে?’

রাজা ব্রাহ্মণের গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করলেন। ব্রাহ্মণকে হাজির করা হল দরবারে। জিজ্ঞেস করা হল কেন সে তার বৌকে মিথ্যে বলেছে। ব্রাহ্মণ জবাব দিল, ‘এক মহাত্মা আমাকে চারটি উপদেশ দিয়েছে। আয় করবে মেথরের মত, খাবে রাজারাজরার মত, সর্বদা-সর্বত্র বৌকে মিথ্যা বলবে আর আজীবন রাজার কাছে সত্য বলবে।’ ব্রাহ্মণ জানে রাজাকে মিথ্যা বললে তার জীবন বাঁচবে না। তাই সে রাজার কাছে পুরো ঘটনা খুলেই বলল। সত্য শুনে রাজা ব্রাহ্মণকে মুক্ত করে দিল। তারপর থেকে ব্রাহ্মণ নির্বিঘ্নে দিনাতিপাত করল। আমি যখন তার কাছে গেলাম তখন সে কোন কথাই বলেনি আমার সাথে। (চলবে- প্রতি বৃহস্পতিবার)

........................................................................................................

আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন :
রাজকুমারী সুকেশিনী


অনুবাদক : দিদার মুহাম্মদ : আইসিসিআর স্কলার, মাস্টার অফ পারফর্মিং আর্টস (এমপিএ), ব্যাঙ্গালুর ইউনিভার্সিটি, কর্ণাটক, ভারত।

 

ই.আ
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া