X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

চেনা সুরের রাগ-রঙ

বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০৬:১৫আপডেট : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৩:৩০

চেনা সুরের রাগ-রঙ (পর্ব : ১১)

আমাদের জীবনের সঙ্গে একটা গাছের ছবির মিল খুঁজে পাওয়া যায় সহজেই। যত দিন যায়, বীজ থেকে অঙ্কুরিত হয়ে গাছ প্রসারিত হয় কাণ্ডে...কাণ্ড থেকে নানা শাখায় বিভাজিত প্রতিটি শাখা আবার প্রশাখায়, তারপর প্রতিটি প্রশাখা আবার অজস্র বৃন্ত, পাতায়, তারপর অগণিত পাতার শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ে। যদি মূল থেকে বর্ণনা শুরু করি, তবে শেষ পর্যন্ত হয়তো কোনো একটি শিরা বা উপশিরার শেষ প্রান্তে পৌঁছে যেতে পারি, কিন্তু তাতে সমগ্র গাছটার কতটুকুই বা জানা হলো? জীবনও তেমনিই। যেখান থেকেই শুরু করি তার সবটা বর্ণনা করা যায় না।

অথচ জীবন মানে তো শুধু একটা মাত্র পথ, একটাই মাত্র রৈখিক পরিক্রমা মাত্র নয়। এই সমগ্রতা নিয়েই তো জীবন।

কথাটা প্রায়ই মনে হয় রাগসঙ্গীতের সূত্রধর। কোনো নির্দিষ্ট পথ ধরে পরিক্রমা করে তার সবটা ধরা যায় না। অবশ্য আমাদের সঙ্গীত পরিক্রমা শুধুমাত্র মুগ্ধতার টানে। তার কোনো নির্দিষ্ট পথ নেই, তাই আমরা মুক্ত— আপন খেয়ালে ঘুরে বেড়াই ভাব থেকে ভাবান্তরে। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে একদিন হয়তো সুরের জগতে সব রাগের সঙ্গেই আপনার পরিচয় ঘটে যাবে, আর যদি সেটা নাও ঘটে, তবু প্রায় অধিকাংশ রাগই আপনি চিনে যাবেন, তাতে সন্দেহ নেই। শুধু শুনতে হবে, আর খুঁজতে হবে নিরন্তর। একমাত্র তাহলেই সেই অনন্ত আনন্দলোকে আপনার প্রবেশাধিকার ঘটবে।

তবু ধরা বাঁধা পথ যে একেবারেই নেই, তা বলা যায় না। সে পথ আমাদের মতো মুগ্ধ সাধারণ শ্রোতাদের জন্য নয়, তবু মোটামুটি একটা নির্দেশ থাকলে যে চলতে সুবিধা হয়, এটা ঠিক। এই রকম একটা পথের নির্দেশ দিয়েছিলেন, পণ্ডিত বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখণ্ডে। তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রায় সমস্ত রাগগুলির স্বরসমন্বয়কে বিশ্লেষণ করে তাদের মোট দশটি শ্রেণীতে ভাগ করেন। স্বরের সমন্বয় বিচার করেই তিনি সেই শ্রেণী বা ঠাটগুলির তিনি নাম দেন, বিভিন্ন রাগের নামানুসারে। ঠাটগুলি হলো, কল্যাণ, বিলাবল, খাম্বাজ, ভৈরব, পূরবী, মারবা, কাফী, ভৈরবী, আশাবরী ও টোড়ি। এই দশটি ঠাটের মধ্যেও আবার স্বরসমন্বয়ের বিচারে তিনটি শ্রেণী এবং একটি ব্যতিক্রমী ঠাট আছে। যেমন, প্রথম শ্রেণীতে আছে কল্যাণ, বিলাবল এবং খাম্বাজ, যাদের শ্রেণীগত বৈশিষ্ট্য হলো এই তিনটি ঠাটেই সাধারণ স্বর হলো শুদ্ধ ‘রে’, শুদ্ধ ‘ধা’ ও শুদ্ধ ‘গা’। দ্বিতীয় শ্রেণীতে আছে, ভৈরব, পূরবী ও মারবা ঠাট, যাদের সাধারণ স্বর হলো, কোমল ‘রে’, শুদ্ধ ‘গা’ ও শুদ্ধ ‘নি’। তৃতীয় শ্রেণীটি হলো, কাফী ঠাট, ভৈরবী ঠাট এবং আশবরী ঠাট, যাদের সাধারণ স্বর হলো কোমল ‘গা’ ও কোমল ‘নি’। আর টোড়ি হলো ব্যতিক্রমী ঠাট।

কিন্তু এই শ্রেণী বিভাজন ঠাটগুলির পারস্পরিক সম্বন্ধ বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট সম্বন্ধ নির্দেশ করে না। মাত্র দশটি ঠাট, তাদের আবার তিনটি ভাগ, যাদের মধ্যে নির্দিষ্ট কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে, এই বিভাজন মনে রাখারও সহজ কোনো উপায় নেই। আমরা তেমন একটা সহজ উপায় আবিষ্কার করব। এই প্রসঙ্গে অবশ্য খানিকটা আলোচনার প্রয়োজন আছে; ‘ঠাট’ কথাটার অর্থ আমাদের বুঝতে হবে।

একটি স্বরসপ্তকের স্বরগুলি হলো, সা, রে, গা, মা, পা, ধা, নি। এর মধ্যে আবার রে, গা, ধা, নি— এই চারটি স্বরের প্রত্যেকটির কোমল ও শুদ্ধ— এই দুটি করে প্রকার আছে। কোমল স্বরের তুলনায় শুদ্ধ স্বরগুলি একটু চড়া। এদের লেখা হবে যথাক্রমে ‘ঋ’, ‘রে’, ‘জ্ঞা’, ‘গা’, ‘দা’, ‘ধা’ এবং ‘ণি’, ‘নি’— এইভাবে। মা-এরও দুটি প্রকার, যাদের বলা হয় শুদ্ধ মা ও কড়ি মা এবং লেখা হয়, মা ও হ্মা।

এ বিষয়ে আমরা আমাদের আলোচনার প্রথম পর্বেই বলেছি, কাজেই আপাতত আর বিস্তারিত করছি না। কিন্তু একটা প্রশ্ন হয়তো আমাদের মনে উদয় হতে পারে, যে সা থেকে র্সা (অর্থাৎ চড়ার সা) পর্যন্ত সুরের যে বিস্তার, যাকে আমরা একটি ‘স্কেল’ বলি, তাতে বারোটি স্বরই কেন থাকে? স্বরের সংখ্যা কি ইচ্ছামতো বাড়ানো বা কমানো যায় না?

এর উত্তরে বলতে হয়, না। সেটা সম্ভব নয়। কারণ, একটি স্কেল বা স্বরগ্রামে স্বরের সংখ্যা কত হবে, সেটা নির্ভর করে দুটি বিষয়ের ওপর। প্রথমত, একটি স্বরগ্রামে মা এবং পা-এর অবস্থানের ওপর এবং দ্বিতীয়ত, স্বরগুলি কি নিয়মে সৃষ্টি হচ্ছে, তার ওপর। সা, মা এবং পা একটি স্বরগ্রামে ‘অচল স্বর’ রূপে পরিচিত। শব্দ, বা স্বর— আসলে বায়ুমন্ডলের ঢেউ। যে ঢেউ যত দ্রুত কম্পিত হয়, সে শব্দের কম্পাঙ্ক ততই বেশি, তার সুরও ততই চড়া বা সরু। প্রতি সেকেন্ডে বায়ুস্তর যতবার কম্পিত হয়, তাকে ওই স্বরের কম্পাঙ্ক বলে। যেমন, চড়ার সা-এর কম্পাঙ্ক খাদের সা-এর কম্পাঙ্কের দ্বিগুণ। অন্যান্য যে সব স্বর অর্থাৎ রে, গা, মা... ইত্যাদির কম্পাঙ্ক তাদের মাঝামাঝি। কিন্তু মা ও পা, যেহেতু অচল স্বর, অতএব তাদেরও কম্পাঙ্ক কত হবে— সেটাও সুনির্দিষ্ট। মা-এর কম্পাঙ্ক সা-এর কম্পাঙ্কের ৪/৩ গুণ এবং পা-এর কম্পাঙ্ক সা-এর কম্পাঙ্কের ৩/২ গুণ হবে। এর পেছনে গভীর বৈজ্ঞানিক কারণ আছে, কিন্তু আমরা সে আলোচনায় যাব না। শুধু এটুকুই বলব যে, দুটি স্বরের মধ্যে কম্পাঙ্কের অনুপাত ৪/৩ কিংবা ৩/২ হলে, আমরা বলি তারা যথাক্রমে ষড়জ-মধ্যম ভাবে অম্বগ ষড়জ-পঞ্চম ভাবে রয়েছে এবং প্রকৃতপক্ষে এই ষড়জ-মধ্যম এবং ষড়জ-পঞ্চম ভাবের সূত্র ধরেই উৎপন্ন হয়েছে বারোটি স্বর। এই সূত্র ধরেই আমরা সা থেকে শুরু করে বারোটি স্বর পেয়ে যাই একটি নির্দিষ্ট ক্রমে এবং সেটি হলো :

  চেনা সুরের রাগ-রঙ

অর্থাৎ, শুধুমাত্র সা-এর কম্পাঙ্ক জানা থাকলে শুধুমাত্র দুটি গুণাঙ্ক (৩/২) এবং □(৪/৩) নিয়ম মাফিক প্রয়োগ করে আমরা সমস্ত স্বরগ্রামটির সব স্বরগুলির কম্পাঙ্ক পেতে পারি। কৌতূহলী পাঠক, এ বিষয়ে যারা বিস্তারিত ভাবে জানতে আগ্রহী তারা বর্তমান লেখকের ‘সঙ্গীতের ভাষা’ বইটি পড়তে পারেন (পরশপাথর প্রকাশন, ১২ সি, বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০৭৩, ভারত)।

কিন্তু আপাতত আমাদের পক্ষে এটুকুই যথেষ্ট, কিংবা হয়তো এর চাইতেও অল্পেই আমাদের কাজ চলে যাবে। স্বরগ্রাম নির্মাণের যে পরিক্রমা ওপরে লেখা হয়েছে, তার মধ্যে আমাদের মনে রাখতে হবে একটি মাত্র ক্রম এবং সেটি হলো, ‘রে ধা গা নি হ্ম ঋ দা জ্ঞা ণি’। ব্যস! শুধু এটুকুই! এটাই হলো ভৈরবী থেকে শুরু করে মোট ন’টি ঠাটে পৌঁছানোর সূত্র। হ্যাঁ, নয়টি, কারণ ভৈরব ঠাট এই সূত্রে পাওয়া যাবে না। অর্থাৎ এই সূত্রানুসারে ভৈরব হলো ব্যতিক্রমী।

এবার বলি, কিভাবে এই সূত্রটি প্রয়োগ করবেন।

আবার বলি, ভৈরবীর সব স্বরই কোমল এবং আমরা আমাদের সূত্রানুসারে পর্যায়ক্রমে এর একেকটি স্বর পরিবর্তন করব প্রথমেই। অতএব, আমরা ভৈরবীর কোমল রে অর্থাৎ ঋ-কে বদলে শুদ্ধ রে করব এবং এর ফলে পাব আশাবরী ঠাট। এরপর আশাবরীর কোমল ধা (অর্থাৎ দা) বদরে করব শুদ্ধ ধা... এইভাবে আমরা একে একে ভৈরবী থেকে আশাবরী, কাফী, খাম্বাজ, বিলাবল, কল্যাণ, মারবা, পূর্বী ও টোড়ি ঠাট পেয়ে যাব; কিন্তু শেষ পর্বে টোড়ির শুদ্ধ ‘নি’ বদলে যেই কোমল ‘ণি’ করব তখন প্রত্যাশিত ভৈরব ঠাটটি পাব না। পাব এমন একটি স্বর-সমন্বয়, যা উত্তরভারতীয় সঙ্গীতের কোনো ঠাটের সঙ্গে মেলে না, বরং দক্ষিণী সঙ্গীতে এটি ভবানী বা ভবপ্রিয়া মেল (ঠাট) হিসেবে চিহ্নিত হয়। সুতরাং ভৈরবকে আমরা একটি পৃথক বা ব্যতিক্রমী ঠাট হিসাবেই রেখেছি।

এবার এই সমস্ত প্রক্রিয়াটাকে একটা ছকে সাজিয়ে আরো স্পষ্টভাবে দেখার চেষ্টা করা যাক।

ছকটা এই রকম—

চেনা সুরের রাগ-রঙ

আবার বলি, ভবপ্রিয়া ঠাটটি উত্তর ভারতীয় সঙ্গীতে নেই। এটি দক্ষিণ ভারতীয় বা কর্নাটকী সঙ্গীতের মেল বা ঠাট হিসাবেই চিহ্নিত। লক্ষ করুন, প্রতিটি ঠাটের নামই একটি রাগের নাম। কিন্তু রাগ আর ঠাট এক নয়। রাগ একটি ভাব— যার প্রকাশ ঘটে সুর বা স্বর প্রবাহের মধ্যে দিয়ে। তার আরোহণ-অবরোহণ থাকে; কিন্তু ঠাটের কোনো আরোহণ বা অবরোহণ নেই। তা একটি স্বর-সমন্বয় মাত্র। যে সব রাগ কোনো একটি বিশেষ ঠাটের স্বর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে, তাদের সেই ঠাটের অন্তর্গত বলে ধরা হয়। তবে কোনো কোনো রাগের ক্ষেত্রে এ নিয়ে মতভেদও আছে। তাছাড়া প্রতিটি রাগেই যেসব স্বরগুলি ব্যবহৃত হবেই, এমন কোনো কথা নেই। কোনো কোনো স্বর বর্জিতও হতে পারে (যেমন, মালকোশ রাগে রে পা বর্জিত) কিন্তু তবু রাগটির চলন ও প্রকৃতি অনুসারে তার ঠাট নির্ধারণের চেষ্টা করা হয় (যেমন মালকোশ রাগটি ভৈরবী ঠাটের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে)।

যাই হোক, ঠাট বিভাজন প্রক্রিয়ায় সমস্যা যেমন আছে, তেমনি তার সুবিধাও অনেক। আসলে সুবিধাই বেশি, বিশেষতঃ রাগ সম্বন্ধে আলোচনা করতে হলে, সুবিধাই বিস্তর। (চলবে)

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ইইউ দেশগুলোকে ইউক্রেনে ক্ষেপণাস্ত্র-বিধ্বংসী অস্ত্র পাঠাতে হবে: বোরেল
ইইউ দেশগুলোকে ইউক্রেনে ক্ষেপণাস্ত্র-বিধ্বংসী অস্ত্র পাঠাতে হবে: বোরেল
কানের সমান্তরাল তিন বিভাগে কোন কোন দেশের ছবি
কান উৎসব ২০২৪কানের সমান্তরাল তিন বিভাগে কোন কোন দেশের ছবি
বিএনপির কারণে ভিন্ন কৌশল নেওয়ার কথা জানালো আ.লীগ
উপজেলা নির্বাচনবিএনপির কারণে ভিন্ন কৌশল নেওয়ার কথা জানালো আ.লীগ
সর্বাধিক পঠিত
এএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
রেস্তোরাঁয় ‘মদ না পেয়ে’ হামলার অভিযোগএএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট