X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১
চার পর্বে

বাংলা চলচ্চিত্রের সুবর্ণ সময়

রহমান মতি
২০ নভেম্বর ২০১৮, ১০:০০আপডেট : ২০ নভেম্বর ২০১৮, ১০:০০

বাংলা চলচ্চিত্রের সুবর্ণ সময় সত্তরের দশক

সত্তর দশক ছিলো বাংলা সিনেমার অন্যতম একটি বিশেষ সুন্দর সময়। ষাটের দশকই সুন্দর সত্তরের ভিত্তি। ষাটের রুচিশীল ছবি নির্মাণের ধারাবাহিকতায় সত্তরে নির্মিত হয় বেশ ভালো কিছু ছবি। এই দশকের অন্যতম বিশেষত্ব ছিল ছবির সুন্দর নামকরন। এ দশকে অনেক সুন্দর, রুচিশীল নামের ছবি নির্মিত হয়েছিল। যেমন : ‘যে আগুনে পুড়ি’ ‘সূর্য ওঠার আগে’ ‘আদর্শ ছাপাখানা’ ‘বিন্দু থেকে বৃত্ত’ ‘জীবন থেকে নেয়া’ ‘পিচ ঢালা পথ’ ‘দর্পচূর্ণ’ ‘স্বরলিপি’ ‘কত যে মিনতি’ ‘রং বদলায়’ ‘ঢেউয়ের পর ঢেউ’ ‘কাঁচ কাটা হীরে’ ‘দীপ নেভে নাই’ ‘নাচের পুতুল’ ‘স্মৃতিটুকু থাক’ ‘মানুষের মন’ ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’ ‘পলাশের রং’ ‘ছন্দ হারিয়ে গেল’ ‘ধীরে বহে মেঘনা’ ‘বলাকা মন’ ‘ঝড়ের পাখি’ ‘উজ্জ্বল সূর্যের নিচে’ ইত্যাদি।

সুন্দর নামের ছবির সংস্কৃতি আশির দশকেও ছিল তবে এর উৎকর্ষ সত্তর দশকেই। সত্তর দশকের ছবি শিখিয়েছে পারিবারিক মূল্যবোধ, রাষ্ট্রীয় বাস্তবতা, সম্পর্কের নানা গতি-প্রকৃতি, সাহিত্যভিত্তিক ছবির গুরুত্ব, শ্রেণিবৈষম্যের বাস্তবতা, রোমান্টিসিজম ইত্যাদি। এসময়টিতেও আনোয়ার হোসেন, শর্মিলী আহমেদ, আনোয়ারা, রোজী আফসারী, রাজ্জাক, সুজাতা, কবরী তাদের পাশাপাশি শাবানা, ববিতা,  বুলবুল আহমেদ, সুচরিতা, সুলতানা জামান, নাসিমা খান, আলমগীর, সোহেল রানা, জসিম, ওয়াসিম, উজ্জ্বল, ফারুক, অলিভিয়া, কাজরী তাদের সুবর্ণ সময়। বিভিন্ন ধরনের ছবি তারা উপহার দিয়েছিল।

এ দশকে যাত্রা শুরু করা সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা ছিলেন ‘শাবানা’ যিনি পরবর্তীকালে বাংলা সিনেমায় দীর্ঘসময় ধরে রাজত্ব করেছেন। বিভিন্ন ধরনের ছবিতে অভিনয় করে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। পাশাপাশি রাজ্জাক, বুলবুল আহমেদ, কবরী, আলমগীর, ববিতা, ফারুক, উজ্জ্বল, ওয়াসিম ছিলেন স্ব-স্ব ক্ষেত্রে উজ্জ্বল। নায়কদের মধ্যে রাজ্জাক সবথেকে সিনিয়র ও বৈচিত্রের কারণে বিখ্যাত 'চিত্রালী' পত্রিকার সম্পাদক আহমেদ জামান চৌধুরীর কাছ থেকে 'নায়করাজ' উপাধি পান।

সত্তর দশকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নির্মাণ ঘটে চাষী নজরুল ইসলামের মাধ্যমে। মুক্তিযুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধের সময়েই চিত্রধারণ করা সাহসী পদক্ষেপে 'ওরা ১১ জন' ছবি নির্মাণ করেন তিনি। ছবিটি অল্পসময়েই ইতিহাস গড়ে। এরপর নির্মাণ করেন 'সংগ্রাম'।

সুভাষ দত্তের 'অরুণোদয়ের অগ্নিস্বাক্ষী' আরেকটি অসাধারণ ছবি। মমতাজ আলীর 'রক্তাক্ত বাংলা', আনন্দ’র ‘বাঘা বাঙালি' সত্তরের আলোচিত কাজ। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় মজুতদার পুঁজিবাদী শ্রেণির নিম্নবিত্তকে শোষণের বাস্তবতায় নির্মিত হয় 'আলোর মিছিল' ছবিটি। পুঁজিবাদী কালোবাজারি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দেশের তরুণ প্রজন্মের বিপ্লবী অবস্থান ছিল ছবির লক্ষ্য। 'দিন বদলের দিন এসেছে/ কান পেতে ঐ শোন' গানটি সেই বিপ্লবেরই স্বর পাওয়া যায়। বাস্তবতা তুলে ধরেছিল 'দুঃখ করো না বন্ধু তোমরা' গানটি। খান আতাউর রহমান’র 'আবার তোরা মানুষ হ' আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ।

ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতিকে পারিবারিক আবহে প্রতীকী করে জহির রায়হান নির্মাণ করেন 'জীবন থেকে নেয়া' ছবিটি। এটি ছিলো সত্তরের অন্যতম প্রধান আলোচিত ছবি। রওশন জামিলের চাবির গোছার মধ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে প্রতীকি করে পরিবারে অমানুষিক অত্যাচার দেখানো হয়েছে, যা ছিল রাষ্ট্রে সাধারণ মানুষের উপর ক্ষমতাসীনদের দৌরাত্ম্য। 'এ খাঁচা ভাঙব আমি কেমন করে', খান আতার অভিনয়ে গানটি ছিল ক্ষমতাসীন ও অত্যাচারিত মানুষের আহাজারি। আলমগীর কবির, জহির রায়হানের মতো আরেকজন সাহসী নির্মাতা ছিলেন। তার 'ধীরে বহে মেঘনা, সীমানা পেরিয়ে, সূর্যকন্যা, রূপালি সৈকতে' এ তিনটি ছবি চিন্তার দিক থেকে নতুন একটা বিপ্লব এনেছিলো। 'সীমানা পেরিয়ে' ছবিতে তিনি যে কাজ দেখিয়েছেন তার গভীরতা অনেক। সমাজের উঁচুতলার ফ্যাশনেবল চিন্তাধারাকে চপেটাঘাত করেছেন নিম্নশ্রেণির এক চরিত্রের মাধ্যমে। বুলবুল আহমেদ কালু চরিত্রে ছিল সেই নিম্নশ্রেণির প্রতিনিধি আর উঁচুতলার অহংকারী ছিল জয়শ্রী কবির। পরে জয়শ্রী বুলবুলকে ভলোবেসে বিয়ে করেছিল। শ্রেণিসংগ্রাম করেছিল বুলবুলের সাথে নির্জন দ্বীপে। অনেকদিন পর বাড়ি ফিরে জয়শ্রী অহংকারী বাবার মুখের উপর কড়া জবাবও দিয়েছিল বুলবুলের জন্য। 'সাইলেন্ট মেজোরিটি' বলে পরিচিত করিয়েছিল বুলবুলকে যাদের বিপ্লবী অবস্থানে সুবিধাবাদী পুঁজিবাদী শ্রেণির পতন ঘটতে পারে। জয়শ্রী অভিনীত 'বিমূর্ত এই রাত্রি আমার' গানটি নারীর জেগে ওঠার আহবান দেখায় ঔপনিবেশিক সময়ের বিপরীতে। অনন্য সাধারণ গান। 'সূর্যকন্যা' ছবিতে নারী জাগরণ দেখিয়েছেন তিনি। রাজশ্রী বোসের 'আমি যে আঁধারে বন্দিনী' গানটি অনালোকিত নারীকে তুলে ধরে তাকে আলোর জগতে ফিরিয়ে আনেন জয়শ্রী কবিরের মাধ্যমে। আলমগীর কবির, বুলবুল আহমেদ ছিলেন নির্মাতা ও অভিনয়শিল্পীর ব্যতিক্রমী কম্বিনেশন।

সাহিত্যভিত্তিক ছবির মধ্যে অন্যতম ছিলো 'সূর্যদীঘল বাড়ি'। আবু ইসহাকের জীবনমুখী উপন্যাস থেকে ছবিটি নির্মাণ করেন মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলী। আলাউদ্দিন আল আজাদের 'তেইশ নম্বর তৈলচিত্র' উপন্যাস থেকে সুভাষ দত্ত নির্মাণ করেন 'বসুন্ধরা।' ঋত্বিক ঘটক নির্মিত 'তিতাস একটি নদীর নাম' ছিল মাইলফলক। অদ্বৈত মল্ল বর্মণের উপন্যাস থেকে নির্মিত হয় ছবিটি। অস্কারেও পাঠানো হয়েছিল ছবিটি।

প্রথম অ্যাকশন ছবি নির্মিত হয়েছিল সত্তরেই। রাজ্জাকের 'রংবাজ' ছবিটি ছিল প্রথম অ্যাকশন ছবি। রাজ্জাক-কবরী জুটির অনবদ্য ছবি। ছবিতে ব্যবহৃত 'হৈ হৈ রঙ্গিলা রঙ্গিলা রে’, ‘সে যে কেন এলো না' গানগুলো পরবর্তীতে ক্লাসিক গানের আসনে স্থান পেয়েছে। রোমান্টিক সিনেমার জোয়ার বয়েছে সত্তরে। এহতেশামের 'পিচ ঢালা পথ' ছবিতে জীবনের ছাপ যেমন ছিল তেমনি ছিল রোমান্টিকের জমজমাট আবহ। 'পিচ ঢালা এই পথটারে ভালোবেসেছি/ তার সাথে এই মনটারে বেঁধে নিয়েছি' এরকম জীবনমুখী গান যেমন আছে পাশাপাশি 'ফুলের কানে ভ্রমর এসে' এরকম খাঁটি রোমান্টিক গানও আছে। অশোক ঘোষের 'নাচের পুতুল' ছবির 'আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন' গানটি বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রোমান্টিক গান।

রাজ্জাক পরিচালিত, প্রযোজিত, 'অনন্ত প্রেম' ছবিটি সমালোচিত হয়েছিল ঢাকাই ছবিতে প্রথম চুম্বনদৃশ্যের জন্য। ছবিটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন রাজ্জাক ও ববিতা।

এহতেশামের 'চকোরী' ছবিতে শাবানা প্রথম নায়িকা হয়ে আবির্ভূত হন পাকিস্তানি নায়ক নাদিমের বিপরীতে। ছবিটি উর্দু ও বাংলা দুই ভাষাতেই পাওয়া যায়। ফারুক-কবরী জুটির 'সুজন সখি' ছিল এ দশকের আলোচিত ছবি। ছবির গানগুলো ক্লাসিক এবং গ্রামীণ প্রেক্ষাপটে ফারুকের বিকল্প কোনো নায়ক তখন ছিল না। বিশেষ করে 'লাঠিয়াল' ছবিতে ফারুকের গ্রাম্য প্রতিবাদী যুবকের ভূমিকা অনবদ্য ছিল। তখনকার গ্রামীণ সমাজ ফারুক তার অভিনয়ের মধ্য দিয়ে মোড়ল, মহাজনদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছিলেন। মাসুদ পারভেজ বা সোহেল রানা জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজ 'মাসুদ রানা' অবলম্বনে একই নামে ছবিটি নির্মাণ করেন। নিজেই ছিলেন নায়কের ভূমিকায়। ছবিটি তার ক্যারিয়ারের আলোচিত ছবি। 'মনেরও রঙে রাঙাব' গানটি জনপ্রিয় গান এ ছবির। ফোক-ফ্যান্টাসির রাজা ইবসে মিজান তার ট্র্যাকের বাইরে গিয়ে নির্মাণ করেন 'এক মুঠো ভাত' ছবিটি।

এস এম শফি নৃত্যপটিয়সী অলিভিয়াকে দিয়ে নির্মাণ করেন 'দি রেইন' (যখন বৃষ্টি নামল) ছবিটি। ছবির বেশ কয়েকটি গান সুপারহিট হয়, বিশেষ করে 'একা একা কেন ভালো লাগে না’, ‘আয়রে মেঘ আয়রে' গানগুলো। যৌনশিক্ষা বিষয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য নির্মিত হয় আজাদ রহমানের 'গোপন কথা' ছবিটি। রোমান্টিক ড্রামায় 'এপার-ওপার' অসাধারণ ছবি। সোহেল রানার বিপরীতে বোম্বের সোমা অভিনয় করেছিল। ছবিতে 'ভালোবাসার মূল্য কত, মন রেখেছি আমি' গান দুটি সুপারহিট ছিল। আজিজুর রহমানের 'অশিক্ষিত, মাটির ঘর' ব্যতিক্রমী নির্মাণ ছিল। প্রথমটিতে রাজ্জাককে পড়াত তার ছোট্ট বন্ধু মাস্টার সুমন। 'ও মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই' গানটি তখন সবার মুখে মুখে ছিল। 'মাটির ঘর' ছবিটি প্যাথেটিক স্টোরির ছিল। কবরকে মাটির ঘর প্রতীকী করে দেখানো হয়েছে যা মানুষের সর্বশেষ আশ্রয়। 'পাগলা রাজা' ছবিটি রাজ্জাকের ক্যারিয়ারে ব্যতিক্রমী ছবি ছিল। কমেডি ছবির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ফাঁক-ফোঁকর তুলে ধরা হয়েছিল। আমজাদ হোসেন-এর মতো সাহসী নির্মাতার জন্ম হয়েছিল সত্তরে। তিনি বিরাট একটা সময়ের স্বাক্ষী। তার 'গোলাপি এখন ট্রেনে’, ‘নয়নমনি’, ‘সুন্দরী' ছবিগুলো ছিল এক একটি মাইলফলক ছবি। জীবনমুখী ছবি নির্মাণে তার দক্ষতা অতুলনীয়।

কাজী হায়াৎ-এর প্রথমদিকের ছবি 'দি ফাদার' ছিল সত্তরের অন্যতম আলোচিত ছবি। সুচরিতার বাবার ভূমিকায় বিদেশি একজন অভিনেতা ছিল। তার জীবনের বাস্তব গল্প থেকে বাবা-মেয়ের ছবি। এ ছবির 'আয় খুকু আয়' গানটি শোনেনি এমন মানুষ মেলা ভার। আব্দুল্লাহ আল মামুন নির্মিত 'সারেং বৌ' সত্তরের অনবদ্য ছবি। এ ছবির 'ওরে নীল দরিয়া' সমগ্র ঢাকাই ছবির ইতিহাসে অতুলনীয় গান। (চলবে)

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া