আহা পৃথিবী! তোমার সাতশ’ কোটি সেরাজীবের আমি একজন—
‘মানুষ মানুষের জন্য’— এই অমোঘ সত্যের বাণী
জ্বলজ্বল করছে অভিধানে অথবা শুধু তোমাদের শান্তির ঘরে
কিন্তু আমার অশান্তিময় স্বদেশে এ শুধু পাগলের প্রলাপই মনে হয়
এখানে আমার জন্য কেউ নেই
এখানে আমার বাবার জন্য কেউ নেই
এখানে আমার মায়ের জন্য কেউ নেই
এখানে আমার ভাই-বোনের জন্য কেউ নেই
এখানে আমার সন্তানের জন্য কেউ নেই।
আমাদের জন্য আছে শুধু বুলেট-বোমা, চাপাতি-খঞ্জর আর তীক্ষ্ন তলোয়ার
নির্মমতা বলতে তোমরা শুধু শব্দটিই শুনেছো, আমরা দেখেছি এর স্বরূপ
পৈশাচিক বর্বরতা— এই দুটি শব্দের উচ্চারণে প্রকাশ করা যাবে না এর মর্মার্থ
পৃথিবীর কোনো অভিধানে কোনো শব্দ নেই
প্রকাশের কোনো মুদ্রা নেই
কোনো ভাষায় এমন কোনো ব্যঞ্জনা নেই
এই দলন পীড়ন নিষ্পেষণের
এই খুন ধর্ষণ উৎপীড়নের
এই বাস্তুচ্যুত আদম সন্তানদের
দুঃখ-কষ্ট, বেদনা-বিলাপের কোনো তুলনা নেই
এই কষ্ট বোঝাবার ভাষা আজ রুদ্ধ
এই কষ্ট শোনাবার কান্না শুকিয়ে পাথর।
বারবার ভাবি, বারবার বলি— উচ্চারণে-স্বগতোক্তিতে-মনে মনে
এই পাথর কুচি কুচি হয়ে কখন আবাবিল পাখির ঠোঁটে উঠে আসবে
আবরাহার হস্তী বাহিনীর মতন ধ্বংস করে দেবে এই জালিমদের
হে পৃথিবীর মানুষ, অসহায় শব্দটি তোমরা শুধু শুনেছো
আমরা দেখেছি এর স্বরূপ
আমাদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করার জন্য এই শব্দটিও যথেষ্ট নয়
তোমরা যদি অনুধাবন করতে পারো
তবে পৃথিবীর সব গ্রন্থাগারে রক্ষিত সবগুলো অভিধানে
নতুন শব্দ সংযোজন করতে হবে,
সহায় সম্বলহীন আমরা কীভাবে অপথকে পথ বানিয়ে
অসীম কষ্টকে পোষ মানিয়ে আরেকটি দেশে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে চলেছি
শুধু প্রাণ বাঁচানোর জন্য ছুটে এসেছি—
আমাদের নিকট প্রতিবেশী বাংলাদেশ নামের একটি মানবিক রাষ্ট্রে
তোমরা শুধু মিটিং করছো
সেমিনারে সিম্পোজিয়ামে হাজার হাজার মত প্রকাশ করছো
যে মুহূর্তে তোমাদের জ্ঞানচর্চা চলছে
ঠিক সেই মুহূর্তেও চলছে নির্যাতনের স্টিমরোলার
চলছে খুন ধর্ষণ হত্যা— পৈশাচিক নির্মমতা !
ধর্ষণ— তা যদি হয় সন্তানের সম্মুখে মাকে
ধর্ষণ— তা যদি হয় বাবার সামনে আদরের কন্যাকে
ধর্ষণ— তা যদি হয় ভাইয়ের সামনে বোনকে
ধর্ষণ— তা যদি হয় স্বামীর সামনে স্ত্রীকে
ধর্ষণ— তা যদি হয় বাবা-মায়ের সামনে পাঁচ বছরের শিশু সন্তানকে
তোমরা ইহাকে কোন সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করবে?
এবং তারপর যদি এদের এই রক্তাক্ত গোপনাঙ্গ
তীক্ষè বেয়নেটের নির্মম নির্মম এবং নির্মম খোঁচায়
জর্জরিত জর্জরিত এবং জর্জরিত করা হয়
তখন তোমরা ওই পাষণ্ডদের কোন নামে অভিহিত করবে
আবার এমনও হয়েছে—
সুন্দরী যুবতীদেরকে জড় করে পাঁচজন-আটজনের দলে ভাগ করে
এক এক ভাগ এক এক ঘরে রেখে
হায়েনারা দলে দলে ঢুকে ছোবল দিয়েছে
অতঃপর দরজায় তালা লাগিয়ে ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে!
সর্বস্ব লুট হয়ে যাওয়া তরুণী-যুবতীরা
অগ্নিকে আলিঙ্গন করে মৃত্যুর ভয়াবহতা নিঃশ্বাসের সঙ্গে গিলে ফেলেছে
আমাদেরকে বলে যেতে পারেনি
কী নির্মম কী করুণ এই জলন্ত বেদনার স্রোত
যা তাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে পরপারে
আমরা কোন শব্দে কোন বাক্যে এই ভয়াবহতা উচ্চারণ করবো
তা— হে পৃথিবীর জ্ঞানী গুণীরা তোমরাই বলো
হত্যা— তা যদি হয় পরিবারের সব সদস্যকে একসাথে
লাইন ধরিয়ে এক গুলিতে!
হত্যা— তা যদি হয় পরিবারের সব সদস্যকে এক ঘরে
তালাবদ্ধ রেখে আগুন লাগিয়ে!
হত্যা— তা যদি হয় পরিবারের সব সদস্যকে একজন একজন করে
চোখের সামনে পশুর মতো জবাই করে!
হত্যা— তা যদি হয় শূন্য বয়স থেকে মাসুম শিশুদের পুকুরে ছুড়ে মেরে!
হে বিশ্ববাসী, বিবেকবান মানুষেরা
তোমরা এই পৈশাচিকতাকে কোন সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করবে?
বিতাড়ন— তা যদি হয় একটি জাতিকে নির্মূল নিশ্চিহ্ন করার নীলনকশা
বিতাড়ন— তা যদি হয় শত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী
একটি জাতিকে বাস্তুচ্যুত করার মহাপরিকল্পনার মচ্ছব
তাহলে তোমরা এই স্বার্থপর কুলাঙ্গারদেরকে বিশ্ব সংঘের পবিত্র খাতায়
কী নামে লিপিবদ্ধ করবে?
এই একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতাকে নিকুচি করে
তোমাদের মুখমণ্ডলে থুতু ছিটিয়ে
তারা আমাদেরকে দেশ ছাড়া করেছে এবং করছে
পৃথিবীর সব জাতিকে সংগঠিত করে তোমরা জাতিসংঘ বানিয়েছো
তারা কী এই সংঘের বাহিরের কেউ? তা যদি না হয়
তবে কেন তোমরা এই পাগলা হাতিকে পোষ মানাতে পারছো না
লাগাম পরাতে পারছো না এই উচ্ছৃঙ্খল জাতিকে
যাদের বিষবাষ্পে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে আমাদের বাস্তুভিটা
যা কিছু সম্পদ— তিলে তিলে জমা হওয়া
যা কিছু সঞ্চয়— বিন্দু বিন্দু করে তহবিল,
সবই গোগ্রাসে গিলে ফেলছে হায়েনার অধিক হায়েনা
জানোয়ারের অধিক জানোয়ার
আর কতো বিপর্যয় হলে
আর কতো ধ্বংসের তাণ্ডব হলে
আর কতো রক্তপাতের অধিক রক্তপাত হলে
তোমরা ধেয়ে আসবে, তেড়ে আসবে মিয়ানমার নামক তথাকথিত এই ব্রহ্মদেশে
আমরা তাকিয়ে আছি তোমাদের দিকে
বিশ্ববাসী, আমাদের চোখ কেবল তোমাদের দিকে
উপায়হীন আমরা আর কত মার খেলে তোমাদের পায়ে গতি আসবে
আর কত যন্ত্রণা পোহালে
তোমাদের মনে-মননে-মনীষায় মানবতার ঝড় উঠবে
আর কত রক্তপাত-খুন-ধর্ষণ হলে
তোমাদের মনুষ্যত্বের গালে চপেটাঘাত অনুভব করবে।
নিরস্ত্র আমরা— আমাদের কাছে কিছুই নেই—
দুই হাত দশ আঙুলের এই অসহায়ত্ব উদ্বাহু তাকিয়ে আছে
তোমাদের দিকে
হে পৃথিবীর মানুষ— আমার ভাইয়েরা, আমার বোনেরা
যারা মানুষ হয়েও দ্বিপদ প্রাণী— অমানুষের নামান্তর
তাদের কাছে করুণাভিক্ষা অরণ্যে রোদনমাত্র
তাই তো আমরা তোমাদের কাছে আঁজলাভরা করুণা প্রত্যাশী
যাঁরা তোমরা আমাদের দুঃখ দেখে কাঁদছো, আমাদের ব্যথায় ব্যথিত হচ্ছো
স্লোগানে-কবিতায়-কথায়-বক্তৃতায় যাঁরা তোমরা
পৃথিবী কাঁপানোর চেষ্টা করছো
প্রার্থনা ছাড়া, যাচনা ছাড়া আমরা আর কী-ই বা করতে পারি বলো,
আমাদের কণ্ঠে যতটুকু শক্তি আছে তা দিয়ে চিৎকারে চিৎকারে
প্রকৃতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে, সমাজের পরতে পরতে জানান দিতে পারি—
তা-ই তো আজ আমাদের সম্বল,
যাঁরা তোমরা দানের হাত প্রসারিত করেছো
তাদের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
শেষ পর্যন্তও আমরা কৃতজ্ঞ থাকতে চাই
আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তোমরাই একমাত্র ভরসা—
আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সেটাই আমার ঠিকানা
মাতৃজরায়ু থেকে যে ভূখণ্ডে পতিত হয়ে
প্রথম ক্রন্দনধ্বনিতে মুখর করেছিলাম যেই আলো-বাতাস প্রকৃতি
সেটিই আমার স্বদেশ— এই মৌলিক অধিকারের কাছে আমি নতজানু
নতজানু আমার বিশ্বাসের কাছে
নতজানু তোমাদের বোধ-বুদ্ধি-মেধার কাছে
তোমাদের মানবতাবোধ তোমাদের মনুষ্যত্বের কাছে
এবং আমার বিশ্বাসের কাছে হাত পেতে বসে আছি
তোমরা নিশ্চয়ই এর মর্যাদা রাখবে
কেননা তোমরা ছাড়া এখন আমাদের বাস্তুভিটা উদ্ধারের আর কেউ নেই
কোনো উপায়ও নেই
তোমরাই আমাদের বিশ্বাস
তোমরাই আমাদের শক্তি আস্থা— স্নেহ-শ্রদ্ধা-ভালোবাসা।
ছবি : ইন্টারনেট থেকে