X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

চেনা সুরের রাগ-রঙ

বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়
০৩ অক্টোবর ২০১৮, ১১:০১আপডেট : ০৩ অক্টোবর ২০১৮, ১১:০১

চেনা সুরের রাগ-রঙ (পর্ব : ১৩)

জৌনপুরী রাগটি খুবই প্রাচীন। আজ থেকে প্রায় পাঁচশ বছর আগে জৌনপুরীর নবাব হুসেন শর্কীর উৎসাহে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রভূত উন্নতি হয়। তিনি নিজেও একজন সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন এবং অনেকের অনুমান জৌনপুরী রাগটি তারই সৃষ্টি।...

সত্য মিথ্যা যাই হোক, সে বিচার আমাদের জন্য নয়। আমরা বরং তাকে চিনে নেবার চেষ্টা করি। আবার বলি, শুদ্ধ ‘রে’ যুক্ত আশাবরীর সঙ্গে এর মিল অনেক এবং এতটাই, যে অনেকেই আশাবরী ঠাটকে জৌনপুরী ঠাট নামেও উল্লেখ করে থাকেন। মোটকথা জৌনপুরী রাগটি আশাবরী ঠাটেরই রাগ এবং আশ্রয় রাগও বলা যায়, যেহেতু শুদ্ধ রেখার যুক্ত আশাবরী এখন প্রায় অবলুপ্ত।

যদি জৌনপুরী রাগাশ্রয়ী বাংলা গানের কথা বলতে হয়, তবে আমার প্রথমেই মনে পড়বে ‘মম মধুর মিনতি শুন ঘনশ্যাম’— এই গানটির কথা, যা একটি নজরুল গীতি এবং তার মাধুর্য পূর্ণরূপে আস্বাদন করতে হলে শুনুন জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামীর রেকর্ডটি। আরো একটি নজরুল গীতির কথাও বলব এবং সেটি হলো, ‘একেলা গোরী জলকে চলে’। একটি অতুলপ্রসাদী গানের কথাও মনে পড়ছে, ‘তব চরণতলে সদা রাখিয়ো মোরে’। ‘এসো শরতের অমল মহিমা’— রবীন্দ্রসঙ্গীতটিতেও জৌনপুরী রাগটিকে পাওয়া যায় পুরোপুরিভাবেই। সামান্য যে বিচ্যুতি আছে, তাতে আপাতত সমস্যা নেই।

জৌনপুরী রাগে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রেকর্ডের অভাব নেই। আমি আপাতত দুটি রেকর্ডের কথা বলব। প্রথমটি একটি খেয়াল— ‘ফুলবনকী গেন্দন মারো রে!’ শিল্পী ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ।

আর অন্য রেকর্ডটির শিল্পী ওস্তাদ বিসমিল্লা খাঁ। তার সানাই-এ শুনুন রাগটির রূপ।

জৌনপুরী সকালের রাগ। এর সঙ্গে শুদ্ধ রে যুক্ত আশাবরীর খুবই মিল, কিন্তু তবু রসের একটা পার্থক্য আছে। শুদ্ধ ‘রে’ যুক্ত আশাবরী শান্ত রসের রাগ; কিন্তু জৌনপুরীর মূল ভাব শৃঙ্গার। ফৈয়াজ খাঁর খেয়ালটির বাণী মনে করুন— ‘ফুলবনকী গেন্দন ম্যায়কা ন মারো রে’, অর্থাৎ প্রেমিকা প্রেমিককে বলছে— ফুলের বল বানিয়ে ওভাবে ছুঁড়ে মেরো না। এ ছবি নিঃসন্দেহে শৃঙ্গারেরই ছবি।...এবং শৃঙ্গারের গভীরেই যে বিরহ লুকিয়ে এও নিশ্চিত আর তাই জৌনপুরীও সে বিষণ্ণতাকেই ধারণ করে থাকে। আশ্চর্য! অবরোহণের সময় সকালের উজ্জ্বল আলোয় যেন একটি বিশেষ স্বরেই হঠাৎ ওই বিষণ্ণতার ছোঁয়া লাগে এবং সে স্বরটি নিশ্চিত ভাবেই কোমল গান্ধার, মানে কোমল গা, যার প্রতীক হলো, ‘জ্ঞা’। হ্যাঁ, প্রতিটি স্বরের একটি করে নাম আছে। ‘সা’ হলো ষড়জ, ‘রে’ হলো ষড়জ্ঞ, ‘গা’ হলো গান্ধার, ‘মা’ হলো মধ্যম, ‘পা’ হলো পঞ্চম, ‘ধা’ হলো ধৈবত এবং ‘নি’ হলো নিষাদ বা নিখাদ। এর আবার রকম ফেরে কোমল বা শুদ্ধ হতে পারে। মধ্যমের ক্ষেত্রে বলা হয় শুদ্ধ বা কড়ি মধ্যম। কড়িকে কেউ কেউ তীব্রও বলেন। একই কথা। খুব ধীরে ধীরে আমরা সঙ্গীত শাস্ত্রের এমনি সব কিছু কিছু চলতি শব্দের সঙ্গে পরিচিত হলে, আমাদের কথা বলতে সুবিধা হবে। তবে অবরোহণে জৌনপুরী রাগের কোমল গান্ধারটি ঠিক কোনখানে সেটা আমরা একটু অন্যভাবেও বোঝাতে পারি। ফৈয়াজ খাঁর গানটি শুনুন মনোযোগ দিয়ে। ‘ফুলবনকী গেন্দন ম্যায় কা ন মারোরে’— এই বাণীর মধ্যে তিনি যখন ‘ন’ অক্ষরটি (নীচে দাগ দেওয়া আছে) উচ্চারণ করছেন তখন তিনি আসলে কোমল গান্ধারকেই স্পর্শ করছেন। ‘ন’ অর্থাৎ না, এই নিষেধের মধ্যেই যেন একটা দূরত্ব, একটা বিরহের সূচনা হলো আর সেটাই বিরহের আভাস হয়ে ওঠে।

আরো একটু লক্ষ্য করুন, প্রথমেই, ‘ফুলবনকী’— এই শব্দগুচ্ছের মধ্যে দিয়ে কিভাবে হঠাৎ সকালের আলোর উদ্ভাস ঘটল। মাত্র তিনটি শব্দাংশকে অবলম্বন করে তিনি সা থেকে পা-তে পৌঁছে গেলেন এবং সে উন্মোচন হলো এই রকম— ফুল (সা), বন (রে), কী (পা), যা জৌনপুরী রাগের বিশিষ্ট এবং একান্তভাবেই নিজস্ব একটি ভঙ্গিমাকে চিনিয়ে দেয়। অবশ্য শুদ্ধ ঋষভ আশাবরীর এবং গান্ধারীও এই একই ভঙ্গী লক্ষ্য করা যায়। কোন স্বরগুচ্ছ, সেটা বড় কথা নয়, এমন কি ‘ফুলবন কী’— কথাটাও নয়, শুধু তাকে অবলম্বন করে যে সুর, সেটাই মনে রাখুন আর তাহলেই জৌনপুরীকে চেনা অনেক সহজ হবে।

এবার গান্ধারী প্রসঙ্গে আসি। এ রাগটি যদিও এখন প্রায় অবলুপ্ত, তবু দুটি রেকর্ডের কথা মনে পড়ছে। একটি বহু পুরোনো— শতবর্ষ অতিক্রম করেছে। যতদূর মনে পড়ছে ১১০৫ সালের রেকর্ড। শিল্পী, মাল্কা জান্। দুজন মাল্কা জানের কথা জানা যায়। একজন মাল্কা জান চুলবুল্লেওয়ালী এবং অন্যজন মাল্কাজান আগ্রাওয়ালী। ইনি আগ্রাওয়ালী। রেকর্ডটি 78 RPM.

আরেকটি, অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিককালের যে রেকর্ডটির কথা বলছিলাম, সেটির শিল্পী মল্লিকার্জুন মনসূর। এই রেকর্ডটি বড় এবং গান্ধারী রাগের রূপটা আরো বিস্তৃত ভাবে পাওয়া যেতে পারে।

নজরুলের কোনো গানে গান্ধারী রাগের প্রয়োগ, আমার স্মরণে নেই। তবে থাকতেও পারে, আমার জানা নেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের দুটি গান নিশ্চিত ভাবেই গান্ধারী রাগাশ্রিত এবং সে দুটি গান হলো, কার বাঁশি নিশি ভোরে বাজিল মোর প্রাণে এবং অন্যটি— নিশিদিন মোর পরানে।

গান্ধারী রাগটি একটু ভোরের রাগ, খুব ভোর নয়, কিন্তু সকালের আলো তখনো খুব জোরালো হয়ে ওঠেনি— এই রকম সময়ের। ‘কার বাঁশি নিশি ভোরে’ গানটিতে যদিও ‘ভোর’ শব্দটিই ব্যবহৃত হয়েছে কিন্তু এর পরের অংশটায় প্রবেশ করলে হয়তো, একটু অন্যরকম মনে হতে পারে। পুরো গানটাই তুলে দিচ্ছি—

“মরি লো, কার বাঁশি নিশি ভোরে বাজিল মোর প্রাণে—ফুটে দিগন্তে অরুণকিরণ-কলিকাশরতের আলোতে সুন্দর আসে,ধরণীর আঁখি যে শিশিরে ভাসেহৃদয়কুঞ্জবনে মুঞ্জরিল মধুর শেফালিকা”

প্রথমেই লক্ষ্য করুন, বাঁশি বেজেছে কবির প্রাণে এবং নিশি ভোরও হয়েছে প্রাণেই। সূর্যকিরণের কলিও প্রস্ফুটিত হয়েছে প্রাণেরই দিগন্তে। অধিকন্তু, সময়টা শরৎকাল। শরতের আলোয় সুন্দরের আগমন দর্শন করছেন কবি। অর্থাৎ রাত্রির অন্ধকার দূরীভ‚ত হয়ে পুরোপুরি আলো ফুটছে। গান্ধারী ঠিক এই সময়েরই রাগ। এই সময়কে প্রত্যক্ষ করুন, তাহলেই গান্ধারীকে চিনতে পারবেন অনায়াসে— কারণ যে ঠিক ওই সময়েরই ছবি ফুটিয়ে তুলবে আপনার মনে। তার রঙ ভোর আর সকালের সন্ধিলগ্নের আলোর মতো। গান্ধারীর সুরে ওই রঙটিই আপনি দেখতে পাবেন।

অনেকেই বলবেন, এ অনুভূতি একান্তই ব্যক্তিগত। অথচ আশ্চর্য, আমি যদি বলি গাছের পাতার রঙ সবুজ, কিংবা সমুদ্রের রঙ নীল, তখন সেটাকে ব্যক্তিগত অনুভব বলা হবে না— এটা প্রায় নিশ্চিত। এর কারণ নেহাৎই এই যে, তারা গাছের পাতা দেখেছেন। সমুদ্র হয়তো সবাই দেখেননি, কিন্তু বহু বহু মানুষ দেখেছেন এবং তাদের কথা শুনে যারা দেখেননি তারাও কথাটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ একই বিষয়কে পাঁচজন পাঁচ রকম দেখবেন— এটা আমরা ভাবতে অভ্যস্ত নই। কিন্তু গান্ধারী রাগটিকে শোনার অভিজ্ঞতা অধিকাংশ মানুষেরই নেই। এমনকি ভৈরবী বা বেহাগ কিংবা কোনো রাগকেই অধিকাংশ মানুষ সেভাবে শোনেন না। কিন্তু শুনলে সবার অনুভব কি এক রকমই হওয়াটা স্বাভাবিক নয়? যদি বলেন শোনা আর দেখাটা তো এক কথা নয়।

উত্তরে বলব, একই কথা না হলেও, যোগসূত্র একটা আছে। ‘পাতা’ শব্দটা শুনলে কি আপনার চোখের সামনে সবুজ রঙটাই ভেসে ওঠে না? হয়তো, বাঙলা ভাষা না জানলে সেটা হবে না। হয়তো কেন? নিশ্চিত ভাবে হবে না; কিন্তু তা শ্রবণের মধ্যে দিয়ে রঙের অনুভব যে সম্ভব— সেটা সুনিশ্চিতই হলো। অবশ্য সুরের ভাষার কোনো অভিধান নেই বরং তা প্রত্যক্ষ অনুভবের। তাই গান না শিখেও প্রকৃত সঙ্গীত শ্রবণ মাত্র আমরা আলোড়িত হই। শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি শুনে শ্রীধারা বলছেন— ‘কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল রে/আকুল করিল মোর প্রাণ।’ বাঁশির সুর কি অভিধান মেনে চলে।

তেমনিই, শরতের ভোরের আলো দেখে কবির প্রাণে ঠিক ওই গান্ধারীর সুরটিই বেজে উঠেছে এটা যেমন সত্য, ঠিক তেমনিই যে নিবিষ্ট শ্রোতার প্রাণের বীণাটির সুর ঠিক ঠিক বাঁধা হয়ে গেছে, গান্ধারী রাগটি শ্রবণ মাত্র তাঁর চোখের সামনে ওই ভোরের আলোর ছবিটাই হুবহু ফুটে উঠবে।

বিষয়টা তর্কের নয়। অনুভবের। প্রত্যক্ষের। এবং সেই সঙ্গে অবশ্যই অভ্যাসেরও বটে। শ্রবণের মধ্যে দিয়েই রাগরূপকে দর্শন করা সম্ভব নিশ্চিত ভাবেই। অতএব শুনুন, শুনুন এবং শুনুন— তাহলেই আপনার সামনে এক অনন্ত আনন্দের উৎসমুখ খুলে যাবে। একই রাগের মধ্যে কত অনন্ত রূপের খেলা, আবার তারই মধ্যে আবার অন্যরাগের চকিত উদ্ভাস আবার চকিতেই অন্তর্ধান হয়ে যাওয়া, যাকে বলে আবির্ভাব/তিরোভাব, তাও লক্ষ্য করুন এবং উপভোগ করুন।

একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। এই যে জৌনপুরী রাগটির কথা বলছি, এর মধ্যে চকিতে আপনি দরবারী কানাড়ার আভাস পেয়ে হয়তো হঠাৎ চমকে উঠতে পারেন। কিন্তু সেটা একান্তই স্বাভাবিক, কারণ দরবারী কানাড়া যদিও গভীর রাত্রির রাগ কিন্তু তা আশাবরী ঠাটেরই রাগ। ফলে স্বরগত মিল তো থাকবেই! কিন্তু, ভাবগত পার্থক্য দুস্তর হওয়া সত্ত্বেও, একের মধ্যে হঠাৎ অন্যের প্রকাশ ঘটে এবং সে এক আশ্চর্য আনন্দের অভিজ্ঞতা। এই জৌনপুরী এবং দরবারীর একের মধ্যে অন্যের প্রকাশ প্রত্যক্ষ করতে হলে, আপনাকে শুনতে হবে এনায়েৎ খাঁ সাহেবের সুর বাহারে জৌনপুরী এবং দরবারী কানাড়া আলাপের রেকর্ড দুটি।

খুব বড় শিল্পীরা এটা পারেন। তারা জানেন, দুটি রাগের নৈকট্য যতখানি সত্য, তাদের পার্থক্যটা তার চাইতেও বড় কথা। একটি রাগের মধ্যে অন্য একটি রাগের আবির্ভাব যদি মাত্রা ছাড়ায়, যদি যথা সময়ে তিরোভাব না আসে, তবে রাগের মৃত্যু হয়।

শুনতে শুনতে আপনিও ক্রমশই বুঝতে পারবেন, সেই সীমারেখা ঠিক কতখানি। (চলবে)

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
আশরাফুলের হ্যাটট্রিকে আবাহনীর টানা ৮ জয়
আশরাফুলের হ্যাটট্রিকে আবাহনীর টানা ৮ জয়
ভিকারুননিসায় জালিয়াতি করে আরও ৩৬ ছাত্রী ভর্তির তথ্য ফাঁস
ভিকারুননিসায় জালিয়াতি করে আরও ৩৬ ছাত্রী ভর্তির তথ্য ফাঁস
পানিতে ডুবে ভাইবোনসহ ৩ শিশুর মৃত্যু
পানিতে ডুবে ভাইবোনসহ ৩ শিশুর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা