X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিষ

মশিউল আলম
৩০ আগস্ট ২০১৮, ১৫:৫৪আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০১৮, ১৬:০২

 

বিষ আমার সহকর্মী জামিল আহমেদ গত মঙ্গলবার রাতে আত্মহত্যা করেছে। ওর বাসায় আমরা ওর লেখা একটা চিঠি পেয়েছি। সেই চিঠিটা এখানে হুবহু তুলে দিচ্ছি:

মরা একটা গাছের মতো সোজা-সটান শুয়ে আছি আমি, ডালপালাহীন। ঘর অন্ধকার, লোড শেডিং। আমার ডান পাশে শুয়ে আছে আমার ষোল বছরের একমাত্র মেয়ে। বাম পাশে বউ, ছত্রিশ বছরের যুবতী। ওরা ঠান্ডা, নিথর, নিস্তব্ধ। দুজনেই অনেকক্ষণ ধরে মৃত। কে আগে মারা গেছে, কে পরে, আমি জানি না। হয়তো ডাক্তাররা কাল পোস্টমর্টেম করে বলতে পারবে। কিন্তু সেটা আপনাদের জন্য জরুরি নয়। আপনাদের জন্য এ খবরটাই যথেষ্ট যে ওরা মারা গেছে।

কিন্তু কে আগে মারা গেছে, কে পরে, তা আমার জন্য জরুরি। আমার জানতে ইচ্ছা করছে, মা মেয়ের মৃত্যু চেয়ে চেয়ে দেখেছে নাকি মেয়ে মায়ের মৃত্যু চেয়ে চেয়ে দেখেছে। মরার আগ-মুহূর্তে ওদের আবার বেঁচে ওঠার সাধ জেগেছিল কি-না! মা মেয়েকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিল কি-না! মেয়ে মাকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিল কি না! জানতে ইচ্ছা করছে, মরার সময় আমার কথা ওদের মনে পড়েছিল কি-না! ওরা আমাকে কিছু বলতে চেয়েছিল কি-না!

কিন্তু আমি আর কিছুই জানতে পারব না। ওরা চিঠি-চিরকুট কিছুই লিখে রেখে যায়নি। আমার জন্য কোনো মায়া কি ছিল না ওদের? এমন নিষ্ঠুরভাবে ওরা আমাকে নিঃস্ব করে রেখে গেল কেন?

দুজনে দুদিন ধরে লুকিয়ে লুকিয়ে সলা করে বিষ কিনে এনেছে, জানতেও দেয়নি আমাকে! কিন্তু কেন? কেন আমাকেও সঙ্গে নিল না? বলতে তো পারত, আমরা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তুমিও আমাদের সঙ্গে চলো। হায়! আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। টের পাইনি মা-মেয়েতে মিলে এত বড় একটা কাণ্ড করতে যাচ্ছে।

দুদিন ধরে ওরা কথাবার্তা বলেনি। আমার সঙ্গে নয়, নিজেদের মধ্যেও নয়।

না, তা ঠিক নয়। আমি যখন বাসায় থাকতাম না তখন নিশ্চয়ই ওরা নিজেদের মধ্যে আলাপ করত, নইলে এক সঙ্গে বিষ খাওয়ার ব্যাপারটা ঘটত না। আমি থানায় যাওয়ার কথা বলেছিলাম। বউ এমনভাবে চোখ বড় বড় করে তাকিয়েছিল, যেন আমি একটা ভয়ানক প্রস্তাব করেছি। আমি বুঝেছিলাম, মানসম্মানের ভয়ে সে থানা-পুলিশ করতে চায়নি। অথবা বিচার পাওয়া যাবে না ভেবে, আরও বড় বিপদের ভয়ে সে চুপচাপ থাকতে চেয়েছিল...

যা হবার হয়ে গেছে... কিন্তু মেনে নেওয়া, সয়ে নেওয়া.. না,ওর চোখেমুখে সেই আপসের ভাবও দেখতে পাইনি। ও আমার মুখের দিকে আর একবারও তাকায়নি। এখন বুঝতে পারছি, ভেতরে ভেতরে মা-মেয়ে মিলে কী সাংঘাতিক ষড়যন্ত্রটা আঁটছিল।

কিন্তু আমি কী দোষ করলাম? ওরা আমাকে বাদ দিল কেন?

এখন আমাকে মাঝখানে রেখে মা আর মেয়ে আমার দুই পাশে মৃত শুয়ে আছে। এতক্ষণে হিম ঠান্ডা হয়ে গেছে। আর কোনো উষ্ণতা ছড়াবে না ওরা। তবু, যেন ওদের গা ঘেঁষে শুয়ে থাকলেই আমি স্নেহের, বাৎসল্যের, প্রেমের উষ্ণতা অনুভব করব...

না না, এরকম ভাবিনি। আমি খুব বাস্তববাদী লোক। আমি জানি ওরা মারা গেছে, দেখতে পাচ্ছি একটা-দুটা মাছি ইতিমধ্যে ঢুকে পড়েছে ঘরে। জানি সকাল হতে হতে বাজে গন্ধ বের হতে শুরু করবে ওদের গা থেকে। আমি জানি ওরা এখন লাশ, লাশের স্বভাবে ওরা ফুলে উঠবে, ফেঁপে উঠবে, দুর্গন্ধ ছড়াবে।

তাহলে কেন আমি দুই লাশের মাঝখানে এভাবে শুয়ে আছি? কেন আমি দুই মৃতের মুখের গাজলা ফেনা যত্ন করে মুছে চুমো দিয়েছি তাদের কপালে?

রাত সাড়ে নটায় বাইরে থেকে বাসায় ফিরে কলিংবেল বাজালাম। লোডশেডিং তখনও শুরু হয়নি। কলিংবেল বাজছিল, কিন্তু কেউ দরজা খুলছিল না। অনেকক্ষণ ধরে বেল বাজিয়ে বিরক্ত হয়ে উঠলাম। তারপর দরজায় একটা হাত রাখতেই কপাটটা সরে গেল, ভেতর থেকে বন্ধ করা ছিল না। বাসায় ঢুকে দেখি ডাইনিংস্পেস অন্ধকার, বেডরুমের দরজা আলতো করে ভিড়ানো, আলো জ্বলছে ভিতরে। ব্যাপারটা কী হতে পারে, এরকম জিজ্ঞাসা হালকাভাবে মনে জাগল আমার। কিন্তু গুরুতর কিছুর কথা মনেই আসেনি।

বেডরুমের দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে দেখি মা-মেয়ে পরস্পরকে জাপটে ধরে শুয়ে আছে। ভাবলাম সেদিনের কথা ভেবে হয়তো কান্নাকাটি করছে। কিন্তু হঠাৎ নজরে পড়ল, বেডসাইড টুলের উপরে একটা শিশি । আমার বুক কেঁপে উঠল। ছুটে গিয়ে দুজনকে ধাক্কা মারলাম। দুটি দেহ আলাদা হয়ে দুদিকে ঢলে পড়ল। দুজনের মুখেই ফেনা, শরীর ঠান্ডা।

কিন্তু আমি চিৎকার করলাম না, অসম্ভব শান্ত মনে হল নিজেকে। যেন আমি আগে থেকেই সব জানতাম। কাউকে ডাকার কথা মনে এল না। মনে পড়ল না থানা-পুলিশ আত্মীয়-স্বজন কারও কথা। মাথাটা একদম ফাঁকা হয়ে গেল, একেবারে শূন্য! ধপ করে বসে পড়লাম। তারপর উঠে সারা ঘর তন্ন তন্ন করে কী যেন খুঁজতে লাগলাম। না, কী যেন বলছি কেন, চিঠি বা চিরকুট, কিছু-একটা তারা আমার জন্য নিশ্চয়ই রেখে গেছে।

কিন্তু না, সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছু পেলাম না। সিগারেট ধরালাম, বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। এক সিগারেটের আগুন থেকে ধরালাম আরেকটা। পরপর দুই গ্লাস পানি খেয়ে আবার ফিরে গেলাম ওদের কাছে; মুখের ফেনা মুছে দিলাম। কী মনে করে দুজনের ঠান্ডা কপালে একটা করে চুমু দিলাম।

আবার সিগারেট ধরালাম। সিগারেট খেতে খেতে বিষের শিশিটা হাতে তুলে নিলাম। বেশ বড়সড় শিশি। সিকি ভাগ বিষ এখনো রয়ে গেছে। আমার জন্য রেখে গেছে? আমার জন্যে এটাই কি তাদের শেষ বার্তা? যদি তুমি আমাদের ভালোবেসে থাক, তাহলে এটুকু খেয়ে নিও?

তাই, ঠিক তাই। এখন আমারও বিষ খাওয়া উচিত। হ্যাঁ, তখন আমার এই কথাটাই মনে হচ্ছিল।

কিন্তু বিষ আমি খেতে পারলাম না, সে চেষ্টাই করলাম না। বরং সিগারেট শেষ করে আবার এক গ্লাস পানি খেয়ে বসলাম ওদের পাশে। ফাঁকা মাথা নিয়ে বসে থাকলাম অনেকক্ষণ। তারপর উঠে কাপড় বদলে মুখ-হাত ধুয়ে ফ্রিজ খুলে খাবার বের করলাম। কিন্তু খাবার দেখে বমি চলে এল। তাড়াতাড়ি খাবার ফ্রিজে রেখে দিয়ে বমি আটকাবার জন্যে বেলকনিতে গিয়ে নিশ্বাস নিতে লাগলাম জোরে জোরে। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হল না। ছুটে এসে হড় হড় করে বমি করে দিলাম বেসিনে। বমি শেষ হলে বেশ করে কুলিকুচি করে মাথায় পানি ঢালতে লাগলাম। অনেকক্ষণ ধরে পানি ঢাললাম। কিন্তু ছিটবিটে গরম ভাবটা কিছুতেই গেল না; অথচ ফেব্রুয়ারি মাস। শেষে গোসল করলাম। তারপর মনে হলো, আমি একটা লাশ, কবরে শোয়ানোর আগে গোসল করানো হলো।

তখনি ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। বাসাজুড়ে ঝপ করে নেমে এল ঘন অন্ধকার। এমন জমাট অন্ধকার আমি জীবনে আর কখনো দেখিনি। মহল্লার সব কোলাহল কখন থেমে গেছে টের পাইনি, ভীষণ নিস্তব্ধ চারদিক। আমার বাসায় দুইটা লাশ। কী আর্শ্চয! আমার মেয়ে ও বউ এখন লাশ! আমি নিঃশব্দে খাটের উপর উঠে ওদের দুজনার মাঝখানে শুয়ে পড়লাম। সোজা, টান টান। ডালপালাহীন একটা গাছের মতো।

পাঠক! (প্রিয় সম্বোধন করে আর আপনাদের ডাকতে ইচ্ছা করছে না আমার। পৃথিবীর কাউকেই আমি আর কখনো প্রিয় সম্বোধনে ডাকব না।) আমি যথাসম্ভব শান্তভাবে সুস্থির মাথায় গুছিয়ে আপনাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছি। যদি শান্ত, সুস্থির থাকা, গুছিয়ে কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব না হয়, আমাকে দোষ দিতে পারবেন না...

অনেক দিন আগে আমি এরকম একটা গল্প লিখেছিলাম। হ্যাঁ, আমি গল্প লিখি। নির্লিপ্ত, নির্মোহ, নিরাসক্ত গল্প। সাহিত্য সমালোচকদের কাছ থেকে আমি শিখেছি, সাহিত্য সৃষ্টি করতে হয় নিরাসক্তভাবে।

হ্যাঁ, অনেক দিন আগে আমি নিরাসক্তভাবে একটা গল্প লিখেছিলাম। সারা বাংলাদেশের গ্রামে গঞ্জে শহরে বন্দরে তখন ধর্ষণের ধুম পড়ে গেছে। তখন আমি একটা গল্প লিখেছিলাম: ধর্ষণের আতঙ্কে উন্মাদ হয়ে এক ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রী ও ছয় মাসের শিশুকন্যাকে ধর্ষণকারীদের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে নিজ হাতে গলা টিপে মেরে ফেলেছে। তারপর নিজেও গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছে...।

বানিয়ে বানিয়ে লিখেছিলাম, আর পাঠকমহলে হই চই পড়ে গিয়েছিল। সাহিত্য সমালোচকেরা বলেছিল, বানানো গল্পই নাকি উত্তম শিল্প। তারা বলে, আর্ট কথাটার মানে কৃত্রিম, আগাগোড়াই বাস্তব হলে আর্ট হয় না। পেশায় আমি একজন সাংবাদিক। খবর লিখে জীবিকা সংগ্রহ করি আর সাহিত্য করার সময় ওই খবরের উপর রঙ চড়াই, আমার ইচ্ছামতো। বাঁধা দেওয়ার কেউ নাই। একটা সামান্য খবরের গায়ে রঙ চড়িয়ে আমি এমন গল্প লিখি যে সমালোচকেরা হাততালি দিয়ে বলে ওঠে, বাহ্ঃ এই তো ম্যাজিক রিয়ালিজম!..

আমি আবোল-তাবোল বকতে আরম্ভ করেছি। আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সত্যি বলছি, বিশ্বাস করুন, আমি আন্তরিকভাবেই আমার মনের অবস্থাটা আপনাদের জানাতে চাই।

আমার স্ত্রী ও কন্যা মরে পড়ে আছে। আমি ওদের মাঝখানে অনেকক্ষণ ধরে শুয়ে ছিলাম। তারপর একসময় আমার বুকের মধ্যে অজস্র কথার বুদবুদ উঠতে আরম্ভ করে দিল। কিন্তু এই গভীর রাতে কে আমার কথা শুনবে? মৃত দুটি মানুষের সঙ্গে আমি কথা বলব? না, ওরা যেমন আমাকে কিছুই না বলে চলে গেছে, তেমনি আমিও ওদের সঙ্গে জীবনে আর একটা কথাও বলব না...

...আমি এখন একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছি। সকালে ওদেরকে নিয়ে যাবে। সাদা ধবধবে কাপড়, কাফনের। হায়! কাফনের কাপড়কে আমি খুব ভয় পেতাম। এখন আর ভয় লাগছে না। আমার আর কোনো ভয় নাই, দুঃখ নাই, যন্ত্রণা নাই, আফসোস নাই...মানুষের আর কী কী থাকে যেন? আমার কিচ্ছু নাই...

না, আমি গোছাতে পারছি না। আমি আপনাদের যা বলতে চাচ্ছি তা বলতে পারছি না। আপনারা নিশ্চয়ই দেখতে পারছেন, আমি কথার খেই হারায়ে ফেলছি...

আমি বলতে চাচ্ছিলাম, কীভাবে কী হলো। একটি বাংলা দৈনিকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বহুদিন ধরে কাজ করছি। উপার্জন বেশি নয়, এই যোগ্যতা দিয়ে বেসরকারি সংস্থায় অনেক বেশি বেতনের চাকরি পাওয়া যায়। চাইলে আমিও পেতে পারি। কিন্তু সে রকম চেষ্টা কোনোদিন করিনি। তার কারণ লেখালেখি আর সাংবাদিকতার প্রতি আমার বিশেষ ঝোঁক। সাংবাদিক হিসাবে একধরনের ক্ষমতা উপভোগ করি। এই দেশে হোমরা-চোমরা না হলে যখন কেউ কোনখানে দাম পায় না তখন সাংবাদিকরা রাজা-উজির মারতে পারে; মন্ত্রী, সচিব, মিলিটারি, এমনকি প্রধানমন্ত্রীকেও এক হাত দেখে নিতে পারে। সাধারণ মানুষ যে সমস্ত অন্যায়-অবিচারের শিকার হয়, আমরা সাংবাদিকরা তা থেকে অপেক্ষাকৃত মুক্ত—এই ধরনের একটা নিরাপত্তাবোধে আমরা ভুগি। তাই আমি সাংবাদিকতা পেশা ছাড়ার কথা কোনোদিন ভাবিনি। আমার স্ত্রী একটি ভালো ওষুধ কোম্পানিতে ভালো পদে চাকরি করে। আমাদের এক মেয়ে, সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে। কোনো ঝুট-ঝামেলা নাই। একটা বুয়া এসে দুইবেলা রান্না করে দিয়ে যায়। রাজধানীর সোবহানবাগে দুই বেডরুম, এক ড্রয়িং রুমের একটা বাসায় আমরা ভাড়া থাকি।

আমাদের বাড়ির সামনে একটা ভিডিও-ডিশলাইন দোকানের সামনে কয়েকটা বখাটে ছেলে সকাল-বিকাল আড্ডা মারে। আমার মেয়ে মাঝে মাঝে আমাকে বলত, ওরা ওকে ডির্স্টাব করে। আমি মেয়েকে বললাম, কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে তুমি কলেজে যাবে, কলেজ শেষ হলে সোজা বাসায় ফিরে আসবে। কোনো দিকে তাকাবে না। মেয়ে একদিন এসে বলল, ওই বখাটেরা তার পার্স কেড়ে দুশো টাকা নিয়ে নিয়েছে। আমি কিছু বললাম না। কিছুদিন পর একদিন মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে এসে বলল, ওরা ওর ওড়না ধরে টানাটানি করেছে। আমি এক দুপুরে ওদের সামনে গিয়ে বললাম, ‘তোমরা পেয়েছ কী?’ একজন দাঁত কেলিয়ে বলল, ‘অহনও পাই নাই, পামু।’

পাশেই আমাদের ওয়ার্ড কমিশনারের বাসা। আমি তাকে সব কথা বললাম। সে বলল, ‘আচ্ছা দেখব।’ কিন্তু কয়েকদিন পরে মেয়ে এসে নালিশ করল ছেলেগুলো আবার তার টাকা কেড়ে নিয়েছে, ওড়না ধরে টানাটানি করেছে। আমি এবার থানায় একটা মামলা ঠুকে দিলাম। সেই সঙ্গে আমাদের ক্রাইম রিপোর্টারকে বললাম ব্যাপারটা দেখতে। সে কাকে যেন কী বলে দিল, পুলিশ একদিন কয়েকটা ছেলেকে ধরে নিয়ে গেল। কিন্তু কদিন পরেই তারা আবার ফিরে এল। তবে মেয়ের মুখে আর কোনো নালিশ-টালিশ শুনতে পেলাম না। ভাবলাম বখাটেগুলো সোজা হয়ে গেছে।

টানা তিনদিনের হরতালের ডাক দিল বিরোধী দলগুলো। আমার অফিস দিনের বেলা। সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাসায় ফিরে আর কোথাও বেরুলাম না।

রাত ন’টার দিকে দরজায় কলিংবেল বেজে উঠল। আমি বললাম, কে?

ওপাশ থেকে একটি কণ্ঠ বলল, ‘আঙ্কেল আমরা, আপনার সাথে একটু কথা আছে।’

ভাবলাম মাফ-টাফ চাইতে এসেছে। দরজা খুলে মুখ বের করতেই একজন আমার কলার চেপে ধরে এক ধাক্কায় ভিতরে নিয়ে এল। তার সঙ্গে সঙ্গে ঢুকে পড়ল আরো চার-পাঁচটা ছেলে। একজন দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দিল, একজন আমার বুকে পিস্তল ঠেসে ধরে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ড্রয়িং রুমে এনে সোফায় বসিয়ে দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি একদম বোবা হয়ে গেলাম। অন্য ঘর থেকে আমার স্ত্রী-কন্যা ছুটে এল। পিস্তল দেখে তাদের ফিট হয়ে পড়ে যাবার দশা। তিন-চারটা ছেলে তাদেরকে জাপটে ধরে নিয়ে গেল পাশের ঘরে, আমার বুকে পিস্তল ধরে সামনে দাঁড়িয়ে রইল একজন। আর একজন আমার ঘাড়ের কাছে। কিছুক্ষণ পরে ভিতরের ঘর থেকে একজন বেরিয়ে এসে পিস্তলওয়ালার হাত থেকে পিস্তলটা নিয়ে আমার সামনে দাঁড়াল, পিস্তলওয়ালা সদর্পে এগিয়ে গেল ভিতরের ঘরের দিকে।

এরপর আর কোনো বিবরণ আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। আমার মুখের ভিতরে পিস্তলের নল ঢুকিয়ে দাঁতের দুই পাটিতে ঠকাঠক বাড়ি দিয়ে শাসিয়ে ছেলেগুলো যখন ফিরে চলে গেল তখন আমার স্ত্রী ও কন্যা রক্তাক্ত, নির্বাক। স্ত্রী জ্ঞান হারায়নি, কিন্তু মেয়ে প্রায় মরার মতো অজ্ঞান। পাশেই একটা বেসরকারি হাসপাতাল, আমি মা-মেয়েকে নিয়ে গেলাম সেখানে। সর্বোচ্চ গোপনীয়তা রক্ষার জন্য অনুরোধ করলাম ডাক্তারদের। নিজের সাংবাদিক পরিচয় আমি সম্পূর্ণরূপে ভুলে গেলাম। এবং তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম এই বাসা ছেড়ে দিয়ে চলে যাব অনেক দূরের কোনো পাড়ায়, সম্ভব হলে পরের দিনই।

মা-মেয়ের শারিরীক জখমের ও তার চিকিৎসার কথা বলে কী লাভ। আমি তাদের মানসিক অবস্থা উপলব্ধি করার চেষ্ট করে ব্যর্থ হলাম। দুদিন ধরে ওরা আমার সঙ্গে প্রায় কোনো কথাই বলল না। আমার কাপুরুষতার জন্য আমার প্রতি ওদের ঘৃণা জেগেছে কি-না, এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলাম নিজেকে। কোনো সদুত্তর পাওয়া গেল না। নিজের অসহায়ত্বকে জাস্টিফাই করতে চাইলাম যুক্তি দিয়ে। বউকে বললাম, আমি ওদের সবকটাকে ফাঁসিতে লটকাতে পারি এবং আমি তাই করব। থানার কথা শুনে সে আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যে, আমি দমে গেলাম। প্রকট হয়ে উঠল মান-সম্মানের ভয়। থানায় আর যাওয়া হলো না। বললাম বাসা বদল করে অন্য কোনো পাড়ায় চলে যাব। তাতেও ওর মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না।

এখন আমি জানি, ওর সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছিল। মামলা, বিচার, বাসাবদল এসবের কোনো কিছুতেই আর কিছু যায়-আসে না ওর। আর মেয়ের কথা আর কী বলব! আর একবারও চোখ তুলে তাকাতে পারল না বাবার মুখের দিকে। আমি ওকে কী বলব? কী বলে সান্ত্বনা দেওয়া যায়? কোনো সান্ত্বনা কি আর থাকতে পারে?

কাউকে কিছুই জানাতে পারলাম না। গণধর্ষণের শিকার একজন সাংবাদিকের স্ত্রী ও কন্যা চমৎকার এক সংবাদ শিরোনাম হতে পারে। অন্য কোনো সাংবাদিকের বেলায় ঘটলে আমিই মহা-উৎসাহে খবরটা লিখতে বসতাম। হায়! কে জানত কার জন্যে ঘণ্টা বাজছিল!

মা-মেয়ে এক সঙ্গে বিদায় নিয়েছে। কিচ্ছু জানায়নি আমাকে। বোতলে যেটুকু বিষ অবশিষ্ট আছে, আমি ধরে নিতে পারি, ওরা তা রেখে গেছে আমারই জন্যে। ওরা আমাকে শুধু নিঃস্ব করেই চলে যায়নি, একটা অগ্নিপরীক্ষার মুখেও দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেছে। এই অগ্নিপরীক্ষা অতিক্রম করা আমার কর্তব্য। এখন আমারও বিষ খাওয়া উচিত। এটুকু বিষ যদি আমার মৃত্যুর জন্যে যথেষ্ট না হয়, দোকান থেকে নতুন বিষের বোতল কিনে এনে খাওয়া উচিত।

কিন্তু আমি বিষ খাব না। এত সহজে মরছি না আমি। আমি বেঁচে থাকতে চাই। বেঁচে থেকে আমি দেখতে চাই রাজনৈতিক নেতার কন্যা ধর্ষিত হচ্ছে, পুলিশের ইনস্পেক্টর জেনারেলের মেয়ে ধর্ষিত হচ্ছে, সংসদ সদস্যের মেয়ে ধর্ষিত হচ্ছে, মন্ত্রীর, সচিবের, মেজর জেনারেলের, বিচারপতির, প্রধানমন্ত্রীর, রাষ্ট্রপতির কন্যা, জায়া, জননীরা ধর্ষিত হচ্ছে। প্রতিদিন আমি অজস্র ধর্ষণ দেখতে চাই। একদিন যদি একটা ধর্ষণের খবর না পাই, তাহলে পাগল হয়ে যাব আমি।

কে জানে, হয়তো ইতিমধ্যেই আমি উন্মাদ।

 

পাঠ-প্রতিক্রিয়া : ১

এ গল্পে এক অসহায় মৃত্যুবিমূখ মানুষের মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনের ঘাত-প্রতিঘাতে লেখক কৌশলে দেখিয়েছেন আমাদের  চারপাশে ঘটেচলা নগ্ন বাস্তব। সাধাসিধে বর্ণনায় গল্প শুরু যেখানে সমাপ্তিও সেখানে, মাঝে একটু বাক পরিবর্তন! এটুকু নিরীক্ষায় আমরা বুঝে যাই লেখক অভিজ্ঞ, এবং তিনি বর্ণনার চেনা পথে হাঁটলেও পাঠান্তে পাঠককে দিয়ে যাবেন বৈচিত্রের সন্ধান!

 

পাঠ-প্রতিক্রিয়া : ২

মানুষ আত্মহত্যা করে কেন? ইমাইল দুর্খেইম তার আত্মহত্যা বিষয়ক তত্ত্বে প্রধানত দুটি কারণের উল্লেখ করেছেন। এক. যখন কেউ সমাজের প্রতি প্রবল একাত্মতাবোধ করে। অর্থাৎ দেশের জন্য, ভাষার জন্য কিংবা ধর্মের জন্য যুদ্ধে গিয়ে নিহত হওয়াকে তিনি আত্মহত্যা বলেছেন। দুই. যখন কেউ সমাজ থেকে নিজেকে প্রচণ্ডভাবে বিচ্ছিন্ন মনে করে। অর্থাৎ কেউ যদি মনে করে যে, এই পৃথিবীতে তার আপন কেউ নেই, কেউ তাকে ভালোবাসে না, তার বেঁচে থাকাটা অর্থহীন, লজ্জার, অপমানের, সে-ও আত্মহত্যা করতে পারে।  

সমাজ আমাদেরকে অনেক কিছুই শেখায় কিন্তু আমরা সমাজকে তেমন কিছুই শেখাই না কিংবা পারি না। কিন্তু কেন? সমাজকে শেখানোর দায়িত্বটা কার? সমাজ তো স্কুলে যায় না। আমরা স্কুলে যাই। সুতরাং আমাদের কাউকে না কাউকেই সমাজকে শেখানোর দায়িত্বটা নিতে হবে। কবি, লেখক, দার্শনিকরা মুলত সমাজের শিক্ষক। এই গল্পে লেখক গভীর বেদনার ক্যানভাসে পরাজিত জীবনের জলছবি এঁকেছেন। একজন লেখক তার সময়ের-সমাজের কাছে জন্মগতভাবেই দায়বদ্ধ। উক্ত গল্পে সমাজের নিদ্রামগ্নচোখে জলের ছাট দেয়ার চেষ্টা করেছেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পোস্ট-রোমান্টিক ধারায় বিরহের ভায়োলিন বাজিয়েছেন।  

জীবন আমাদের জন্য প্রত্যহ কোনো বহতা নদীর মতো প্রত্যাশার নবধারাজল বহন করে না। তারপরেও জীবন সুন্দর, তাই ছত্রিশ বছরের প্রায় বিগত যৌবনা রমণীকেও যুবতী মনে হয়। লাশের ঠোঁটেও একটু উষ্ণতার মাধুকুরি খুঁজে ফিরে। ভালোবাসা বড় অদ্ভুত, তাই না? বয়সের সাথে সাথে ভালোবাসা আরো অদ্ভুত হতে থাকে, যতক্ষণ না পর্যন্ত মৃত্যু এসে কড়া নাড়ে। সুইসাইড নোটের মাধ্যমে মৃতের জবানে গল্প বলায়, লেখক মূলত কাফকার মেটামরফোসিস-এর অস্তিত্ব এবং অনস্তিত্বের মতো আবহ সৃষ্টি করতে চেয়েছেন। তবে গল্প-উপন্যাসের চরিত্রের সুইসাইড নোট নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা আছে। অনেকে সুইসাইড নোটকে ‘মরণশীলতার বিলাসিতা’ মনে করেন। লেখকরা ঈশ্বরের প্রতিবেশি, তারা ঈশ্বরের চোখেই সবকিছু বড় নির্মোহভাবে দেখলেই কালজয়ী হয়ে ওঠেন।

 [আমরা গল্প ও কবিতার সঙ্গে পাঠ-প্রতিক্রিয়া জুড়ে দেবার সীদ্ধান্ত নিয়েছি। যিনি পাঠ-প্রতিক্রিয়া লিখবেন তাকে শুরুতে জানতে দেয়া হয় না লেখকের নাম। আবার লেখক কখনোই জানতে পারবেন না পাঠ-প্রতিক্রিয়া কে লিখেছেন।বি.স.]

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
নাটোরে উপজেলা নির্বাচনরুবেলকে শোকজ দিলো উপজেলা আ’লীগ, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ পলকের
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া