X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

আদোনিস এবং বেন ওকরির দু’টো দীর্ঘ কবিতা

অনুবাদ : অদিতি ফাল্গুনী
২৭ নভেম্বর ২০১৭, ১৪:০৬আপডেট : ২৭ নভেম্বর ২০১৭, ১৪:৩০

আদোনিস এবং বেন ওকরি
মরুভূমি 
।। আদোনিস

শহরগুলো লুপ্ত হয়, আর পৃথিবী যে ধুলো ভরা এক ঠেলাগাড়ি,

শুধু কবিতা জানে কীভাবে ভরাতে হয় এই শুন্যতা।

 

এই বাড়িতে যাবার কোনো রাস্তা নেই, একটি অবরোধ চলছে,

আর তার বাড়ি আসলে খোদ কবরখানাই।

কিছুটা দূর থেকে, তার বাড়ির ওপরে

এক কিংকর্তব্যবিমূঢ় চাঁদ ঝুলছে

ধুলোর সূতা বেয়ে।

আমি বলেছি : বাড়ি যাবার এটাই রাস্তা, সে বলল : না                

তুমি যেতে পার না, আর তার বুলেট ছুড়ে মারল আমার দিকে।

খুব ভাল তাহলে, বন্ধুরা আর তাদের বাড়িগুলোই

হয়ে উঠল গোটা বৈরুত জুড়ে আমার সঙ্গী-সাথি।         

এখন তবে রক্তের জন্য পথ—

সেই রক্ত যার কথা একটি বালক

ফিসফিসিয়ে বলেছিল তার বন্ধুদের কাছে: 

আকাশে এখন গর্ত ছাড়া আর কিছুই নেই

যাদের ডাকা হয় ‘তারা’ নামে।

 

শহরের কণ্ঠস্বর ছিল বড্ড কোমল, এমনকি বাতাসও

বাঁধবে না তার সেই স্বরে—

শহরের মুখ আলোকদীপ্ত

যেনবা কোনো শিশু রাত নামার জন্য গুছিয়ে নিচ্ছে তার স্বপ্নাবলী

আর সকালকে নির্দেশ দিচ্ছে ওর বিছানার পাশের চেয়ারে বসে থাকতে। 

 

তারা মানুষজনকে খুঁজে পেল থলেতে:

একটি মানুষ           মুণ্ডু ছাড়াই

একটি মানুষ           হাত ছাড়াই, অথবা

জিহ্বা ছাড়া

একটি মানুষ           গলা টিপে মেরে ফেলা।

বাকিদের আকারো নেই, নেই যে নাম।

—তুমি কি পাগল? দয়া করে

লিখো নাকো এসব নিয়ে।

 

খোলা বইয়ের একটি পাতা           

তার ভেতরে বোমাগুলো আরশিতে মুখ যে দ্যাখে।

ভবিষ্যদ্বাণী যত আর ধুলো-বসা প্রবাদবাক্য

এর ভেতরেই আরশিতে মুখ দ্যাখে। 

বনপথের একাকীত্ব এর ভেতরেই আয়না দ্যাখে, বর্ণমালার বুননে গড়া গালিচা এক

সূতোয় সূতোয় ফাঁস খুলে যায়

পরে যায় নগরীর মুখের উপর, স্মৃতির সূঁচি মুখ থেকে গলিয়ে আসে।

নগরীর বাতাসে এক হন্তারক, নগরীর ক্ষতের ভেতর সাঁতার কাটছে

তার ক্ষতস্থান যেন এক পতন

যা কিনা কাঁপত এই নগরীর নামে— কাঁপত নগরীর নামে রক্তপাতের নামে

আর যা কিছু আমাদের ঘিরে রাখে—

বাড়িগুলো চলে গেলে পেছনে দেয়াল ফেলে রেখে

এবং আমি আর নই আমি।

  

হতে পারে এমন একটি সময় আসবে যখন তুমি মেনে নেবে

বোবা ও কালা জীবন, হতে পারে

তারা তোমাকে অনুমতি দেবে অস্ফূটস্বরে কথা বলার : মৃত্যু

এবং জীবন

পুনরুজ্জীবন   

এবং আপনার প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক।

 

তাল-রসের মদিরা থেকে মরুর সুনসান নিভৃতি...ইত্যাদি

একটি সকাল থেকে যে নিজেই নিজের অন্ত্র চোরাচালান করে

আর ঘুমিয়ে থাকে বিদ্রোহীদের শবস্তুপের উপর...ইত্যাদি ইত্যাদি

সড়ক থেকে, সিপাই ও সেনাদের ট্রাক থেকে...ইত্যাদি

নর ও নারীদের ছায়া থেকে...ইত্যাদি

একেশ্বরবাদী ও অবিশ্বাসী কাফেরদের প্রার্থনায় লুকনো বোমাগুলো থেকে...ইত্যাদি

লোহা থেকে যা নিঃসরণ করে লোহা আর রক্ত মাংস...ইত্যাদি

ক্ষেত থেকে যে হাহাকার করে গম, ঘাস ও কৃষকের হাতের জন্য...ইত্যাদি

কেল্লা থেকে যে রক্ষা করে আমাদের দেহগুলো

আর আমাদের উপর স্তুপ করে জড়ো করে অন্ধকার...ইত্যাদি

মৃতদের কিংবদন্তী থেকে যারা জীবনকে উচ্চারণ করে আমাদের জীবনকে, করে চালনা...ইত্যাদি 

 

আলোচনা থেকে যা কিনা হত্যা এবং হত্যা এবং গলদেশে

ছুরির পোঁচ...ইত্যাদি

অন্ধকার থেকে অন্ধকার থেকে অন্ধকার

আমি শ্বাস নিই, স্পর্শ করি আমার দেহ, খোঁজ করি আমার নিজের জন্য

এবং তোমার জন্য, এবং তার জন্য, এবং অন্যদের জন্য।

 

এবং আমি মৃত্যুকে ফাঁসি দিই

আমার মুখ ও কথার এই রক্তপাতের মাঝে...ইত্যাদি

 

তুমি দেখতে পাবে—

বলো তার নাম

বলো তুমি তার মুখ কাছে টেনেছিলে

বাড়িয়ে দিয়েছিলে হাত সেই ছেলেটির দিকে

অথবা হেসেছিলে

অথবা হেসেছিলে

অথবা বলো আমি একদা সুখি ছিলাম

অথবা বলো আমি একদা ছিলাম বিষণ্ন,

তুমি দেখবে:

সেখানে কোনো দেশ নেই।

 

হত্যা বদলে দিয়েছে এই নগরীর আকৃতি— এই পাথরটি

একটি শিশুর মস্তক—

এবং এই ধোঁয়া মানবীয় ফুসফুস থেকে নির্গত।

প্রতিটি বস্তুই আবৃত্তি করে তার নির্বাসন...রক্তের

সমুদ্র এক— এবং   

অন্ধকারে ধমনীদের পাল তোলা ছাড়া কি তুমি প্রত্যাশা করো

এইসব সকালবেলায়, হত্যার এই জোয়ার লগ্নে?            

 

এই মেয়েটির (নগরীর) সাথে থাক, তাকে ছেড়ে দিও না—

মৃত্যুর আলিঙ্গনে সে বসে থাকে

আর তার আয়ুষ্কালের দিনগুলোর উপর

নির্বিকার উল্টে চলে যত ছেঁড়া পাতা।

 

তার মৃত্তিকা বিন্যাসের

শেষ ছবিগুলো পাহারা দাও—

বালুর ভেতর সে মুচড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে

ঝলকানির মহাসমুদ্রে—

তার দেহের উপরে ফুটে উঠছে মানবীয় গোঙানির দাগ। 

 

বীজের পর বীজ মাটিতে ফেলা হচ্ছে—

আমাদের কিংবদন্তীর উপর ভূমিগুলো খাওয়াচ্ছে আমাদের,

পাহারা দিচ্ছে রক্তের রহস্য। 

ঋতুগুলোর কাছে আমি বলছি একটি সুগন্ধের কথা

এবং আকাশে একটি বিদ্যুচ্চমকের কথা।

                            

মিনার চত্বর— (একটি খোদাই প্রস্তর তার গোপণ কথাটি ফিসফিস করছে

 বোমা-বিধ্বস্ত ব্রিজগুলোর কাছে...)

মিনার চত্বর— (একটি স্মৃতি তার আকৃতি খুঁজছে

ধুলো ও আগুনের ভেতর...)

 

মিনার চত্বর—  (একটি উন্মুক্ত মরুভূমি

যাকে পছন্দ করেছে বাতাস এবং তারপর বমি করে দিয়েছে—

বাতাসের মাধ্যমে বমনকৃত...)

মিনার চত্বর— (এটা যাদুকরী

শবদেহগুলো নড়তে দেখা/নাড়াচ্ছে তাদের অঙ্গ যত

একটাই গলিপথে, আর তাদের ভুতগুলো

একে অপরে নিবিষ্ট/আর শোনা তাদের যত দীর্ঘশ্বাস...)

মিনার চত্বর— (পশ্চিম ও পূর্ব

ফাঁসিকাঠ তৈরি—

শহীদেরা, নির্দেশ...)

  

মিনার চত্বর— (কাফেলার

ভিড় : সুগন্ধ

এবং আরবের আঠা আর মুখোশ

আর মশলা যা সূচনা করে উৎসব...)  

                 

মিনার চত্বর— (সময়কে পার হতে দাও...

স্থাণের নামে)

—ধ্বংসের যত শবদেহ,

এই কি বৈরুতের মুখ?

—এবং এই

যে একটি ঘণ্টা, অথবা একটি আর্তনাদ?

—একজন বন্ধু?

—তুমি? স্বাগত।

 

তুমি কি ভ্রমণ করেছ? তুমি কি ফিরে এসেছ? নতুন কি ঘটেছে তোমার?

—একজন প্রতিবেশী খুন হয়েছেন.../

 . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . 

একটি খেলা/

—তোমার পাশা থেকে কষ বেরোচ্ছে।

—আহ, নেহাতই একটি সমাপতন।

. . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . . 

অন্ধকারের যত স্তর

আর কথারা টেনে আনে আরো যত কথা।                                              

 

আরবি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ : খালেদ মাত্তাওয়া,

আদোনিসেনির্বাচিত কবিতাথেকে গৃহীত (ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস, ২০১০)


 

গ্রেনফেল টাওয়ার, জুন, ২০১৭ ।। বেন ওকরি

 

এটা ছিল যেন আকাশে পুড়ে গেল একটি দেশলাই বাক্স।

আকাশে কালো ও দীর্ঘ আর পুড়ে যাওয়া ভষ্মরেখা। 

পুষ্পিত গাছের কাণ্ডের ভেতর দিয়ে তুমি দেখেছ সেই আগুন। 

গির্জার গৈরিক চূড়ার ওপর থেকে তুমি দেখেছ সেই আগুন।

তুমি দেখেছ সেই আগুন বেঁচে যাওয়া ভাগ্যবানদের অশ্রুতে।

তুমি দেখেছ সেই আগুন বেঁচে যাওয়া ভাগ্যবানদের ক্ষোভে।

আগুনে ছাই হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর পোস্টারের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে

তুমি দেখেছ সেই আগুন।

আর আগুন থেকে বাঁচার জন্য যারা লাফ দিয়েছিল তাদের নিজস্ব মৃত্যুতে

(বহুতল ভবন থেকে নিচে)

তাদের পোস্টারের পাশ দিয়ে যেতে যেতেও তুমি দেখেছ সেই আগুন।

জানালার ভেতর থেকে আগুনের শিখার টিভি চিত্রের ভেতর থেকে তুমি দেখেছ সেই আগুন।

পত্রিকার পাতায় বহুতল ভবনের ছাদের এলুমিনিয়াম আস্তরণ

থেকে ফেটে পড়া অগ্নিশিখার উদ্গারে তুমি দেখেছ সেই আগুন।

তুমি শুনেছ সেই আগুন রাস্তার সজোর কণ্ঠস্বরে।

বাতাসে বিচার চেয়ে আর্ত কান্নায় তুমি শুনেছ সেই আগুন।

রাস্তার যত শুঁড়িখানা আর ভূ-গর্ভস্থ কুঠুরিতে তুমি শুনেছ সেই আগুন।

নারীদের হাহাকার আর রাস্তায় ঘুরে মরা অনাথের মৌন আর্তনাদে

তুমি শুনেছ সেই আগুন।

তুমি সেই আগুন দেখেছ তোমার ঘুমহীন শিশুর ভেতরে

যে ভয় পাচ্ছে সেইসব ভুতদের যারা আজো এই পোড়ো মহল্লায়

ঘুরছে আর চেষ্টা করছে সেই আগুন থেকে পালাতে

যা একদিন এক বিকট কালো আর শ্বাসরোধকারী ধোঁয়া হয়ে এসে

তাদের সামনে দাঁড়াল।

তুমি দেখেছ সেই আগুন তোমার স্বপ্নে

যে স্বপ্নে মৃতরা এসে জিজ্ঞাসা করছে

যে গরীবের বেঁচে থাকার সত্যিই কোন অর্থ আছে কিনা।

দাউ দাউ আগুনের লেলিহান শিখায়

গরীব যেখানে অসতর্ক পুড়ে মরে। 

 

কিন্ত যখন তুমি সেই আগুন দেখেছ একদম নিজেরই চোখে

তখন কি মনে হল যে যা কিছু দেখেছে চোখ

তার কোনো অর্থ হয় না অর্থ হতে পারে না আর হবেও না কোনো অর্থ।

তুমি আকাশে দেখেছ সেই আগুন, দীর্ঘ ও কালো ও ঝলসানো।

তুমি গুণেছ যত জানালা আর গুণেছ ভবনের যত তল।

আর দেখেছ ভবনের আস্তরণের আধপোড়া হলদে তরল।

আর যা কিছু দেখেছ তুমি দেখা যায় শুধুই দুঃস্বপ্নে।

যেন বা কোনো চাকচিক্যময় পৌরভবনের গভীরতায় সহসা হানা দিল

যুদ্ধাঞ্চল।

যেনবা এই নগরীতে সহসা রোপিত হল কোনো রণাঙ্গন।  

শুধুমাত্র নিজ চোখে দেখে কেউ বুঝতে পারে

কিভাবে দুঃস্বপ্ন দিনকে পাল্টে দেয় রাতে আর

গোটা পৃথিবীকে উল্টে-পাল্টে দেয়।

 

যারা বেঁচেছিল তারা মৃত এখন

যারা শ্বাস নিচ্ছিল তারা পালিয়েছে এই জীবিত বসুধা থেকে

গরীব কিভাবে মরে যদি দেখতে চাও,তবে এসো এই গ্রেনফেল টাওয়ারে

দ্যাখো এই টাওয়ার আর পৃথিবী বদলানোর স্বপ্নকে মুকুলিত হতে দাও

 

আগুনে ঝলসানো সে মহল্লার মানুষেরা

আজ গোটা তল্লাটকে বলছে ‘শ্মশান।’

আমাদের যুগের যত চোরা ঢেউ যা প্রকাশ করে।

 

বিত্তহীণ মানুষ যারা ভেবেছিল যে ধনীদের দলকে ভোট দিলে

তারাও বেঁচে-বর্তে যাবে।

বিত্তহীন যারা সংবাদপত্রের সব কথাকেই বিশ্বাস করেছিল।

সভয়ে নেতাদের সব কথা শুনেছে যারা।

এক কামরার ঘরে ঠাসাঠাসি বাস করা যে মানুষগুলো

সন্তানের এতটুকু সুখের স্বপ্ন দেখে চলে।

গরীব কে? সেতো তুমি আর আমি

তুমি তোমার পুষ্পোদ্যানে,

বই ঠাসা তোমার ঘরে তুমি,

দূর থেকে তাকিয়ে আছ এক নিয়তির দিকে

যা অন্য কোনো নামে কাছে টানছে।

মাঝে মাঝে একটি জাতিকে তার গোপন লজ্জা থেকে

বাঁচাতে প্রয়োজন হয় কোনো ভাবমূর্তি

আর এখানে রয়েছে অভিশপ্ত এই বহুতল টাওয়ারের

সিঁড়ি অথবা কক্ষগুলোয় পুড়ে মরা

প্রতিটি মানুষের নাম।

যারা জানেই না কেনো মরল তারা,

অথবা কিভাবে হয়েছে প্রতারিত।

তারা তো মরেনি যখন মরেছে তারা; মৃত্যু ঘটেছিল

তাদের ঢের বহু আগেই।

পুড়ে মরা এ মানুষগুলোর মৃত্যু বহু আগেই অঙ্ক কষা হয়ে গেছিল

সেইসব মানুষদের মস্তিষ্কে যাদের দ্যাখেনি এই দগ্ধ অভাগারা।

তাদের মৃত্যুর অঙ্ক কষা হয়েছিল মুনাফা রেখায়।

মৃত্যু ঘটেছিল আইনের পাতায়।

মরেছে তারা সার সার যেহেতু কারো কারো দরকার পড়েছিল মুনাফা।

দরকার ছিল টাকা তৈরি ও জমানোর।

 

যারা বেঁচে ছিল তারা মৃত এখন

যারা শ্বাস নিচ্ছিল তারা পালিয়েছে এই জীবিত বসুধা থেকে।

গরীব কিভাবে মরে যদি দেখতে চাও, তবে এসো এই গ্রেনফেল টাওয়ারে।

দ্যাখো এই টাওয়ার আর পৃথিবী বদলানোর স্বপ্নকে মুকুলিত হতে দাও।

 

অভিজাতরা এই টাওয়ারকে বলত কদর্য; তারা একে বলত চক্ষুশূল,

চারপাশে সফেদ, সুন্দর মানুষেরা বাস করছে তাদের সফেদ, সুন্দর ঘরে।

চাইত না তারা পাশের ঐ বিশ্রী টাওয়ার কমিয়ে দিক তাদের বিলাসী ঘরের দাম।

অভিজাত, বিলাসী চোখ থেকে কদর্য টাওয়ারটি লুকাতে

এক কোটি টাকা খরচ করে টাওয়ারটি ঢাকা হলো এলুমিনিয়াম খাঁচায়।

অথচ পরীক্ষা করা হল না যে টিকবে কিনা এই বিপুল এলুমিনিয়াম পাত

যদি সহসা আগুন ধরে যায়?

তবে গরীবের পলেস্তারা খসে পড়া পুরনো টাওয়ার

এই এলুমিনিয়াম আবরণীতে সুশ্রী দেখিয়েছে বটে,

হ্যাঁ— মনোরমা দেখিয়েছে তাকে।

অথচ সেই ২৪-তলা বিত্তহীণ ভবনে একটিও জলকামান ছিল না।

একটিও সতর্ক সঙ্কেত বেল কাজ করেনি সেই ২৪-তলা ভবনে।

একটিও আগুন থেকে পালানো সিঁড়ি ছিল না সেই ২৪-তলায়।

শুধু একটিই সিঁড়ি নরকে বিন্যস্তকৃত, নরকের অনন্ত অগ্নিকুণ্ডের

অপেক্ষায়। এই তো আমাদের সময়ের গল্প।

উপরে সবকিছু সুশোভন রাখো আর ভেতরটা মৃত্যুফাঁদ।

ভেতরটা মৃত্যুকূপ হোক। শুন্যগর্ভতাই হোক সুশ্রাব্য,

ফাঁকাকেই করো সুশ্রী। সেটাই তারা সবাই মিলে বলবে,

কেমন দেখতে এটা, কেমন শুনতে,

শুধু যাপনের উপযুক্ত কিনা— দেখা হবে না সেটাই।

তবে তুমি যদি সত্যিই তাকাও তবে দেখতে পারো।

যদি তুমি সত্যিই কান পাতো, তবে শুনতে পারো।

তোমাকে দেখতে হবে আস্তরণের নিচে কী আছে?  

চারপাশে আস্তরণ শুধু।

রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বুদ্ধিজীবীতার আস্তরণ— যা কিছু দেখতে সুন্দর। 

অথচ নেই কোনো কেন্দ্রবিন্দু, কোনো হৃদয়, শুধুই নৈতিকতার ফাঁকা বুলি কপচানী।

এত কথা বলে তারা যত ফাঁকা কথা।

অঙ্গভঙ্গি করে তারা যত অগভীর মুদ্রা।

পরিদর্শনের জন্য পুড়ে যাওয়া টাওয়ারে আসা তারা।

যদিও আত্মা আসে না তাদের— শুধু শরীরের আসা।

 

যারা বেঁচে ছিল তারা মৃত এখন

যারা শ্বাস নিচ্ছিল তারা পালিয়েছে এই জীবিত বসুধা থেকে।

গরীব কিভাবে মরে যদি দেখতে চাও, তবে এসো এই গ্রেনফেল টাওয়ারে।

দ্যাখো এই টাওয়ার আর পৃথিবী বদলানোর স্বপ্নকে মুকুলিত হতে দাও।       

 

আজ এখানে যত কণ্ঠস্বর আছে তাদের

কথা বলতেই হবে— মৃতদের স্বপক্ষে তাদের বলতেই হবে।

মৃতদের স্বপক্ষে। মৃতদের স্বপক্ষে।

দ্যাখো ওদের ছবিগুলো দেয়ালে সরলরেখা জুড়ে টানানো।

দারিদ্র্য তার নিজস্ব বর্ণে, নিজস্ব জাতিগত পরিচয়ে।

এই পুড়ে মরা মানুষগুলো ছিল মুসলিম ও ক্রিশ্চিয়ান, কালো ও সাদা আর মধ্যবর্তী আরো যত গাত্রবর্ণও ছিল।

ওরা ছিল বয়সে তরুণ এবং সুন্দর এবং মধ্যবয়সী।

মেয়েরা কেউ কেউ পুড়ে মরেছে তাদের সেরা পোশাকটি পরনে

আর তাদের হৃদয় উন্মুক্ত ছিল ভবিষ্যতের দিকে।

নাতি-নাতনী সহ পুড়ে মরেছেন এক বৃদ্ধ।    

ছিল তিন বছরের শিশু আমায়া টুক্কু।

পৃথিবীর সব মিথ্যাকে দেখার আগেই পুড়ে ছাই হয়েছে সে।

আরো কত কত জীবিত মানুষেরা আজ শুধু নাম

যারা স্বপ্ন দেখেছিল খ্যাতি, সুখ, উচ্চশিক্ষা অথবা প্রেমের।

আজ তারা অসূয়ার দগ্ধ খোলে ছাই হয়ে আছে।

ছিল দুই সুশ্রী, তরুণ ইতালীয়

যারা এই নরককুণ্ডে ছিল আর তাদের মোবাইল ফোন খোলা ছিল      

তাদের বন্ধুদের কাছে।

মুনাফার ধোঁয়া তাদের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করলে,

এক মা বহুতল ভবনের অনেক উঁচু থেকে তার বাচ্চাকে

ছুঁড়ে দিলেন নিচে যদি তবু বাঁচে আগুনের হাত থেকে!

অনেকে ঝাঁপ দিল জানালা থেকে।

আর অনেকেই মারা গেল ঘরের ভেতরে থেকে

যাদের বাইরে থেকে ঘরের ভেতরেই থাকতে বলা হয়েছিল

বাঁচার জন্য।

আগুন ধরে যাওয়া শরীরে সেই ছোট্ট মেয়েটি

বিশ তলা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাঁচার জন্য।

আর কিছু কি বলার দরকার আছে?

 

যারা বেঁচেছিল তারা মৃত এখন

যারা শ্বাস নিচ্ছিল তারা পালিয়েছে এই জীবিত বসুধা থেকে।

গরীব কিভাবে মরে যদি দেখতে চাও,তবে এসো এই গ্রেনফেল টাওয়ারে।

দ্যাখো এই টাওয়ার আর পৃথিবী বদলানোর স্বপ্নকে মুকুলিত হতে দাও।

 

আর সবসময় তো রয়েছেই সেই অসঙ্গতি

যা কিছু ঘটে আর যা আমাদের বলা হয়—

এ দু’য়ের মাঝে আছে সেই অসঙ্গতি।

অগ্নিকাণ্ডে মৃতের সংখ্যা তাই কিছুতেই ত্রিশের উপর উঠল না।

সত্য কথা আজকাল সোনার তাল খুঁজে পাওয়ার

চেয়েও দূর্লভ।

রাতের অন্ধকারে যে দেহগুলো উদ্ধার করা হয়েছে

তা এখনো অন্ধকারেই।

আঁধারে রাখ ধোঁয়া আর আঁধারে রাখ মস্তক।

বেঁচে ছিল যারা তারা মৃত এখন।

আর টাওয়ার যখন দাউ দাউ জ্বলছিল আগুনে

তারা লাফ দিয়ে পার হচ্ছিল

সিঁড়িতে জমা যত লাশের স্তপ।

কারণ সেখানে ছিল পীচ কালো অন্ধকার।

বেঁচে গেল যারা

তারা এখন এক ক্রিড়া কেন্দ্রের

মেঝেতে ঘুমোয় শরণার্থীর মতো।     

ঘুমোয় তারা অন্ধকারে ভয় পাওয়া জন্তুর মতো।

উচ্চপদধারী কেউ আসেন,

কথা বলেন পুলিশ আর সাহসী অগ্নি নির্বাপকদের সাথে,

এড়িয়ে যান শুধু ক্ষতিগ্রস্তদের,

যাদের হৃদয় আতঙ্কে ভরে উঠেছে কানায় কানায়। 

জীবন্ত পৃথিবী থেকে যারা শ্বাস নিচ্ছিল তারা সবাই পালিয়েছে।

কিন্তু যদি তুমি গ্রেনফেল টাওয়ারে যাও, যদি তুমি

টেনিস খেলা আর তোমার নিখুঁত ডিনার থেকে

যাও সেই একদা প্রাণবান টাওয়ারের কালো কঙ্কালের কাছে,

ইমারতের সেই হাড়গোর বের করা কাঠামোটি দেখবে

কেমন অপ্রাকৃত দাঁড়িয়ে আছে বাতাসে,

অন্য আর দশটা অমন আবাসনের জন্য

একটি সতর্ক সঙ্কেত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে।

শোকে ভারি সেই বাতাস তুমি ফুসফুসে টেনে নেবে।

মেয়েদের স্বতঃস্ফূর্ত কান্না আর নিথর শিশুদের

উদ্দেশ্যহীন হাঁটা-চলা এবং পুরুষেরা চোখ থেকে সন্তর্পণে

মুছছে জল এবং লোকেরা বিশ্বাসহীন চোখে আকাশে তাকিয়ে আছে

পুড়ে যাওয়া এই অশুভ ইমারতের দিকে।

 

তুমি দেখবে সবুজ পাতা ভরা যত পরিষ্কার গাছ

আর মৃত্যুগন্ধী বাতাসকে পরিষ্কার করতে ধূপকাঠি পোড়ানো

বাতাসে শ্বাস নেবে।

দেখবে তুমি অর্পিত ফুলের গোছা

আর মৃতদের জন্য শোকবাণী সাজানো যত দেয়াল কাগজ

আরো দেখবে মৃতদের জন্য পুড়ছে যত মোম

দেখবে সম্প্রদায় শব্দটির যথার্থ অর্থ।

 

খাবার ভাগাভাগি করা হচ্ছে আর বলা হচ্ছে যত গল্প

স্বেচ্ছাসেবকেরা সর্বত্র

বাতাসে ফুলের নির্যাসের সাথে

দাহকারী চুল্লীর ঘ্রাণ মিশে আছে। 

যদি তুমি দেখতে চাও কিভাবে গরীব মরে,

তবে এসে দেখে যাও গ্রেনফেল টাওয়ার।

 

সেই সব পরিসংখ্যানের একটা অর্থ দাঁড় করানোর চেষ্টা করো

কারণ আত্মা বাঁচে যেখানে সত্য হত্যা করতে পারে না কোনকিছু।

মিথ্যে এলুমিনিয়াম আবরণীতে ইমারত ঢাকতে

খরচ হয়েছে এক কোটি পাউন্ড

অথচ আগুন ধরার পর শত শত মানুষ হারিয়েছে সর্বস্ব।   

পঞ্চাশ লাখ পাউন্ড রিলিফে দেয়া হচ্ছে

একটি জাতির বিশ্বাস বদলানো প্রয়োজন।

কোনো কোনো ভাবমূর্তি দান করে জীবন

আর কোনো কোনো ভাবমূর্তি করে হত্যা। 

এই কৃচ্ছ্রতার যুগে

হৃদয় নিজেকে মেলে দেয়

রাজনৈতিক দক্ষতার উর্দ্ধে।

গরীবকে তো মরতেই হয় অন্যের সমৃদ্ধির জন্য।

নার্সারি আর পাঠশালা ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে এই দেশ থেকে।

সূত্রে আকার পাচ্ছে এক বিচিত্র সময়।

ক্ষমতার বধিরতার উপর ঝুলছে নিয়তির তলোয়ার।

দ্যাখো এই টাওয়ার,

আর পৃথিবী-বদলে দেওয়া এক চিন্তাকে পুষ্পিত হতে দাও।

 

 

 

//জেডএস//
সম্পর্কিত
দোআঁশে স্বভাব জানি
প্রিয় দশ
প্রিয় দশ
সর্বশেষ খবর
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাস আর নেই
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
পথের পাশের বাহারি শরবতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কতটা?
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
মন্ত্রণালয়ে সভা করে ধানের দাম নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ