X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

হেমন্ত আছে, হেমন্ত নাই!

সৈকত হাবিব
১১ নভেম্বর ২০২০, ১২:৪৬আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০২০, ১২:৪৯

হেমন্ত আছে, হেমন্ত নাই! বাংলার ছয় ঋতুর তালিকায় নামখানি তার বেশ জ্বলজ্বল করে—শরতের পরে আর শীতের আগে। সে এক ঋতু ছিল আমাদের, হেমন্ত নাম তার। আর সে ছিল বড় কোমল, স্বপ্নীল, ফলবতী। কিন্তু ‘ছিল’ বলছি কেন? কারণ সে কেবল প্রত্নস্মৃতি, বাস্তবে এখন দূর অতীত, ব্যবহারিকতায় মূল্যহীন। তাই সে যেন আজ সেই কাজির গরু, গোয়ালে যার অস্তিত্ব নেই, আছে কেবল কাগজেই। 

শরৎ তবু পূজা পায় বটে, দুর্গাদেবীর কল্যাণে; দ্রুতগামী পেজা মেঘ ও জলে তার চলৎছায়া আর কাশের শুভ্রতায়, কিন্তু হেমন্ত আজ পায় না কিছুই। অথচ কী ছিল তার দান, অঘ্রানের ঘ্রাণ কী বিপুল ছিল আমাদের জীবনে!

হেমন্ত এক আশ্চর্য ঋতু—মৃত্যু ও জীবনের, দুর্ভাগ্য ও সৌভাগ্যের, হতাশা ও আশার—দুই বিপরীতের এক সুতীব্র যুগলবন্দি। একদিকে এ ঋতুর শুরুতে মরা কার্তিক, ক্ষুধার হাহাকার; আবার শেষে অগ্রহায়নে ধানের প্রাচুর্য, নতুন ধান, তাই নবান্ন। এভাবে নানা বৈপরীত্যের মিশেল এই ঋতু হেমন্ত।

একদা কত কিছুই না সে দিয়ে গেছে আমাদের—যে ভাত খেয়ে আমরা বাঁচি, যে ধানের দানে বাঙালির প্রাণরস প্রবহমান, তার প্রধান অংশটিই একসময় আসত এই হেমন্তে। তার জীবনদায়ী ঘ্রাণে বাংলার গ্রামজীবনের ঘরে ঘরে জীবনের উৎসব লেগে যেত অগ্রহায়ণ মাসে। এসব কথা ভেবেই সম্রাট আকবর বৈশাখের বদলে প্রথমে অগ্রহায়ণ মাসকেই ঋতুর প্রথম মাস করতে চেয়েছিলেন। এর অর্থটাও তাই তাৎপর্যপূর্ণ: অগ্রে বা আগে যে আসে, তা-ই অগ্রহায়ণ। তবে অর্থ যা-ই হোক, এখন এটি বছরের অষ্টম মাস। আর আসেও অনাড়ম্বরভাবে, চলেও যায় বেশ গোপনে। কারণ যে আমন ধান ছিল বাঙালির প্রধান খাদ্য, সময়ের প্রয়োজনে তার জায়গা দখল করেছে উচ্চফলনশীল ইরি ধান। বিপুল জনসংখ্যার ভার, বিপুল খাদ্যচাহিদা, পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা, নদী ও জলাভূমি হত্যা, নির্বিচার বৃক্ষনিধন, কৃষিজমির বিনাশ, নগরায়ন, যন্ত্রায়ন ইত্যাদি নানা কারণে প্রকৃতির হিসাব-নিকাশ সব উল্টেপাল্টে গেছে। তাই আজকের শহুরে মানুষ নয় কেবল, গ্রামের মানুষও ঋতুর আসা-যাওয়ার হিসাব ভুলে গেছে প্রায়। ঋতুচক্রের আবর্তনে প্রচণ্ড খরতাপ, তীব্র বন্যা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস কিংবা খুব ব্যতিক্রমী কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনা ছাড়া ঋতুচর্চা এখন কেবল আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত। তাই দেখা যায়, বর্ষবরণের পাশাপাশি গত এক যুগ ধরে নবান্ন উৎসবও আমাদের রাজধানীতে নাগরিক অনুষ্ঠানে পর্যবসিত হয়েছে।      

২.

আমাদের ষড়ঋতুর দিকে তাকালে বহু বিচিত্র বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। অনেক ঋতুকে শারীরিক-মানসিক উভয় দিক দিয়েই প্রবল অনুভব করা যায়। ধরা যাক, ঋতুর শুরু গ্রীষ্মেই। বৈশাখের আগেই তীব্র তাণ্ডব নিয়ে সে হাজির। যেন সবকিছু ভেঙেচুরে তছনছ করে দেবে, উড়িয়ে নেবে সবকিছু; সে যে নবীন, সে যে তীব্র, সে যে কাঙ্ক্ষিত, তারই আভাস যেন আকাশে-বাতাসে, ফুলে-ফলে বৃক্ষ-লতায়। তারই অপর দিক  জ্যৈষ্ঠ। তীব্র গরম, সূর্যের ঝলসানো আগুন। মান্না দের গানে পাই এর জীয়ন্ত বর্ণনা: ‘প্রখর দারুণ অতি দীর্ঘ দগ্ধ দিন/যত দূরে চাই নাই শুধু নাই/দিকে দিকে শুধু নাই নাই নাই/শুষ্ক কানন তরু শাঁখে/বিরস কণ্ঠে পাখি ডাকে/বুক ফাটা পিয়াসায় অগ্নি আকাশ পানে চাহে সদাই...।’ এক টুকরো মেঘ কিংবা কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির জন্য কী তীব্র ব্যকুলতা। কিন্তু এই শুষ্কতার বিপরীতে আছে আরেক মজার দিক। গ্রীষ্মেই ফলে বাংলার সবচে সুস্বাদু আমসহ বহু রসাল ফল, যার রস প্রাণকে ভরে দেয় স্নিগ্ধতায়, আত্মা ভরে ওঠে প্রশান্তিতে। আর বর্ষার তো কোনো কথাই নেই। কারণ এটি বাঙালির প্রাণের ঋতু। আমাদের গানে-গল্পে-গাথায় তার রূপ-সৌন্দর্যের এত বর্ণনা, হয়তো আমাদের ঋতুরচনার সমগ্র-সংকলন হলে তার সিংহভাগ জুড়েই থাকবে বর্ষাবন্দনা। কালিদাসের মেঘদূত তো বিশ্বসম্পদ। আর রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান আমাদের অস্তিত্বেরই অংশ।

শরৎ যেন বর্ষারই সহোদরা। সতেজ প্রকৃতি, রোদ-বৃষ্টির খেলা, মেঘ ও জলের লুকোচুরি, অপরূপ জ্যোৎস্না, শারদীয় দুর্গাপূজা, উষ্ণতা-শীতলতার যুগলবন্দি মিলিয়ে বেশ উপভোগ্য হয়ে উঠে। এর পরেই আসে আমাদের প্রায়-পতিত ঋতু হেমন্ত। কিন্তু এ ঋতুর শুরুটা হয় অনেকটা বেদনাদায়কভাবে। দুর্গাপুত্র কার্তিক যদিও খুব সুদর্শন সুপুরুষ হিসেবে বরিত, কিন্তু তার নামের মাসটি ঋতুচক্রের দিক থেকে মহিমান্বিত তো নয়ই, বরং অভাব-দারিদ্র্য-ক্ষুধার তীব্রতার কারণে সে মরা-কার্তিক নামে কলঙ্কিত। কারণ আশ্বিনের স্বল্প-উৎপাদনশীল আউশ ধান এমনিতেই চাহিদার তুলতায় কম, তার ওপর যদি বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসে, তাহলে তো কথাই নেই। সাধারণ কৃষিজীবী মানুষের ঘরে ঘরে হাহাকার পড়ে যায়। তার সবচে বেশি প্রভাব পড়ে কার্তিকে। এর চেহারা সেদিনও আমরা দেখেছি দেশের উত্তরাঞ্চলে মঙ্গারূপে। কারণ তখনও মাঠে ধান কেবল পাক ধরেছে, কিন্তু ঘরে নেই ভাত। এ অবস্থার অবসান ঘটে পরের মাস অগ্রহায়ণে। তখন নতুন ধান ঘরে আসতে থাকে, ধানের গন্ধে প্রতি বাড়ির উঠোনে উঠোনে শুরু হয়ে যায় জীবনের উৎসব। তাই তখন নতুন ধানের নবান্নই শুধু নয়, কত যে বিচিত্রভাবে তার উদযাপন শুরু হয়—পিঠে, পুলি, মুড়ি, মোয়া, খই—সে বড় সুখের সময়! যা পরের ঋতু শীতকেও বেশ উপভোগ্য করে তোলে। ধানের পরে শীতেই আসে খেজুর রস। ধান আর রসের মিশ্রণে বিচিত্র খাদ্য-আয়োজনে শুষ্ক শীতও বেশ রসময় হয়ে ওঠে। আত্মীয়-আপ্যায়ন আর জামাই-আদর তাই এ সময়ে বেশ জমে ওঠে। বসন্তের কথা বেশি বাড়িয়ে লাভ নেই। বর্ষার পর বসন্তই বাঙালির সবচে প্রিয় ঋতু। তীব্র শীতের পর বসন্তের ফাল্গুনী হাওয়া যখন বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে, তখন আমাদের প্রাণ ভেতর থেকেই জেগে ওঠে। সেজন্যই কবি সুভাষ মুখুজ্যে সগর্বে বলতে পারেন ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত।’ কারণ বসন্ত যখন আসে তখন আমাদের হৃদয়ই কথা বলে, বাইরের দিকে না তাকালেও চলে। আমাদের শরীরও ভেতর থেকে এর হিল্লোল টের পায়; দেহের ভেতর থেকে সে আমাদের উষ্ণ-উজ্জীবিত করে তোলে।   

৩.

আমাদের সাহিত্যে ঋতুস্তব অন্তহীন। বর্ষা-বসন্ত যদিও সবচে সৌভাগ্যবতী, কিন্তু অন্যগুলোও নেহায়েত কম নয়, কেবল হেমন্ত বাদে। আশ্চর্য হয়ে দেখি, বাংলা সাহিত্যে হেমন্তের চেহারা সবচে তীব্র ও নিবিড়ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন একমাত্র জীবনানন্দ দাশ। এর বাইরে বড় আকারে নাম আসে কেবল রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের। তবে রবীন্দ্রনাথ তো সর্বঋতুর কবি। সেক্ষেত্রে অন্য ঋতুগুলোর তুলনায় হেমন্তের প্রতি কতটা সুবিচার করেছেন, সেটি আলোচনাসাপেক্ষ। কিন্তু জীবনানন্দ একাই যেন সব পুষিয়ে দিয়েছেন। তাঁর কবিতার দার্শনিকতা-নৈসর্গিকতা-মনোময়তা সবকিছুর ভেতরেই যেন উপেক্ষিত হেমন্ত ও শীতের রাজত্ব। সেজন্য অনেকেই তাঁকে যে ‘হেমন্তের কবি’ বলেন সেটি যথার্থই মনে হয়। অন্যদিকে যে জাতির সাহিত্য বর্ষাময়, সেখানে খুঁজে-পেতে তাঁর একটি বর্ষাপদ্য পাওয়া যায়, তা-ও হাত-মকশো কবিতা। অন্যদিকে হেমন্তকে তিনি যেন তুলে আনেন এর আত্মা ও ঘ্রাণসমেত। এমনকি তাঁর কথাসাহিত্যেও হেমন্ত এসেছে একই তীব্রতা নিয়ে। এমনটা বোধহয় বলা যায়, আমাদের সাহিত্যের কয়েক প্রজন্ম যতটা না নিসর্গে তারচে বহুগুণ বেশি হেমন্ত-আস্বাদন করেছেন তাঁর কবিতার ভিতর দিয়ে। বাংলা সাহিত্যে তাঁর এই দান অন্তহীন ও অতুলনীয়। কী চমৎকারভাবেই না তিনি কার্তিক-অঘ্রানের দৃশ্যরূপ তুলে ধরেন: 

ক. ‘শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে

অলস ধোঁয়ার মতো এইখানে কার্তিকের দেশে।

হেমন্তে ধান ওঠে ফলে

দুই পা ছড়ায়ে বস এইখানে পৃথিবীর কোলে।’

 

খ. ‘প্রথম ফসল গেছে ঘরে-

হেমন্তের মাঠে-মাঠে ঝরে

শুধু শিশিরের জল,

অঘ্রাণের নদীটির শ্বাসে

হিম হয়ে আসে...।

৪.

যদিও বেড়ে ওঠা গ্রামে, শৈশব-কৈশোরে দেখেছি শস্যভরা মাঠ, অঘ্রাণে বাড়ির উঠোনে উঠোনে ধান মাড়াইয়ের উৎসব, দেখেছি নদী-মাঠ-নিসর্গ, উড়িয়েছি মাঠে ঘুড়ি, তবু অনেক সময়ই মনে হয় আসল হেমন্তকে ঠিক কখন দেখেছি?

সম্ভবত বছর বিশেক আগে, একদিন মিষ্টি রোদ্দুরভরা বিকেলে, ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়কে, বাসে আসতে আসতে, মেঘনা ঘাটের কাছে হেমন্তের সত্যিকারের চেহারা আমার চোখে ধরা পড়ে। এর কোমল সৌন্দর্য, মিষ্টি রোদ্দুর, শীতোষ্ণ আবহাওয়া, ন্যাড়া-ফসলশূন্য নিস্তব্ধ মাঠ আর চরাচরে এক প্রগাঢ় প্রশান্তি—সবটা কি আর ভাষায় বলা যায়!

আর হেমন্ত এখন এমনই এক লজ্জাবতী ঋতু, কালেভদ্রেই সে নিজেকে হঠাৎ মেলে দেয়। তাই গোধূলি-বিকেলে উষ্ণতা- শীতলতার মাঝখানে, যেনবা বিশাল ধুধু নদীর মাঝখানের ফিতের মতো ছোট্ট-ক্ষীণধারা; রাতে ঘরে ফেরার সময় একটু শীতল ঝাপটা কিংবা ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে ঈষৎ শীতভাব—এই তো এখনকার হেমন্ত! তা-ও মনে করে নিতে হয়। সেজন্যই হেমন্ত আছেও এবং নাইও! 

বরং সে আছে আমার বুকে, প্রকৃতির সত্য ও সৌন্দর্যের এক উদ্ভাসরূপে। থাক অনির্বচনীয় এই হেমন্তরূপ আমারই অন্তরসম্পদ হিসেবে। সঙ্গে তো আছেনই জীবনানন্দ—আমাদের প্রগাঢ় হেমন্তকবিটি! 

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সার্বিক অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
সার্বিক অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
ইউক্রেনে রুশ বিমান হামলায় দুই শিশুসহ নিহত ৮
ইউক্রেনে রুশ বিমান হামলায় দুই শিশুসহ নিহত ৮
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
পারটেক্সের বিপক্ষে হেরে রূপগঞ্জ টাইগার্সের অবনমন
পারটেক্সের বিপক্ষে হেরে রূপগঞ্জ টাইগার্সের অবনমন
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!