কোথায় তোমার এত ঢাল-তলোয়ার?
তিনি কোনো আগন্তুক নন;
মোটেও অপ্রত্যাশিত নয় তার আগমন।
যেভাবে বিদ্যুৎ কিংবা পত্রিকার বিল নিয়ে আসে
ঝকঝকে জিন্স পরা অস্থির তরুণ;
আসে মুরগিওয়ালা—মাছের বেপারি—সেইভাবে,
ঠিক... ঠিক সেইভাবে তিনিও আসেন—
তুমি চাও বা না চাও!
বেজে ওঠে কলিংবেল একঘেয়ে স্বরে—
কখনো বাজে না তাও; তবু তিনি ঠিক পৌঁছে যান
প্রার্থিত গন্তব্যে তার এবং আচমকা
তুমি দেখো—নেই, নেই—যেখানে তোমার
হৃৎপিণ্ড রাখা ছিল—সেটি আর কোনোখানে নেই!
শুধু তোমার বেসুরো চিৎকার মাথা ঠুকে মরে
ইট-কাঠ-কংক্রিটের নিধুয়া পাথারে।
শুনে ডন কিহোতের ঘোড়ারাও মুখ টিপে হাসে—
ভ্রূ কুঞ্চিত করে যত যুধ্যমান পাড়া-প্রতিবেশী!
তিনি আসছেন—যেভাবে আসেন তিনি সর্বদাই!
তফাৎ কেবল এই...এইটুকু যে এবার তিনি আসছেন
দামামা বাজিয়ে! প্রিয় পাড়া-প্রতিবেশী
কোথায় তোমার এত ঢাল-তলোয়ার?
সবাই তখন প্রমিথিউসকে খুঁজছিল
সত্যিই সেটি ছিল আমাদের এ যাবৎ কালের দেখা ভয়ঙ্করতম দুঃস্বপ্ন। আমি ক্রমাগত হাত-পা ছুড়ছিলাম আর ঘামছিলাম। আমার স্ত্রী চোখেমুখে জল ছিটাচ্ছিল আর আমার অবাধ্য হাতপাগুলোকে শান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল অক্লান্তভাবে। আচমকা ধেয়ে আসা আজগুবি এক চোরাবালির সমুদ্রে তলিয়ে যেতে যেতে আমি আবার ভেসে উঠি। আনন্দে লাফিয়ে উঠে ছুটে যাই ভোরের বারান্দায়—যেখানে তখনো দুটি দুরন্ত বুলবুলি ঝগড়া করছিল আর পুঁইশাকের বেগুনি ডগাটি মাথা নাড়ছিল আপন মনে : ‘ওহ্ তাহলে সেসব কিছুই ঘটেনি! পৃথিবী আগের মতোই আছে! সত্যিই আগের মতোই আছে সব! স-অ-ব!’
আর তখনই তাকে ত্রস্ত ছুটে আসতে দেখি আমাদের পশ্চিম ধানমন্ডির সংকীর্ণ গলিপথ ধরে। এমন ভয়ার্ত মুখ কেউ কখনো দেখেনি আগে। যদি বলি তিনিই আমাদের আদিমাতা—তাহলে সামান্যই বলা হবে। কত নিবিড়ভাবেই না চিনি আমরা তাকে—সর্বসংহা, অজাতশত্রু, শাশ্বত এ মাতৃমূর্তিটিকে! তার বিদীর্ণ বক্ষ থেকে ছিন্নভিন্ন মাংসপিণ্ডের মতো খসে পড়ছিল শত সহস্র সন্তানের শবদেহ। হীরক ও স্বর্ণখচিত পদকগুলো ছিল পরিত্যক্ত। ঝলমলে পতাকাগুলো ছিল অর্ধনমিত। নাচঘর আর পানশালাগুলোতে উড়ছিল শোকের পতাকা। খাঁচাবন্দি শিশুদের অবাক হয়ে দেখছিল তাদের পোষা কুকুর ও প্রিয় পুতুলগুলো। বাতিগুলো নিভে আসছিল একে একে। বাতিগুলো নিভে আসছিল একে একে। কৃষ্ণবিবর নয়, অতিকায় অথচ অদৃশ্য এক শাদা তিমি ক্রমেই গ্রাস করে ফেলছিল সবকিছু।
বাইরে খুব হট্টগোল। সবাই তখন প্রমিথিউসকে খুঁজছিল।
যুদ্ধ জারি আছে
জানি, তোমার অদৃশ্য থাবা দুমড়েমুচড়ে দেবে
দক্ষিণের বালাখানা—থেমে যাবে ক্লান্ত বায়ুকল।
সব, সবই কি থেমে যাবে!
তুমিই থামিয়ে দেবে মহাজাগতিক ঘড়ি? তুমি?
আমাদের সন্তানেরা তখনো থাকবে।
আমাদের সন্তানেরা তখনো থাকবে।
তাদের অকুতোভয় তরবারি আর ঝলমলে শিরস্ত্রাণ
সাক্ষ্য দেবে—যুদ্ধ জারি আছে, থাকবেই।
হিসাবটা সাদাকালো
সকালেই যাহা তিনশত নয় ঠিক
দুপুরেই দশরাজ!
গতকাল যিনি কুতুব মিনার তিনি
শুধুই সংখ্যা আজ।
মিনার ভাঙবে মিনার উঠবে—সূর্য
ফেরি করবেই আলো;
ফিঙেরা গাইবে বেলিরা দোলাবে মাথা—
হিসাবটা সাদাকালো!
টাকার পাহাড়ে গড়াগড়ি যাও কিংবা
সন্ন্যাস নাও বনে;
আখেরে তো সেই বিশাল শূন্য এক
খেলিছে আপন মনে।
আমি তার তাজা ঘ্রাণ পাচ্ছি
যদি বলি, জরাজীর্ণ পাতাই তো—ঝরেই যেতাম
কোনো এক চৈত্রে—ঝড়ে কিংবা বিনা ঝড়ে;
ক্ষতি কী আজই যদি চুকেবুকে যায়
সব হিসাবনিকাশ! মুশকিল হলো—
জগদীশ চন্দ্র বসু অপঠিত রয়ে গেল আজও!
পাতাও কি ফেলে দীর্ঘশ্বাস? বলো, কে দেবে উত্তর
এই গূঢ় রহস্যের? শেষাবধি কে-বা চায় যেতে?
যখনই যাও, বন্ধু, কিছু মনস্তাপ পোষা কুকুরের মতো
ঠিকই ঠুকবে মাথা নির্বিকার চৌকাঠে তোমার।
যার মনস্তাপ নেই সে থাকে মর্গের নীল বরফশয্যায়;
মাছিও এড়িয়ে চলে তাকে। তোমার ক্ষুধার্ত থাবা—
জানি, খুব দূরে নয় তার প্রার্থিত শিকার থেকে।
কিছুই নেবার নেই, কাউকে বলার নেই কিছু।
বৃথাই তোমার সব লম্ফঝম্ফ—হতোদ্যম হিটলার জানে।
কেননা বোতলবন্দি তোমার গর্জন পায়ে দলে
আমাদের সন্তানেরা ছুটছে সামান্য ফড়িং আর
প্রজাপতির পেছনে—আমি তার তাজা ঘ্রাণ পাচ্ছি...।
কেবল গোলকটাই ছিল বাকি
চেখে দেখা হয়ে গেছে সব—
পাহাড় সমুদ্র আর ফুল-পাখিদের কলরব!
কেবল গোলকটাই ছিল বাকি
বেটা ভীষণ চালাক—ক্রমাগত দিচ্ছে শুধু ফাঁকি!
শোনো যত অকর্মার দল—
বিচ্ছিরি করোনাদিনে আমার বাড়াতে মনোবল
ডিনার টেবিলে চাই পাজিটার রোস্ট
আমি কি পরোয়া করি—হিউম্যান, ঘোস্ট!
তোমার যেখানে ইচ্ছে চলে যাও, গাধা;
চুমু খাও প্রকৃতির পোঁদে—কে দেয় তোমাকে বাধা!
এখানে আমিই রাজা—আমি একাই গিলবো সব;
করোনা মানুষ খাবে—আমি খাবো করোনার শব!
তবু বুক কাঁপে
বলছি বটে যে—পাচ্ছি না ভয় মোটে;
ডুবলে ডুবুক—নাগ-নাগিনীর ভোটে—
অনেক সাধের সপ্তডিঙ্গাখানি;
বণিকের মাথা ঠিক উঁচু রবে, রানি!
বলছি বটে যে—যত জারিজুরি তার
জানা আছে সব; করি না পরোয়া আর!
দেবী বা ডাকিনি—কিবা আসে যায় তাতে—
কলিজাই খাবে কিংবা মারবে ভাতে!
বলছি বটে যে—তৈরি হয়ে আছি; মাছি
দেখুক মানুষ—কলজেটা ধরে আছি!
শবভুক তুমি—তোমার দৌড় তো জানি—
তবু বুক কাঁপে—কাঁপছে ভুবনখানি।