মায়া এঞ্জেল্যু। মার্কিন কবি। গায়িকা এবং সিভিল রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবেও বিশ্বে সমান পরিচিত। উপার্জন শুরু করেন রান্নার কাজ করে। যৌনকর্মী এবং নাইটক্লাবে নর্তকীও হতে হয়েছে বেঁচে থাকার তাগিদে। মায়া শৈশবে ধর্ষিত হয়ে অসুস্থ ছিলেন দীর্ঘ পাঁচ বছর। এসময় তিনি ক্লিনিক্যালি মূক। জীবনে অনেক চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে উপশম খুঁজেছেন কবিতায়। কবিতা তাকে ফিরিয়ে দেয়নি। আজ তার ৯১ তম জন্মদিনে বাংলা ট্রিবিউনের পাঠকদের জন্য ৫টি কবিতা প্রকাশ করা হলো।
তবু আমি জাগি
হয়তো তুমি ইতিহাস লিখবে আমাকে নিয়ে
তোমার তেতো আর বিকৃত মিথ্যে মাখিয়ে
হয়তো আবর্জনার ভেতর
দু'পায়ে মাড়িয়ে যাবে
তবুও আমি ধুলোর মতোই
জেগে উঠবো
আমার এই হাসিখুশি ভাব কি
তোমাকে কাতর করে?
কেন এতো মনমরা হয়ে থাকো ?
যেন পেয়েছি তেলের খনি
এভাবেই হাঁটি
নিজের ঘরই তা উত্তোলন করি।
আমি জেগে উঠি
চাঁদ ও সূর্যের যেমন আছে
জোয়ারভাটার নিশ্চয়তা
আশার যেমন পুনরুত্থান
তেমনি আমিও জাগবো
আমাকে কি দেখতে চেয়েছিলে
নত চোখ, নত মাথা?
পুরোটা ভঙ্গুর?
অশ্রুর মতো কাঁধ ঝুকে পড়েছে?
ক্ষত হৃদয়ের কান্নায় দুর্বল হয়ে গেছি?
আমার উদ্ধত ভাব কি তোমাকে ক্ষুব্ধ করে?
তোমাকে কি এটা নির্মমভাবে আতঙ্কিত করে না
এই যে আমি এমনভাবে হাসি যেন আমি সোনারখনি পেয়ে গেছি
আমার বাড়ির পিছনের উঠোন থেকে খনন করে আনছি...
তুমি তোমার শব্দ দিয়ে আমাকে গুলি করতে পারো
অগ্নি দৃষ্টিতে আমাকে কেটে ফেলতে পারো
তীব্র ঘৃণা দিয়ে আমাকে হত্যাও করতে পারো
কিন্তু তখনো আমি বাতাসের মতোই
জেগে উঠবো
আমার যৌন আবেদনময়তা কি তোমাকে দুঃখী করে তোলে?
তুমি কি আশ্চর্য হও
যখন আমি এমনভাবে নাচি যেন
আমার ঊরুর জঙ্গমে হীরে পেয়ে গেছি?
আমি জেগে উঠি
ইতিহাসের লজ্জাকর অধ্যায় থেকে
আমি জেগে উঠি
অতীতের ব্যথার গহ্বর থেকে
আমি বিস্তৃত, উত্তাল, একটি কালো মহাসমুদ্র
স্ফীত হয়ে ফুলে উঠছি জোয়ারের ঢেউয়ে
আমি জেগে উঠি
রাতের ত্রাস ও ভয়কে পিছনে ফেলে
আমি জেগে উঠি
বিস্ময়কর উজ্জ্বল ঊষাতে
আমি জেগে উঠি
আমার পূর্বপুরুষদের কাছে পাওয়া উপহার নিয়ে
আমিই সেই ক্রীতদাসের স্বপ্ন
এবং ক্রীতদাসের আশা
আমি জাগি
আমি জাগি
আমি জাগি!
বিস্ময়কর নারী
সুন্দরীরা জানতে চায় আমার রহস্য কোথায়
আমি মোহনীয় নই, নেই ফ্যাশন মডেলদের মতো দেহ সৌষ্ঠবও
কিন্তু আমি ওদের এগুলো বললেই
ওরা ভাবে আমি মিথ্যে বলছি
আমি বলি,
এটা আমার দু’বাহুর নাগালেই আছে
নিতম্বের বিস্তারে
হাঁটার দৈর্ঘে
ঠোঁটের ঢেউয়ে
আমি একজন নারী
বিস্ময়করভাবে
আশ্চর্যজনক নারী!
এটাই আমি
আমি রুমের ভেতর হেঁটে যাই
যতটা তুমি পছন্দ করো ততটা শীতলভাবে
এবং একটি পুরুষের কাছে
যারা দাঁড়িয়ে থাকে অথবা
হাঁটুতে ভর করে ঝুঁকে পড়ে
তারা ঝাঁকে ঝাঁকে আমার চারপাশে ঘোরে
যেমন মৌচাক ঘিরে মৌমাছিরা
আমি বলি
আমি বলি
এটা শুধু আমার দৃষ্টির ভেতরের আগুন
এবং আমার দাঁতের ঝলক
আমার কোমরের দুলুনি
এবং আমার পায়ের ভেতরের উচ্ছ্বাস
আমি একজন নারী
বিস্ময়করভাবে
আশ্চর্যজনক নারী!
এটাই আমি
পুরুষ নিজেরাও বিস্মিত হয়
তারা আমার ভেতর কি দেখে
তারা এতো চেষ্টা করে
কিন্তু তারা ছুঁতে পারে না
আমার গভীরের রহস্য
আমি যখন তাদের দেখানোর চেষ্টা করি
তারা তখনো বলে তারা কিছুই দেখেনি
আমি বলি
এটা আমার ধনুকবাঁকা পিঠে
হাসির রোদ্দুরে
স্তন যুগলের তরঙ্গে
আমার আভিজাত্যময় চলনে
আমি একজন নারী
বিস্ময়করভাবে
আশ্চর্যজনক নারী!
এটাই আমি
এবার বুঝে নাও
কেন আমার মাথা নত নয়
চিৎকার করি না অথবা লাফঝাঁপ নয়
অথবা উচ্চস্বরে কথা বলতে হয় না
আমার যাতায়াত দেখলে
তোমার গর্বিত হওয়া উচিত
আমি বলি,
এটা আমার জুতোর গোড়ালির ঝঙ্কার
চুলের ভাঁজে
হাতের তালুতে
আমার যত্নের প্রয়োজনীয়তায়
যেহেতু আমি একজন নারী
বিস্ময়করভাবে
আশ্চর্যজনক নারী!
এটাই আমি।
একাকী
শুয়ে শুয়ে ভেবেছি
গতকাল রাতে ,
কি করে একটি প্রাণের আশ্রয় পাই
যেখানে পানি তৃষ্ণার্ত নয়
এবং রুটিগুলো পাথর হয়ে ওঠেনি
আমি একটি ব্যাপার বুঝেছি
এবং বিশ্বাস করি আমি ভুল নই
এমন কেউ নেই, কেউ না
কেউ এখানে একা টিকতে পারে না
একা, সম্পূর্ণ একা
কেউ নয়, কেউ এখানে একা টিকে থাকতে পারে না।
কিছু কোটিপতি আছে
টাকা দিয়ে তারা কিছুই করতে পারে না
তাদের স্ত্রীরা ঘুরে ঘুরে গুঙিয়ে মরে
সন্তানরা বেদনার গান গায়
তাদের পকেটে অনেক ব্যয়বহুল ডাক্তার থাকে
তাদের পাথর হৃদয় সারিয়ে তুলতে
কিন্তু কেউ নয়
না, কেউ না,
এখানে কেউ একা টিকে থাকতে পারে না।
একা, একেবারেই একা
কেউ নয়
একেবারেই কেউ নয়
একদম একা এখানে টিকতে পারে না
এখন যদি সত্যি শুনতে চাও
আমি যা জানি, বলবো
ঝড় ও মেঘ জমছে আকাশে
ঝড় বয়ে যাবে
মানবজাতি খুব কষ্টে আছে,
আমি তাদের গোঙানি শুনি,
আসলে কেউ না
একেবারেই কেউ নেই
যে এখানে একা টিকে থাকতে পারে।
একা, একেবারেই একা
কেউ নয়, কেউই না
এখানে একাকী কেউই টিকতে পারে না।
পথিক
নিভৃত পথে, সব ছেড়েছুড়ে
রাতভর একা একা
সূর্যরশ্মি আর সাগরের ঢেউয়ে
তারায় তারায় আর পর্বতে
জনমানবহীন, বন্ধুবান্ধবহীন
কোন গুহাই আমার ঘর নয়
আমার যন্ত্রণা আমারই
বহু রাতের পর রাত একাকী।
যখন তুমি কাছে আসো
যখন তুমি কাছে আসো, অনাহূত
প্রলুব্ধ করো আমায়
বহুদিনের পুরানো ক্ষতে
স্মৃতির পাহাড় জমে আছে
আমি যেন শিশু এভাবেই উঠিয়ে নাও
খুব অল্প কিছু দিনক্ষণের সংগ্রহের জন্য
চুরি করা তুচ্ছ খেলনা যেমন মহার্ঘ হয়
ঋণ করে কেনা প্রেমের উপহারের মতো
গভীর অঙ্গের গোপন কথায়
তখন আমি কাঁদি!