X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

দ্য আর্ট অব ওয়ার ।। নান্দনিক যুদ্ধবিদ্যা

জাহেদ সরওয়ার
১৬ মার্চ ২০১৮, ১১:১১আপডেট : ০৫ এপ্রিল ২০১৮, ১৫:৩৪

দ্য আর্ট অব ওয়ার ।।  নান্দনিক যুদ্ধবিদ্যা

প্রায় ২৫০০ বছর বইটির বয়স। এটি সাধারণ কোনো বই নয় । ফলে বহুপাঠক এই বইটিকে এড়িয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পাঠ করতে থাকলে বুঝা যায় এটা আসলে জীবনযুদ্ধেরই নান্দনিক প্রকাশ ও নির্দেশনা। বইটির লেখক পুরাতন চীনের যুদ্ধবিশারদ সান জু। যিনি একাধারে সেনাপতি ও যু্দ্ধবিধ ছিলেন। এই আড়াই হাজার বছর ধরে বইটি নীরবে-নিভৃতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তাবৎ সেনাবাহিনীর জেনারেলদেরকে। বইটিতে সান জুর আত্মবিশ্বাস দেখে ভিমরি খেতে হয়। তিনি বলেন, এই নিয়মগুলো মেনে চললে জিতবা নয়তো মরবা। তবে নীতিগতভাবে দেখলে সান জুর এই পরামর্শকে মনে হতে পারে মানুষের লোভ ও ক্ষমতা বাসনাকে উসকে দেবে এই বই। কিন্তু সেটাই মানুষের বেসিক। সেটাই সাইন্টিফিক। মানুষের জিনে আছে ভালোভাবে টিকে থাকার জন্য যুদ্ধের নকশা। জানি না মেকিয়াভেলি এই বইটি পড়েছিলেন কিনা ! তাঁর প্রিন্সেও এই বইটির ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। সান জুর ‘আর্ট অব ওয়ার’ আর প্রিন্স মিলিয়ে পড়লে একটা আরেকটার সিক্যুয়েল বলে মনে হয়। তবে যেহেতু শাসকদের মানস নিয়েই কাজ করেছেন মেকিয়াভেলি, তাই মনে হতে পারে প্রিন্স প্রথম পর্ব। অবশ্যই মেকিয়াভেলির নিজের একটা বইয়ের নামও ‘আর্ট অব ওয়ার’। সান জুর  আর্ট অব ওয়ারে ১৩টি অধ্যায়ের প্রতিটি অধ্যায়ের রয়েছে আবার অনেকগুলো পয়েন্ট। পয়েন্টের রয়েছে অনুপয়েন্ট। পরিকল্পনা, যুদ্ধঘোষণা, আক্রমণের কৌশল, পদক্ষেপ, শক্তি, দুর্বলতা ও শক্তিময়তা, আক্রমণ,  কৌশলের বিভিন্নতা, যুদ্ধের ময়দান,  নয়টি পরিস্থিতি, আগুনে আক্রমণ বা আগুনের ব্যবহার, গুপ্তচর বৃত্তি। এইভাবে তিনি বিষয়গুলোকে ভাগ করেছেন।

সান জু ছিলেন পুরাতন চীনের এক মার্সেনারি জেনারেল, স্ট্রেটেজিস্ট ও যুদ্ধ বিশারদ। বাঁশের চাটাইয়ের ওপর লিখে যাওয়া তার বই ‘দ্য আর্ট অব ওয়ার’ প্রায় দুহাজার বছর যুদ্ধবিদ্যার ছাত্রছাত্রীদের অবশ্য পাঠ্য। মাও সে তুং, জেনারেল গিয়াপসহ আরো অনেক জেনারেল এই বই থেকে প্রেরণা পেয়েছেন বলে— তাদের লেখায় স্বীকার করেছেন।

লেখাগুলো এতই অভিজ্ঞতাপ্রসূত যে, এখনো এই বইয়ের আবেদন কমে যায়নি। বইটির প্রথম অধ্যায়ের ১৯ নাম্বার পয়েন্টে বলা হয়েছে। আক্রমণোদ্যত অবস্থায় ভান করতে হবে অপ্রস্তুতের। খুব স্বাভাবিক থাকতে হবে যখন সৈন্য সমাবেশ করা হবে। এমন ভান করতে হবে যে শত্রুর থেকে আমরা অনেক দূরে অথচ তখন একেবারেই কাছাকাছি।

সান জুর যুদ্ধনীতির মধ্যে কোনো নীতি নৈতিকতার বালাই নেই। তিনি কোনো যুদ্ধ নীতিও মানেন না। যুদ্ধ মানেও হয়ত তাই। তবে সান জুর পরামর্শ যদি জীবনে গ্রহণ করতে হয় তাহলে জীবনেও কোনো নীতি নৈতিকতার বালাই থাকবে না। তবে বইটি শেষ হয় একধরনের অভিজ্ঞতা দিয়ে।  যেকোনো মানুষের ক্ষেত্রেই  সেটা সত্য হতে পারে।

সান জুকে নিয়ে একটা প্রচলিত গল্প বেশ জনপ্রিয়। সান জু  ছিলেন প্রাচীন চায়নার চি রাজ্যের বাসিন্দা। যুদ্ধবিদ্যা নিয়ে লেখালেখির সুবাদে তিনি তখন খ্যাতিমান। সেই সুবাদে একদিন তিনি অউয়ের রাজা হো-লুর ডাক পেলেন। হো-লু আগেই সান জুর ‘আর্ট অব ওয়ার’ পড়েছিলেন। তিনি সান জুর যে কাউকে সৈন্য বানানোর বিষয়টা দেখতে চাইলেন। সৈন্য হিসাবে দিলেন নিজের হেরেমখানার নর্তকীদের। সান জু  তাতেই সায় দিলেন।

রাজার হেরেমখানা থেকে ৩০০জন নর্তকীকে সান জুর সামনে সৈন্য বানানোর জন্য হাজির করা হলো। সান জুর তাদের দুইটি দলে ভাগ করে নিলেন। তার দুই দলের কমান্ডার করলেন সবচেয়ে দুই সুন্দরী নর্তকীকে। সান জুর তাদের অস্ত্র কিভাবে ধরতে হয় সেটা শিখিয়ে দিলেন। সান জু তাদের লেসন দিলেন আমি যখন চিৎকার করবো ‘সামনে’ বলে তখন আপনারা অস্ত্রকে বুক বরাবর করে সামনের দিকে বাগিয়ে ধরবেন। আমি যখন বলবো ‘বামে ঘুর’ তখন বামে ঘুরবেন। যখন বলব ‘ডানে ঘুর’ তখন ডানে ঘুরবেন। আর যখন বলব ‘উল্টা ঘুর’তখন সবাই পিছনে ফিরে দাঁড়াবেন।

নর্তকীরা সবাই উপরনিচ মাথা নাড়ালো। বলল, বুঝেছি আমরা। তারপরও সান জু আরো কয়েকবার বিস্তারিতভাবে বিষয়টা বুঝিয়ে দিলেন তাদের। তাঁরা আবারও বলল, সবাই বুঝেছেন। তাঁরা আসলে এটাকে একধরনের খেলা হিসাবে নিয়েছিলেন। সান জু সবার উদ্দেশ্যে বললেন, ডানে ঘুর। তার সিরিয়াস কমান্ড শুনে নর্তকীরা সবাই হাসতে হাসতে এ-ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ল। সে ধরে নিলেন এটা তাঁর নিজের দুর্বলতা সম্ভবত তিনি তার কমান্ড বুঝাতে পারেননি। তাই তিনি আরও কয়েকবার বিষয়টা তন্ন তন্ন করে বুঝিয়ে বললেন। এরপর আবার সবার উদ্দেশে কমান্ড করলেন ‘বামে ঘুর’।  এইবারও নর্তকীরা হাসতে হাসতে এ-ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ল। আদেশে সমস্যা হলে দোষ সেনাপতির। কিন্তু এই দোষ শুধরানোর পরও যদি সমস্যা থেকে যায় তাহলে সেই দোষ কর্মকর্তাদের। সুতরাং তিনি দুই সেনাপতি নর্তকীর গর্দান কাটার নির্দেশ জারি করলেন। রাজা হো-লু অদূরে বসেই সান জুর এই যুদ্ধক্রিয়া দেখছিলেন। তার প্রিয় দুই নর্তকীর গর্দান যাবার উপক্রম দেখে তিনি দূত পাঠালেন এই বলে যে সান জু যেন এইবার ক্ষান্ত দেন। কিন্তু সান জু বললেন, আমি মহারাজার নির্দেশেই সেনাপতি হিসাবে নিয়োগ পেয়েছি। আর আমি এখন যুদ্ধের মাঠে। যুদ্ধের মাঠে একজন সেনাপতি সবসময় রাজার প্রতিটি আদেশ অক্ষরে অক্ষরে মানতে বাধ্য নন। কারণ তাকে ততক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিতে হয় যুদ্ধ জয়ের জন্য।

সুতরাং তিনি দুই কমান্ডার নর্তকীর গলা কেটে ফেলেন এবং পরবর্তীতে দুইজনকে দুইদলের কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ দিলেন। এরপর তিনি আশ্চর্যজনক ফল পেলেন। তাঁর আদেশ অগ্রাহ্য করার কোনো পথ রইল না নতর্কীদের। তারাও বুঝল এটা কোনো খেলা নয়। এরপর তিনি তার যুদ্ধবিদ্যা শেখালেন তাদের। এবং যখন দেখলেন দল তৈরি তখন রাজার কাছে খবর পাঠালেন। সৈন্যদল এখন রাজার সেবায় পুরোপুরি তৈরি। রাজা নিজেও হয়ত বিষয়টা মস্করা হিসাবে নিয়েছিলেন। তিনি দুই নর্তকীর প্রাণসংহারে খানিকটা বেজার। তাই সান জু বলেন, মহারাজারা শুধু ফাঁকা বুলি শুনতেই পছন্দ করেন। বাস্তবায়নে সদা শংকিত থাকেন। আসলে রাজা হো-লু বুঝতে পারলেন সান জু কাজের মানুষ। তাকে তিনি সেনাপতি হিসাবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এরপর সান জু পশ্চিমের শক্তিশালী রাজ্য চু কে পরাজিত করে ইং পর্যন্ত এগিয়ে যান বীরদর্পে। উত্তরে তিনি চি আর চুন রাজ্যকে পরাজিত করেন। চায়নার সামন্তরাজদের তালিকায় অউ রাজ্যের অর্জনের অধিকাংশই সান জুর অবদান।

দুনিয়ার এমন কোনো ভাষা আছে কিনা সন্দেহ যে ভাষায় সান জুর এই ক্লাসিকটি অনুবাদ হয়নি। সান জুর যুদ্ধবিষয়ে লিখলেও এটার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে ক্রীড়া বা কর্পোরেট জগতেও। ২০০৩ সালে ক্রিকেটে বিশ্বকাপ জয়ী অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল ঘোষণা করেছিল, সান জুর যুদ্ধজয়ের কৌশল সফলভাবে কাজে লাগানোর ফলে এসেছে এবারের কাঙ্ক্ষিত বিজয়। ১৯৯৪ সালে ব্রাজিল ফুটবলে বিশ্বকাপ জয়ের ক্ষেত্রেও  নাকি সান জুর এই বইয়ের কৃতিত্ব রয়েছে । কার্যত যুদ্ধ এখন শুধু ময়দানে নয় বিভিন্নভাবে সম্প্রসারিত আর তাই সান জুর এই বইও বিভিন্নভাবে বিস্তৃতি ঘটছে। যেহেতু মানব অরজিনের যুদ্ধপ্রবণতার জিনগুলোর পদক্ষেপকে ফলো করেই তিনি বইটি লিখেছেন। ফলে মানবজাতি যতদিন বেঁচে থাকবে মনে হয় না— সান জুর এই বইয়ের চাহিদা কমবে। বাংলাভাষাতে এই বইটির চার-পাঁচটি অনুবাদ আছে। প্রায় প্রতি ভাষাতেই এই বইয়ের একাধিক অনুবাদ প্রমাণ করে, এই ক্লাসিকটির চিরগতিময়তা।

লেখক : কবি ও ভাবুক

অলঙ্ককরণ : আল নোমান

//জেড-এস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা