X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

সিজন অব মাইগ্রেশন টু দ্য নর্থ।। আফ্রিকায় বিশ্বায়ন অথবা মুস্তফা সাঈদ কে?

জাহেদ সরওয়ার
৩১ আগস্ট ২০১৮, ০৬:০০আপডেট : ৩১ আগস্ট ২০১৮, ০৬:০০

সিজন অব মাইগ্রেশন টু দ্য নর্থ।। আফ্রিকায় বিশ্বায়ন অথবা মুস্তফা সাঈদ কে? আফ্রিকান লেখকেরা কি লিখছেন, তা আমাদের কাছে ক্রমশ পরিষ্কার হওয়া শুরু করেছে। এ আলোচনা থেকে সাউথ আফ্রিকাকে ইচ্ছা করেই বাইরে রাখতে চাই। কারণ সাউথের লেখকেরা যেমন, নাদিন গর্দিমার, জে এম কোয়েতৎজি প্রমুখ অনেক বেশি ইউরোপকেন্দ্রিক। উত্তর আফ্রিকার লেখকদের মধ্যে চিনুয়া আচিবি, নগুগি ওয়াঙ্গ থিয়াঙ্গো, আমোস তুতুওয়ালা, সেমবেন ওসমান, নাগিব মাহফুজ, তায়েব সালিহ প্রমুখ।

তায়িব সালিহ মূলত সুদানের লোক। আরবি ভাষায় লেখেন। নাগিব মাহফুজের পর আরবি বিশ্বের সমধিক পঠিত ও পরিচিত লেখক। জন্মগ্রহণ করেন সুদানের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এই উপন্যাসের পটভূমিও সুদানের এক প্রত্যন্ত অঞ্চল, তবুও এ কাহিনি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে রাজধানী খার্তুম, পুরা আফ্রিকা আর ইউরোপজুড়ে।

“বুঝলেন মশাইরা, অনেক দিন পর, মানে ঠিক সাত বছর পর আমি আবার আপনজনের মধ্যে ফিরে আসলাম। এত দিন বিলাতে পড়াশোনা করছিলাম।”

এভাবে কথকের আত্মকথনের মাধ্যমে উপন্যাসটি শুরু হলেও শেষ পর্যন্ত এই কাহিনীর অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন মুস্তফা সাঈদ। সাত বছর পর কথক গ্রামে এসে অনেক পরিবর্তনের সঙ্গে আবিষ্কার করেন এই মুস্তফা সাঈদকে। এই গ্রামবাসীদের চোখে মুস্তফা সাঈদ এক রহস্যময় চরিত্র। এই মুস্তফা সাঈদ বিস্ময়কর মেধাবী এক মানুষ, যে কিনা তার জীবনটা ভুল পথে চালিত করেছিল।

শৈশবে খার্তুমের এক স্কুলে তার মা তাকে ভর্তি করে দেয়। অচিরেই স্কুল কর্তৃপক্ষ আবিষ্কার করে অদ্ভুত মুখস্থ শক্তিময় এক বালককে। যে কিনা একবার যা দেখে তা কখনো ভুলে না। শিক্ষকেরা খুব দ্রুত উপলব্ধি করলেন, অচিরেই স্কুলের সব বই মুস্তফার মুখস্থ। অর্থাৎ বালক মুস্তফাকে দেওয়ার মতো কোনো জ্ঞান আর স্কুলের নেই। প্রধান শিক্ষক তার পক্ষ হয়ে একটা স্কলারশিপের জন্য পত্র লেখেন কায়রোয়। কায়রোর মাধ্যমিক স্কুল কর্তৃপক্ষ সাদরে আমন্ত্রণ জানায় মুস্তফাকে। সেখানে মাধ্যমিক সেরে অক্সফোর্ডে পাড়ি জমান তিনি।

জগতের তাবৎ বিষয় সম্পর্কে তিনি অক্সফোর্ডে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন। যেকোনো বিষয়ে বক্তৃতা দিয়ে অর্থ আয়ই তার পেশা হয়ে দাঁড়ায়। সঙ্গে এক মারাত্মক নেশায় তিনি আসক্ত হয়ে ওঠেন- ‘নারী’।

তার বক্তৃতা শুনে পতঙ্গের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকে ইউরোপীয় নারীরা। ইউরোপিয়ানরা একসময় আফ্রিকান নারীদের ক্রীতদাসী হিসেবে ধরে আনতেন। ধর্ষণ, নির্যাতন আর শ্রম নিংড়ে নেয়া হতো তাদের দেহ থেকে। কিন্তু এখানে যেন ফিরে দাঁড়াল নতুন আফ্রিকার এই প্রতিনিধি।

এক নারীর সঙ্গে বেশি দিন থাকে না মুস্তফা। তবে অদ্ভুত এক ব্যাপার লক্ষ করেন তিনি- যে নারী একবার তার সঙ্গে প্রেম ও সঙ্গমে মিলিত হয়, সে আত্মহত্যা করতে থাকে । এর জন্য মুস্তফাকে দাঁড়াতে হয় আদালতের কাঠগড়ায়।

তার ভাষায়, “লন্ডনের আদালতে আইনজীবীরা যখন আমাকে নিয়ে বাগবিতন্ডা চালাচ্ছিল, দিনের পর দিন আমি তখন অত্যন্ত নিস্পৃহভাবে কাঠগড়ায় বসে থাকতাম এমনভাবে যে, যেন অন্য কাউকে নিয়ে তারা আলোচনা করছে, যাতে আমার আদৌ কিছু যায় আসে না। পাবলিক প্রসিকিউটর স্যার আর্থার হিগিনস তীক্ষ বুদ্ধিমান ব্যক্তি। আমি উনাকে চিনতাম। অক্সফোর্ডে আমাদের ক্রিমিনাল’ল পড়িয়েছেন।” মুস্তফার সঙ্গে আদালতের সামান্য কথোপকথন:

: আপনিই কি অ্যান হ্যামন্ডের মৃত্যুর কারণ?

: জানি না

: আর শিলা গ্রিনউড?

: জানি না

: আর ইসাবেলা সেমুর?

: জানি না

: আপনি কি জিন মরিসকে হত্যা করেছেন?

: জি

: এই হত্যা কি ইচ্ছাকৃত?

অ্যান, শিলা, ইসাবেলা প্রমুখ মহিলা ছিল তার শিকার কিন্তু সে ছিল জিন মরিসের শিকার।

জিন মরিস তার জীবনটাকে অস্থির করে তোলে। ফলে সে জিন মরিসকে হত্যা করে। হত্যা যে এত শিল্পিত হতে পারে, তা তায়িব সালির এই বইটি না পড়লে বোঝা যায় না।

“এই তো আমার জাহাজ প্রিয়তমা ভেসে চলেছে ধ্বংসের কিনারায়। ঝুঁকে পড়ে ওর কপালে চুম্বন করলাম। ছোরার ধারালো ফলাটা ওর বুকের মাঝখানে রাখলাম। ও আমার কোমর বেষ্টন করল তার পা দুটি দিয়ে। আস্তে আস্তে ছোরাটায় চাপ দিতে লাগলাম। খুব আস্তেও চোখ মেলল। কী উন্মাদনা চোখে মুখে! দুনিয়ার সবকিছুর চেয়ে ওকে সুন্দর মনে হচ্ছিল। প্রিয়তম, খুব ধীরে যন্ত্রণাক্লিষ্ট গলায় বলল, ‘ভেবেছিলাম, তুমি এটা কখনোই করবে না। আমি প্রায় আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম।

আমার বুক দিয়ে চাপ দিলাম ছোরাটার বাঁটে, একটু একটু করে পুরোটা ঢুকে গেল ওর বুকে। চেপে রইলাম সমস্ত শক্তি দিয়ে। ও কাতর হয়ে অনুনয় করল: আমার সঙ্গে চলো, আমাকে একা যেতে দিয়ো না।”

জিন মরিসকে এভাবেই হত্যা করেন সাঈদ। এসবই কথকের কাছে বয়ান করেন তিনি। মুস্তফা সম্পর্কে বাকি অর্ধেক জানতে পারেন কথক মুস্তফাফার ডায়েরি থেকে, যা তার মৃত্যু বা আত্মগোপনের সময় কথকের হস্তগত হয়। জিন মরিস হত্যাকান্ডে সাত বছর তার জেল হয়ে যায়। জেল শেষে সে চলে আসে সুদানের নেইল নামের এই গ্রামে, যেখানে কথকের সাথে তার পরিচয় হয়। সুদানের এই গ্রামেও মুস্তফা সাঈদ হুসনা বিনতে মাহমুদ নামে এক সাধারণ নারীকে বিয়ে করেন। কিন্তু হঠাৎ করে মুস্তফা সাঈদের চরিত্র আরও রহস্যজনক হয়ে ওঠে। সে তার বউ ও ছেলে দুটো কথকের হাতে সমর্পণ করে এই বলে একটা চিঠি পাঠায় যে যদি আমি না থাকি তবে এদের আপনার কাছে রেখে গেলাম। তারপর এক জ্যোৎস্না রাতে নীল নদের বাড়ন্ত পানিতে সাঁতার দেয় মুস্তফা। অনন্ত সাঁতার। সে আর ফিরে আসেনি।

এরপর কথক যোগদান করে খার্তুমে, সুদান সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। কথকের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজ করার মাধ্যমে লেখক আমাদের নব্য আফ্রিকার রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করেন।

আফ্রিকান শিক্ষা ঐক্যের সম্মেলনে আফ্রিকার সাতটি দেশের প্রেসিডেণ্ট অংশ নেন। তাদের মধ্যে অনেকেই চেনেন মুস্তফা সাঈদকে। অনেকের সাথেই লন্ডনে থাকাকালীন দেখা হয়েছে মুস্তফার। এবং তাদের মাধ্যমে লেখক দেখান যে আধুনিক আফ্রিকি তরুণ প্রেসিডেন্টরা প্রায় সবাই দুর্নীতিবাজ, মার্কিন সাম্রাজ্যের তাবেদার।

“আফ্রিকার অন্যান্য দেশের নতুন শাসকদের চেহারাটা যদি ও দেখত। মুখখানা পলিশ করা, কথাবার্তা ধূর্ত নেকড়ের মতো, আঙুলে চিকচিক করছে দামি রত্ন খচিত আংটি। গায়ে দামি সেন্টের গন্ধ ভুরভুর করছে। পরনে ভীষণ দামি সাদা কালো নীল সবুজ স্যুট প্যান্ট, কাঁধে আরও দামি সিল্ক ঢেউ খেলছে। যেন শ্যাম দেশের বিড়ালের লোম। আর জুতোগুলো যেন ঝাড়বাতির আলো ঠিকরাচ্ছে। মার্বেল পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটার সময় কী মচমচ আওয়াজ। এক ব্যস্ত বাগিস প্রেসিডেন্ট শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে বক্তৃতা প্রদান করেন ‘স্কুলে ছাত্রেরা যা শিখবে আর জনজীবনের বাস্তবতার মধ্যে কোনো বিরোধিতা বা অসংগতি থাকা অভিপ্রেত নয়। আজ যারা লেখাপড়া শিখছে তারা সবাই পাখার তলায় ডেস্কে বসে কাজ করতে চায়। থাকতে চায় শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাগানঘেরা বাড়িতে। এই অসুখের বীজ যদি আমরা সমূলে উৎপাটন করতে না পারি, তাহলে আমরা পাব একটা বিপদগামী বুর্জোয়া সমাজ। যার সঙ্গে আমাদের জীবনের বাস্তবতার কোনো মিল নাই, আর সেটাই হবে আফ্রিকার ভবিষ্যতের জন্য সব থেকে বিপজ্জনক। এমনকি সাম্রাজ্যবাদীদের চেয়েও ভয়ংকর।”

অথচ এই লোকটাই গরমকালে আফ্রিকা থেকে চলে যায় সুইজারল্যান্ডে, যেখানে লুসার্ন হ্রদের ধারেও একটা ভিলা আছে। সেখানেই তিনি সপরিবারে গরমকালটা কাটান। তার স্ত্রী লন্ডনে হারভের দোকান থেকে বাজার করে, ওখান থেকেই সব জিনিসপত্র  ব্যক্তিগত অ্যারোপ্লেনে চলে যায় বাড়িতে। এই প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধিদলের অন্যরাও খোলাখুলি স্বীকার করছিল যে, তার মতো ঘুষখোর দুর্নীতিপরায়ণ লোক খুব কম দেখা যায়। নানা রকম ব্যবসায় তার প্রচুর বিষয়সম্পত্তি। দেশের অর্ধ-উলঙ্গ অসহায় খেটে খাওয়া মানুষের ঠকিয়ে টাকার পাহাড় তৈরি করেছে। এই ধরনের লোকেরা শুধু নিজেদের পেট আর যৌন চরিতার্থতা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না।

আহা! আমাদের দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার সাথে কতই না মিল। আফ্রিকা তথা বর্তমান পৃথিবীর বিশ্বায়ন ও তার সমস্যাবলিকে ছুঁয়ে যায় এই উপন্যাস। সুদানের সাধারণ গ্রামের মানুষ, তাদের কথাবার্তা, আচার-আচরণ খুব সহজেই মনে করিয়ে  দেয় আমাদের পরিচিত গ্রামবাংলাকে।

সুদানের উত্তরাঞ্চলের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে ১৯২৯ সালে তায়েব সালির জন্ম। তিনি মূলত আরবিতে লেখেন। মাত্র দুটো উপন্যাস লিখেছেন। ‘সিজন অব দি মাইগ্রেশন টু দি নর্থ’ ও ‘ওয়েডিং অব জেন’। প্রচুর গল্প ও স্মৃতিকথা লিখেছেন। তার দ্বিতীয় উপন্যাসটা নিয়ে আরবি ভাষায় একট চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। ছবিটি ১৯৭৬ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ ছবির সম্মান পায়।

প্রফেশনাল রিভিউয়ার ‘ডেনি ইয়ে’ এই বইটির রিভিউ করতে গিয়ে বলেন, 'Season of Migration to the North is complex, in its framing, in its episodic style, in its use of metaphor, and in the variety of material it canvasses. It touches on colonial arrogance, sexual mores and the status of women, the politics of independent Sudan, and more. There are lyrical fragments with no direct connection to the story, describing the rhythms of agriculture, travel along the Nile, a spontaneous night celebration by travellers in the desert, and so forth. And there are references to European novels about encounters with the exotic in Africa and the Middle East.'

বইটি সম্পর্কে তিনি যথার্থই বলেছেন। একেবারে নেহাত আঞ্চলিক হয়েও যে কী কারণে একটা উপন্যাস আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে পারে এই বইটি তার সাক্ষ্য দেয়।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
জোভানের নতজানু বার্তা: আমার ওপর কষ্ট রাখবেন না
লাগাতার তাপদাহে যশোরে জনজীবন দুর্ভোগে
লাগাতার তাপদাহে যশোরে জনজীবন দুর্ভোগে
জেলেনস্কিকে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত অভিযোগে পোলিশ নাগরিক গ্রেফতার
জেলেনস্কিকে হত্যার পরিকল্পনায় জড়িত অভিযোগে পোলিশ নাগরিক গ্রেফতার
বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিলেন মিয়ানমারের আরও ১৩ সীমান্তরক্ষী
বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিলেন মিয়ানমারের আরও ১৩ সীমান্তরক্ষী
সর্বাধিক পঠিত
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
ডিএমপির ৬ কর্মকর্তার বদলি
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ