X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

আবুল হাসনাত : এক স্মার্ট সম্পাদক ও লেখকের প্রস্থান

দিলওয়ার হাসান
০৪ নভেম্বর ২০২০, ১০:১৯আপডেট : ০৭ নভেম্বর ২০২০, ১৩:৫৩

আবুল হাসনাত : এক স্মার্ট সম্পাদক ও লেখকের প্রস্থান যে দেশে লেখা প্রকাশের প্রধান বিবেচ্য তৈলমর্দন, তোষামোদ, ব্যক্তিগত পরিচয়, সে দেশ থেকে আবুল হাসনাতের মতো একজন সম্পাদকের প্রস্থান সাহিত্যের জন্যে একটা বড় ক্ষতি।

একজন সম্পাদকের প্রধান কাজই হলো ভালো লেখক চিহ্নিত করা ও নিরন্তর তার লেখা প্রকাশের সুযোগ করে দেওয়া। এরকমই হয়ে আসছে পৃথিবীর সর্বত্র। সম্পাদকরাই লেখক তৈরি করেন।

লেখার মানই যে লেখা প্রকাশের একমাত্র যোগ্যতা আবুল হাসনাত তাঁর জীবদ্দশায় তা প্রমাণ করে গেছেন। শুধু লেখক শনাক্ত করাই সম্পাদকের প্রধান দায়িত্ব নয়, তার আরও এক বড় কাজ প্রকাশিতব্য লেখাটির যথাযথ সম্পাদনা নিশ্চিত করা। এই সম্পাদনার বিষয়টি হাসনাত কতটুকু যত্ন নিয়ে করতে পেরেছিলেন তা জানবার উপায় ছিল না। আমার নিজের অনেক লেখাই তাঁর হাত দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে, কিন্তু সম্পাদকের কলমের আঁচড় সেখানে কমই পড়তে দেখেছি। তাহলে কি আমার লেখাগুলো ভুল-ত্রুটি মুক্ত ছিল? আমার তা মনে হয় না।

তবে তাঁর দরবারে সশরীরে লেখা জমা দিতে গিয়ে নিদারুণ অস্বস্তিতে পড়বার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল। সাম্প্রতিক এক স্মৃতিচারণে আহমদ মোস্তফা কামাল উল্লেখ করেছেন, ১৯৯৪ সালে প্রথম তাঁর কাছে লেখা দিতে গেলে চায়ের আপ্যায়ন তো দূরের কথা, একটু বসতেও বলেননি। কথাও বলেননি ভালো করে। শুধু বলেছেন লেখাটা রেখে যান, পড়ে দেখব। তবে পরের সপ্তাহেই ওই লেখাটি ছাপিয়ে দেন। আমার বেলাতেও এমনই ঘটেছিল। লেখা হাতে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। তিনি নিলেন। টেবিলের সামনে দাঁড়িয়েই আছি, তিনি কিছুই বলেন না। শেষে প্রবল অস্বস্তি নিয়ে আমিই বলি—আমি তাহলে...। তিনি মাথা নাড়েন। আমি হতাশ হই। পরের সপ্তাহেই আমার দীর্ঘ লেখাটি ছাপিয়ে দেন। সেটা আশির দশকের শুরুর দিককার কথা।

এর অল্প-কিছু দিন পরেই আমি সংবাদে যোগ দেই সহ-সম্পাদক হিসেবে। লেখা দিতে গিয়ে তখনও একই রকমের আপ্যায়ন লাভ করেছি। নিচুস্বরে শুধু বলেছেন—আচ্ছা ঠিক আছে, পড়ে দেখব। হয়তো তার অল্প কদিন পরেই লেখাটা ছেপে দিয়েছেন। কখনো কখনো দীর্ঘ লেখা—পুরো পৃষ্ঠাজুড়ে। তাঁর বিবেচ্য বিষয় ছিল লেখা। কোনো রকমের ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়, কথাবার্তা নয়, ক্ষণকালের আড্ডা নয়। তিনি সত্যিকার অর্থেই সৎ, নিষ্ঠাবান ও নির্মোহ সম্পাদক ছিলেন।

যতদূর মনে পড়ে, সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি সংবাদের সাহিত্য পাতার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি সাহিত্য পাতার মুদ্রণ পরিপাট্যের দিকে এতটাই মনোযোগ দেন যে, শুধু লেখার দিক থেকেই নয়, নান্দনিকতার দিক থেকেও তা উৎকৃষ্ট মানের হয়ে ওঠে। প্রতিটি সংখ্যার মেকাপে বিখ্যাত সব শিল্পীদের চিত্রকর্ম ব্যবহার করে পাতাটিকে করে তোলেন দৃষ্টিনন্দন। এ রকম স্মার্ট মেকাপ সমৃদ্ধ দৃষ্টিনন্দন সাহিত্য পাতা তখন কোনো দৈনিকের ছিল না। ফলে সংবাদ সাময়িকীতে লেখা প্রকাশ লেখকদের জন্য একটি সম্মানের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। হাসনাত নিজে ছিলেন সাহিত্য ও শিল্পবোদ্ধা। ছিলেন একজন সফল আর্ট ক্রিটিক ও চিত্রকর্ম সংগ্রাহক। তাঁর এসব গুণপনার সবটাই তাঁর পাতায় প্রতিফলিত হয়েছে। দীর্ঘদিন সংবাদে কাজ করার সুবাদে জেনেছিলাম সাময়িকীর কারণে সংবাদ প্রতি বৃহস্পতিবার কমপক্ষে পাঁচ হাজার কপি বেশি ছাপা হতো। দীর্ঘ দু’দশক তিনি একটানা সংবাদ সাময়িকী সম্পাদনা করেছেন।

স্বাধীনতা পূর্ব বাংলাদেশে যখন তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের (মতিয়া গ্রুপ) সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও সংস্কৃতি সংসদের সম্পাদক—বেশ কটি একুশের সংকলন সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই তিনি ‘গণসাহিত্য’ নামে একটি ছোট-কাগজ সম্পাদনা করতেন। সেটি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাহিত্যিক মুখপাত্র হিসেবে প্রকাশিত হতো। স্বাধীন বাংলাদেশে ওটিই ছিল প্রথম মানসম্পন্ন লিটল ম্যাগাজিন। প্রতিটি সংখ্যাতেই থাকত উৎকৃষ্ট মানের ব্যতিক্রমধর্মী লেখা। মুদ্রণ ও অঙ্গসজ্জা ছিল চোখে পড়বার মতো।

সংবাদে থাকাকালেই তিনি ‘প্রণোদনা’ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। সংবাদ থেকেই বেরিয়েছিল ‘দীপঙ্কর’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা। নেপথ্যে থেকেই ওই পত্রিকার সম্পাদনার কাজটি তিনি করেছেন। অবশ্য ওই পত্রিকা অল্প কিছুদিন পরে বন্ধ হয়ে যায়।

১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতি ‘পুশকিন : জীবন ও সাহিত্য’ নামে একটি স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করে যার সম্পাদক ছিলেন আবুল হাসনাত। গ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আবুল হাসনাতের সঙ্গে কাজ করবার সুযোগ হয়েছিল আমার। পুশকিনের একটি বিশাল জীবনী আমাকে অনুবাদ করতে দিয়েছিলেন ওই বইয়ের জন্যে।

একটা সময়ে সংবাদে তীব্র আর্থিক সংকট দেখা দেয়। আবুল হাসনাত বাধ্য হয়েই যুক্ত হয়ে পড়েন কর্পোরেট জগতের সঙ্গে। যেন ছিটকে পড়েন। তবে ওখানেও সেই সম্পাদনার কাজ। ‘কালি ও কলম’ নামের সাহিত্য সাময়িকীর সম্পাদকের পদে নিযুক্ত হন। প্রথম দিকে পত্রিকাটি তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে সুসম্পাদিত ও মানসম্পন্ন লেখা নিয়ে প্রকাশিত হয়। কিন্তু ক্রমেই পত্রিকাটি গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে গতানুগতিক একটি পত্রিকায় পরিণত হয়। অবশ্য ওই পত্রিকায় হাসনাত ড. আনিসুজ্জামানের মতো একজন ব্যক্তিত্বের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। অবশ্য ভালো মানের লেখার অপ্রাপ্তিও ওই পত্রিকার মান অবনতির কারণ হতে পারে।

বেঙ্গলের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বেঙ্গল পাবলিকেশন্সের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে অর্পিত ছিল। সেখান থেকে নানা ধরনের বই প্রকাশিত হতো। ওই প্রতিষ্ঠানেও আবুল হাসনাত তাঁর রুচি বৈদগ্ধ ও নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গির স্বাক্ষর রাখেন।

আমার কাছে আবুল হাসনাতের একটি ব্যাপার খুব দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে হয়। তাঁর সম্পাদক পরিচয়ের আড়ালে লেখক সত্তাটি ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। তিনি ছিলেন কবি ও শিল্প সমালোচক। মাহমুদ আল জামান ছদ্মনামের আড়ালে তাঁর লেখালেখির পরিমাণ নেহাত কম নয়। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : জ্যোৎস্না ও দুর্বিপাক, কোনো একদিন ভূবনডাঙ্গায়, যুদ্ধদিনের ধূসর দুপুরে, রানুর দুঃখ-ভালবাসা, রবীন্দ্র চিত্রকলা, মুক্তিযুদ্ধের গল্প, মুক্তিযুদ্ধের কবিতা, জীবনানন্দ দাশ : জন্মশতবার্ষিকী স্মারকগ্রন্থ, স্থির প্রত্যয়ে যাত্রা, প্রত্যয়ী স্মৃতি ও অন্যান্য, হারানো সিঁড়ির খোঁজে, ইস্টিমার সিটি দিয়ে যায়, পশতু গণমুখী কবিতা (অনুবাদ), ভূবনডাঙ্গার মেঘ ও নধর কালো বিড়াল।

সম্পাদক হিসেবে সবাই তাঁর প্রশংসায় মুখর হলেও লেখক আবুল হাসনাত হিসেবে আমরা তাঁকে সম্মান জানাতে ভুলে গেছি। লেখক হিসেবে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে কেউ এগিয়ে আসেননি।

মৃত্যুর অল্পকিছু দিন আগে তিনি লিখে গেছেন তাঁর দীর্ঘ আত্মজীবনী—‘হারানো সিঁড়ির খোঁজে’। সেখানে তিনি তুলে ধরেছেন ষাটের দশকে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন আর মুক্তিযুদ্ধের সময়কালিন কলকাতায় অবস্থানের অনুপুঙ্খ চিত্র।

১৯৪৫ সালের ১৭ জুলাই পুরনো ঢাকার বনগ্রামে জন্ম হয়েছিল তাঁর। মৃদুভাষী, নির্লোভ, নিরহংকার, নম্র ও বিনয়ী মানুষটি জীবনকে সদ্ব্যবহার করে গেছেন ঋষির মগ্নতা নিয়ে। যাপন করে গেছেন অনাড়ম্বর ও নির্বিরোধী জীবন। তাঁর মৃত্যুতে আমাদের শিল্প সাহিত্যের অঙ্গনে যে শূন্যতা সৃষ্টি হলো তা হয়তো সহজে পূরণ হবার নয়। তাঁর মতো লিটারেরি ও টেকনিক্যালি ইকুইপ্ট সম্পাদক আর আসবে কিনা আমার জানা নেই।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে যুবলীগ নেতার ওপর ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে যুবলীগ নেতার ওপর ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ
ইরাকি ঘাঁটিতে হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার যুক্তরাষ্ট্রের
ইরাকি ঘাঁটিতে হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার যুক্তরাষ্ট্রের
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগ সভাপতির সাহসী পদক্ষেপ
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ও আওয়ামী লীগ সভাপতির সাহসী পদক্ষেপ
‘তীব্র গরমে’ চু্য়াডাঙ্গা ও পাবনায় ২ জনের মৃত্যু
‘তীব্র গরমে’ চু্য়াডাঙ্গা ও পাবনায় ২ জনের মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল
শিল্পী সমিতির নির্বাচন: সভাপতি মিশা, সম্পাদক ডিপজল