X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

আশীর্বাদ

শফিক হাসান
২০ এপ্রিল ২০২০, ১৯:০০আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০২০, ১৯:০০

করোনায় আমরা ভীত নই। বরং মোকাবেলা করছি গৃহে অন্তরীণ থেকে। এতে হয়ত কিছুটা বাড়তেও পারে মানসিক চাপ। তাই আসুন, খুলে দেই মনঘরের জানালা। নিজেকে চালিত করি সৃজনশীলতায়। আপনি নিয়মিত লিখছেন, বা এটাই হতে পারে আপনার প্রথম গল্প। লিখুন ফেসবুকে। চটজলদি ৫০০ শব্দের গল্প, বাংলা ট্রিবিউনের জন্য। একইসঙ্গে নমিনেট করুন আপনার পছন্দের আরও ১০ জন লেখককে। সেরা ১০ জন লেখক পাচ্ছেন কাগজ প্রকাশনের বই। আর অবশ্যই হ্যাশট্যাগ দিন #বাংলাট্রিবিউনসাহিত্য আশীর্বাদ ‘তুই বাঁইচা থাক রে করুনা, হারা জীবন এই দ্যাশেই থাক। মরি যাইস না!’ সকালের রাস্তায় ফেরিওয়ালার হাঁকডাক শুরু হওয়ার পর থেকে সালেহা বানু খুশিমনে বলে যাচ্ছে এসব। দোয়া করছে করোনাভাইরাসকে, মনে থইথই আনন্দ নিয়ে। এই পর্যন্ত তিনবার পেয়েছে ত্রাণ। ঘরে বসেই এমন উপার্জন করোনার জন্যই তো! মানুষের মন থেকে মায়া-মহব্বত উঠে যাচ্ছে। তাই ভিক্ষার পরিমাণও কমছে। সালেহার উল্লাসে অন্যরা বিরক্ত হয়। পঙ্গু মানুষের মতো ঘরবন্দি থেকে অসহিষ্ণু হয়ে গেছে অনেকে। তারা ধমক দিয়েও সালেহার মুখ বন্ধ করতে পারে না।

বিরক্ত হয়ে পাশের ঘরের সোলেমানের বাপ খেদোক্তি ঝাড়ে—‘করুনা না মরুনা কী আইব, তাড়াতাড়ি আইয়া চইলা যা। না আইলেও ক।’

সামনের ঘরের আম্বিয়ার মা সমর্থন দেয়, ‘কাইল রাইত কী সুন্দর বৈশাখী ঝড় আইল, চাল-চুল কাঁপাইয়া চইলাও গেল আবার। এইডারেই কয় বাপের বেডা!’

গাদাগাদি জনসংখ্যার এই বস্তির সরু গলি দিয়ে যেটুকু আলো আসে—তাতে ঔজ্জ্বল্য দেখে না বাসিন্দারা। অবরুদ্ধ আলোটা তাদের জীবনের মতো ফ্যাকাশে, ম্রিয়মাণ। ব্যতিক্রম শুধু সালেহা, বাতি নিভালেও আলোর রোশনাই দেখে। করোনা অনেকের জন্য অভিশাপ হলেও তার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। বয়সি পা লাঠি ভর দিয়ে বেশি দূর যেতে পারে না। এলাকার লোক ভিখ দেয় না, চিন-পরিচিত দেখলে তো আরও না! জব্বার মিয়ার বস্তিতে হরেক কিসিমের মানুষের বসবাস। দিনমজুর, ফেরিওয়ালা, রিকশাচালক, আত্মগোপনে থাকা গুন্ডা-বদমাশ; ভিক্ষুকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। একেকটা রুমের ভাড়া দুই হাজার টাকা। রুমে যত বেশি মানুষ থাকবে—গড়ে ভাড়া তত কম পড়বে। সালেহাকে মাস শেষে পাঁচশটাকা দিতে হয়। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার ছিন্নমূলের বাস এই টিনের চাল, ঢুলির বেড়ার অন্দরে।

সরকার ঘোষিত ভিক্ষুকমুক্ত এলাকার অল্প দূরেই জব্বার মিয়ার বস্তি। দুই বছর যাবত এখানে থাকছে সালেহা। ফুটপাতে, বারান্দায়, রাস্তায় অস্থায়ী সংসার ছিল আগে। এখন বয়স বেড়েছে, শরীরে রোদ-বৃষ্টি সয় না। এর বাইরেও ঝামেলা কম ছিল না। রাত গভীর হলে পেটের সন্তানের বয়সি ছেলেরা ঘুম ভাঙিয়ে নজরানা চাইত। প্রমাণ দেখানোর খায়েশ—কত তাকদ তাদের।

ঈদের আনন্দ মনে নিয়ে সালেহা একাই কাঁপা কাঁপা হাতে রান্না করে। খায়ও একা। চুলার সিরিয়াল পেতে দেরি হলে আগের মতো খিস্তিখেউড় করে না। রুমের অন্য সদস্যদের অবাঞ্ছিত আচরণেও অপ্রসন্ন হয় না। একধরনের মমতা বোধ করে বিধবা, স্বামী ও পিতা পরিত্যক্তা তিনজনের জন্য। ত্রাণের যে সামগ্রী পেয়েছে রাজার হালে চলবে অন্তত মাসখানেক। বস্তির বাচ্চারা তাদের টেলিভিশনের খবরে শুনেছে—আরও ত্রাণ আসবে। একজন মানুষকেও অভুক্ত মরতে দেয়া হবে না। কী রহমত, কষ্ট করে নিঠুর মানুষের সামনে আর থালা পাততে হবে না।

মসজিদের মাইকে এশার আজান দেয়ার পর কইতরির মায়ের কাছ থেকে চেয়ে এক খিলি পান আনে সালেহা। আয়েশ করে মুখে গুঁজবে—গোঙানির আওয়াজ ভেসে আসে। কান পেতে শোনে—‘ও আল্লা রে, আমি কই যামু...।’ লাঠিতে ঠকঠক শব্দ তুলে বেরোয় সে। বস্তির সামনে কদমতলায় এক মহিলা বসে বিলাপ করছে। আবছা আলোয় মাঝবয়সিই মনে হয়। এগিয়ে জিজ্ঞেস করে—‘তোর কী অইছে রে বইন?’

‘আমার নাকি করুনা অইছে।’

‘করুনা তো লক্ষ্মী। সে করুণা কইরা আমগোরে খাওনের ভাত দিতাছে। যেইডা ভাতারও দিবার পারে না! উঠ, আমার লগে আয়।’

চল্লিশোর্ধ্ব মোমেনা বেগমকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলে ঘরে-বাইরে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকায় কেউ কেউ। ঘরের তিন রাঢ়ির উদ্দেশ্যে সালেহা বলে—‘কী কয়, চুপ কইরা হুন।’

মোমেনা জানায়—গতকাল সর্দি-কাশির মতো হয়েছে। এতে ছেলেরা বুঝে ফেলে করোনা এসেছে ঘরে। অবাধ্য মাকে মারধোর করে তারা অনেক দূরে, এখানে ফেলে গেছে। হাপুস নয়নে কাঁদে মোমেনা—‘আমার কলিজার টুকরারা কয়, মাগি নিজে মরব, আমগোরেও মাইরা যাইব। তারপর আতে পেলাসটিক পেঁচাইয়া আমারে কত কিল-ঘুষি মারছে। লাত্তাইয়া গাড়িত তুলছে...।’

সালেহা হাত ধরে তার—‘কান্দিস না। তুই এহানেই থাকবি। যার কেও নাই, তার করুনা আছে।’

এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নেয় ক্রন্দসী দুঃখিনী—‘আমারে ছুঁইও না বুবু। তোমারেও করুনায় খাইব।’

ফোকলা দাঁতে হাসে সালেহা—‘অমানুষ অইয়া মরণের তন করুনায় মরণই বালা। তয় করুনা আমগো মানুষগোর মতন অতডা খারাপ না! তার দিলে রহম আছে।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী