X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১
শুক্রবারে ক্ল্যাসিক

ম্যাকিয়াভেলির প্রিন্স || ক্ষমতা বাসনার স্বরূপ

জাহেদ সরওয়ার
০২ মার্চ ২০১৮, ১০:৫১আপডেট : ০২ মার্চ ২০১৮, ১০:৫৫

ম্যাকিয়াভেলির প্রিন্স || ক্ষমতা বাসনার স্বরূপ
প্রায় সাড়ে পাঁচশ বছর হয়ে গেল নিকালো মেকিয়াভেলির ‘প্রিন্স’ বইটির। এটি এখনো পর্যন্ত জীবন্ত বইগুলোর মধ্যে অন্যতম। যেন এক সুপরিবাহি বিদ্যুৎতাড়িত। যিনিই বইটি পড়েন প্রভাবিত না হয়ে পারেন না। হয়ত কেউ এড়িয়ে যান সাক্ষাৎ শয়তানের লেখা মনে করে। আবার কেউ এটাকে নিজের সহচর করে নেন।

ছোট ছোট ভাগ করা ছাব্বিশটি অধ্যায়ে বিভক্ত এই বইটি। এক দেড় পৃষ্ঠা থেকে শুরু করে তিন চার পৃষ্ঠার মধ্যে তিনি একেকটা বিষয়ে আলাপ শেষ করেছেন। বইটি লেখার আগের ম্যাকিয়াভেলির অপ্রস্তুত অবস্থা, বিষণ্নতায় উদ্দীপ্ত সময়ের কথা অনেকেই জানেন। অল্প কথায় অনেক কিছু বোঝানোর তাড়না। তাই যুক্ত হয়েছে ক্ল্যাসিক গতিময়তা। প্রতিটি শব্দ ও বাক্য হয়ে উঠেছে ইশারাময়, অব্যর্থ। ম্যাকিয়াভেলি কি শুধু সিদ্ধান্ত দিয়েছেন কীভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর ও রক্ষা করতে হবে? তা তো নয় তিনি সাথে সাথে উদাহরণ দিয়েছে তৎকালীন ইতালির রাজ্যগুলো বা ফ্রান্স স্পেনের ইতিহাস বা চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতি থেকে। বইটি সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলেই সবাই উদাহারণ টানবে বইটির একটা সংস্করণে মুসোলিনি ভূমিকা লিখেছিলেন। বইটি হিটলারেরও নাকি নিত্যপাঠ্য ও শয্যসঙ্গী ছিল। এরা কারা? এদের শাসনকালের ইতিহাস আজ সর্বজনবিদিত। তাহলে কি আজকে এই সিদ্ধান্তে আসতে হয় গত সাড়ে পাঁচশ বছর ধরে পৃথিবীর রাজনীতি ম্যাকিয়াভেলির ‘প্রিন্স’ দ্বারা প্রভাবিত অথবা মানুষের রাজনীতির চালিকাশক্তি ক্ষমতার এনাটমি তিনি আবিষ্কার করেছিলেন বলে ক্ষমতার ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গেলেই আজকে এই ছোট্ট পুস্তিকাটার কথা টানতে হয়?

তিনি সেই সময়ে রাজতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে যে ছলচাতুরি করতে হয় সে সব বিশদে আলোচনা করলেও ক্ষমতার যে এনাটমি করেছেন তাতো এর পরবর্তী বুর্জোয়াদের ক্ষেত্রেও পরিলক্ষিত। যা পরিবর্তন হয়েছে তা অবশ্য ক্ষমতার মোড়ক। তিনি শাসককে প্রয়োজনে অস্ত্রের ব্যবহার, নিজস্ব সেনাবাহিনি গড়ার তাগিদ, অধিকৃত রাজ্যকে সম্পূর্ণ লুট করা, প্রপাগান্ডার ব্যবহার, ধর্মের যথেচ্ছ ব্যবহার কিন্তু যাজক সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা, মানুষের জন্মগত কপট স্বভাব, ভাড়াটে সেনাবাহিনির প্রতি অবিশ্বাস, নারীদের প্রতি তাঁর অনপোনেয় সিদ্ধান্ত, শাসককে সিংহ ও শৃগাল হওয়ার তাগাদা যেমন দিয়েছেন। তেমনি এমন কিছু বাক্য ব্যবহার করেছেন যাতে মনে হতে পারে তার সিদ্ধান্তগুলো স্ববিরোধী। আবার তিনি বলছেন, সহ-নাগরিকদের হত্যাকাণ্ডকে, বন্ধুদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতাকে এবং বিশ্বাস, দয়া ও ধর্মভাব বর্জিত সত্তাকে গুণ বলা চলে না। এসব পদ্ধতির দ্বারা হয়ত ক্ষমতালাভ করা যায় কিন্তু তাতে গৌরব আসে না। তিনি আরও বলছেন, উল্লেখিত গুণগুলো সম্পর্কে আমি বলি শাসকের পক্ষে বদান্যতা বলে পরিচিত হওয়া ভালো। অথবা, পূর্বে উল্লেখিত আরও কিছু গুণের কথায় এসে আমি বলি যে প্রতিটি শাসকের অবশ্যই ইচ্ছা থাকবে দয়াপরবশ হতে, নির্দয় হতে নয়।

বইটির নাম ‘প্রিন্স’। তিনিও একজন প্রিন্সকে খুশী করবার জন্যই এই লেখাটি লিখেছিলেন। রাজতন্ত্রের তথা শাসক শ্রেণির কৃপা-দৃষ্টির জন্য তিনি এই বইটি লিখেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন সেই সময়ের বিশৃঙ্খল ও শত্রুশাসিত স্বভূমি তিনি প্রিন্স লরেঞ্জোকে দিয়ে উদ্ধার করবেন। এবং তিনি হবেন তার প্রিয় পাত্র। ম্যাকিয়াভেলি এই বইটি দিয়ে প্রিন্স লরেঞ্জোর কৃপাদৃষ্টি কাড়তে না পারলেও গত পাঁচশ বছর ধরে রাজতন্ত্র অথবা বুর্জোয়া শাসকদের কৃপাদৃষ্টি কাড়তে পেরেছিলেন। ‘দ্য প্রিন্স’এর একটি প্রস্তাবনায় লর্ড অ্যাকটন একসময় বলেছিলেন ম্যাকিয়াভেলির সবচেয়ে প্রামাণ্য ব্যাখ্যাকার হচ্ছে পরবর্তীকালের সামগ্রিক ইতিহাস। বিগত তিন-চার শতকের খ্যাতিমান লেখক ও রাষ্ট্রনীতিবিদদের বহু উক্তি দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন কী বিরাট প্রভাব মেকিয়াভেলি ফেলেছিলেন তাঁর উত্তরসূরীদের জীবন ও চিন্তাধারায়। ম্যাকিয়াভেলির মানুষ মানেই পুরুষ। ম্যাকিয়াভেলির মানুষ মানেই শাসক। ম্যাকিয়াভেলির কাছে সাধারণ শোষিত শ্রেণি আর নারীদের কোনো মূল্য নাই বা ছিল না। কারণ সম্ভবত সেটাই তাঁর শ্রেণিগত সমস্যা। স্বশ্রেণিকে রক্ষা ও বহাল রাখাই ছিল তার সমস্ত চিন্তাজুড়ে।

সাধারণ মানুষ সম্পর্কে তাঁর ধারণা খুবই নিম্নমানের সামন্তীয়। সপ্তদশ অধ্যায়ে তিনি বলেন, সাধারণভাবে মানুষ সম্পর্কে বলা যায় যে তারা অকৃতজ্ঞ, বাচাল, কপট, বিপদ এড়ানোর জন্য ব্যগ্র ও অর্থলোলুপ।

সামন্তীয় শাসনতন্ত্রে মানুষ কখনোই গুরুত্ব পায়নি। তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল রাজ্য, জমি  আর সম্পদ। আর এসব পাহারা দিতে এসব বাড়িয়ে তুলতে স্রেফ ব্যবহার করা হত সাধারণ মানুষকে। সাধারণ মানুষ সবসময় শাসকদের কাঁচামাল।

পঞ্চবিংশ অধ্যায়ে তিনি বলেছেন, যে শাসক নিজেকে সম্পূর্ণভাবে ভাগ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত করেন তিনি ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হন। সাবধানী হওয়ার চেয়ে দুর্দান্ত হওয়া ভাল। ভাগ্য হল স্ত্রীলোকের মতো। যদি স্ত্রীলোকের উপর প্রভূত্ব করতে চাও তবে তাকে পাশবিক শক্তিতে জয় করবে। নারী নিজেকে জয় করতে দেয় বলবানদেরই দ্বারা, যারা উদাসীন তাদের দ্বারা নয়।

বলার ভঙ্গির কারণে ম্যাকিয়াভেলির প্রতিটি কথাই অমর বাণীর মতো। কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই অনেক বিসদৃশ ধরা পড়বে। 

সাধারণ মানুষ সম্পর্কে মেকিয়াভেলি যা বলেন তার সাথে তর্ক করা বৃথা এটা তাঁর নিজস্ব ধরণের সমস্যা। সাধারণ মানুষ নদীর স্রোতের মতো। তাকে প্রবাহিত করে শাসক শ্রেণির আবহাওয়া। একটা পরিবার, একটা অফিস যেমন কর্তার মতানুযায়ী চলে তেমনি একটা রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণির তৈরি আইন কানুন। শাসন ব্যবস্থাই সে দেশের মানুষগুলোর প্রতিবেশ নির্মাণ করে। এই জন্য প্রায় বলতে শোনা যায় অমুক দেশের মানুষগুলো ভালো। রাস্তায় কিছু পড়ে থাকলেও চুরি করে না। তাদের নিজেদের এত ভালো অবস্থা যে তারা অন্যের সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করে না। কোনো দেশের শাসক শ্রেণি চোর বা ভিক্ষুক স্বভাবের হলে সে দেশের মানুষের মধ্যেও তা পরিলক্ষিত হবে। কারণ শাসক শ্রেণির স্বভাব জনতার ভেতরও সংক্রামিত হয়।

অন্যদিকে নারী সম্পর্কে তাঁর ধারণা একেবারেই সেকেলে। নারীকে তিনি মানুষই মনে করেন না।  নারী যেন এক প্রভূত্ব করার জিনিস। জয় করার জিনিস। শুধু বলবানদের ভোগ্য। হয়ত তিনি বর্বরদের চোখে দেখেন তাদের। কোনো সভ্য মানুষের মতো নয়। নারীকে এই রকমভাবে দেখা সেটা পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। নারীকে বিভিন্ন চিহেৃ চিহৃায়ন করে রাখা সেটাও পুরুষতন্ত্রের স্বার্থে। যেহেতু ক্ষমতা পুরুষের হাতে। পুরুষও নারীকে তার স্বার্থ অনুযায়ী নির্মাণ করে।

তার কাছে অপারগত দুর্বলতার কোনো স্থান নাই সেটা বুঝবার ক্ষমতাও ম্যাকিয়াভেলির নাই। তিনি স্বার্থান্ধ ও ক্ষমতান্ধ। নিজের শ্রেণিকে টিকিয়ে রাখা বা ক্ষমতার অহংকে টিকিয়ে রাখার জন্য যত নিষ্ঠুর পথ আছে সবই ব্যবহার করতে বলেছেন ক্ষমতাবানদের।

তবে এর ভেতর দিয়ে শোষিত শ্রেণি, সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণি ক্ষমতাবানদের অবিশ্বাস করতে শিখবেন। ক্ষমতাবানরা যে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা বা অর্জন করার জন্য কত ছলচাতুরি করতে পারে। শাসক মানেই যে শৃগাল আর সিংহের সমাবেশ তারা আদৌ মাঙ্গলিক কেউ না তারা যা বলে তা সর্বৈব ভান, ভণ্ডামি ছাড়া কিছু নয়। জনগণের ট্যাক্সেও টাকায় কেনা অস্ত্র, জনগণের ট্যাক্সেও টাকায় কেনা সেনাবাহিনি বা সরকারের অন্যান্য বাহিনি তাদের কোনো কাজে আসবে না। ক্ষমতাবানদের জাতীয়তাবাদ বা অন্যান্য চেতনা স্রেফ প্রপাগাণ্ডা ছাড়া কিছু না। তাঁরা ধার্মিক নয় ধার্মিকের ভান করে মাত্র। ধর্মকে তাঁরা ক্ষমতা রক্ষার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে মাত্র। শাসক শ্রেণিকে ক্ষমতা অর্জন ও টিকিয়ে রাখার পরামর্শ দিতে গিয়ে তিনি বস্তুত তাদের মুখোশ খুলে দেন। ম্যাকিয়াভেলির ‘প্রিন্স’ যুগে যুগে ক্ষমতাবানদের অন্তর্লোক দুষিত করে দিলেও। সমাজে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি করে দিলেও শাসকদের লোভ লালসা ক্ষমতালিপ্সা আর মিথ্যাচার সম্পর্কে এক প্রামাণ্য দলিল হয়ে আছে। ম্যাকিয়াভেলির ক্ষমতাবাসনা অস্থায়ী। সেটারও প্রমাণ গ্রীক রোমান বৃটিশ অটোমান বা মোগল সাম্রাজ্যের পতন।

লেখক : কবি ও ভাবুক।

//জেড-এস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
শিলাবৃষ্টিতে ফুটো হয়ে গেছে ঘরের চাল, ফসলের ব্যাপক ক্ষতি
শিলাবৃষ্টিতে ফুটো হয়ে গেছে ঘরের চাল, ফসলের ব্যাপক ক্ষতি
ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক
ব্রিটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে বিএনপির বৈঠক
ন্যাটোর অংশীদার হতে আগ্রহী আর্জেন্টিনা
ন্যাটোর অংশীদার হতে আগ্রহী আর্জেন্টিনা
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পুকুর থেকে ৬ মাসের শিশুর লাশ উদ্ধার
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পুকুর থেকে ৬ মাসের শিশুর লাশ উদ্ধার
সর্বাধিক পঠিত
এএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
রেস্তোরাঁয় ‘মদ না পেয়ে’ হামলার অভিযোগএএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার