X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতি, অলোকরঞ্জন। আছেন, থাকবেন

দাউদ হায়দার
২২ নভেম্বর ২০২০, ১২:৪৩আপডেট : ২২ নভেম্বর ২০২০, ১২:৪৫

স্মৃতি, অলোকরঞ্জন। আছেন, থাকবেন গত মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ফোনে বললেন, ‘দূরাভাষে অধরা আপনি, করোনার করুণা থেকে সাবধান, খুব ভালো থাকবেন।’ আরও নানা কথা। ‘বার্লিনে কতজন বাঙালি করোনামায়ায় আচ্ছন্ন, গোটা জার্মানিতে বঙ্গসন্তান কত, জানাবেন। মারা গেলে বলবেন না।’ এই নিষেধাজ্ঞার হেতু আছে। কলকাতা বা বাংলাদেশের কোনো লেখক শিল্পী অধ্যাপক নাট্যজন সাংস্কৃতিক কর্মীর মৃত্যু খবর জেনে ফোন করতুম। একবার বললেন, ‘আপনার কণ্ঠস্বর শুনলেই ভয় সঞ্চারিত, এই বুঝি দুঃসংবাদ।’

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্র ছিলুম যখন, কবি তুষার চৌধুরী (ঔপন্যাসিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের জামাই) এক বিকেলে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর যাদবপুরের আস্তানায় নিয়ে যান, পরিচয় করিয়ে দেন। দিন-তারিখ মনে নেই। জার্মানি থেকে গিয়েছেন কয়েকদিনের জন্যে। তুলনামূলকের ছাত্র শুনে, ‘রবের আঁতোয়ানের সঙ্গে দেখা হয়নি বিগত বছর চারপাঁচেক। তিনি কী পড়ান আপনাদের?’

কথায়-কথায় জানলুম, তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগে পড়িয়েছেন তিনি। আরও জানলুম, নবনীতা দেবসেন, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ছাত্র ছিলেন ওঁর।

প্রথম দিনের সাক্ষাতেই মাসিমা (অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর মা) মুড়ি, নাড়ু খেতে দিয়েছিলেন। তুষারকে একটি বা দুটি দিয়ে বাকিগুলো নিঃশেষ করি। স্বভাব নির্লজ্জের, আবদার করি মাসিমার কাছে, নাড়ুর লোভে আবার আসব। অলোকরঞ্জন কিছু বলার আগেই মাসিমার প্রস্তাব, ‘অলোক না থাকলেও যখন খুশি আসবে।’ প্রশ্রয় পেয়ে ভিটেমাটি দেশ ছাড়া এতিমের কী তর সয়? অলোকরঞ্জন নেই তো কী হয়েছে? মাসিমা আছেন।

এক সন্ধ্যায় গিয়েছি, মাসিমা বললেন, ‘গত পরশু অলোক এসেছে, শুনেছ?’ ‘না’। মাসিমা আরও কী সব বলছিলেন, একটি বাক্য : ‘অলোক কিন্তু ভালো রবীন্দ্রসংগীত গায়।’

তারপর কী কী কথা, স্মরণ নেই। না থাকলেও, কণ্ঠ বোধ হয় চড়িয়েছিলুম। তখনই অলোকরঞ্জনের প্রবেশ। না, কোনো কবিতা আবৃত্তি করিনি। না করলেও লিখলেন একটি কবিতা।

দাউদ হায়দার

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত

মূর্তি নিরঞ্জনের পরে ঘরে ঢুকতেই কার

আবহ-আবৃত্তি শুনছি? দাউদ হায়দার!

কে জানে তাঁর মনের খবর, কোন্ ঘরানায় নেচে

এখন এলেন, এসব আমার জানতে বয়ে গেছে!

বিজয়া দশমীর পটে সেদিন সন্ধে জুড়ে

দাউদ আমার যাদবপুরের গহনান্তঃপুরে

প্রথম এবং শেষ অতিথি—প্রতিদিনের বেশি—

কোন্ ধরনের খেলায় কাদের কেমন রেশারেশি

এসব আলাপ-আলোচনাও লাগল দারুণ দামী;

যাবার মুখে দাউদ : ‘এলাম’; ‘খোদা হাফেজ’ আমি।

রাত্রি বোধহয় সাড়ে-দশটা, শাপ্লা-দিঘির ধারে

আমার দায়াদ আরো বিশাল উত্তরাধিকারে

আমায় যখন রেখে গেলেন বাজল দোতারাতে :

পরিচ্ছন্ন রৌদ্র যেন ক্রিকেট খেলার মাঠে!

(লঘুসংগীত ভোরের হাওয়ার মুখে।

প্রমা। ৫ ওয়েস্ট রেঞ্জ। কলকাতা-১৭।

প্রথম প্রকাশক : ২২ ডিসেম্বর ১৯৭৮/৭ই পৌষ ১৩৮৫)

কবি অমিয় চক্রবর্তী বিশ্বময় ভ্রামণিক, অলোকরঞ্জন অর্ধেকের আরও কম। কিন্তু বৈশ্বিক। বিশ্বজনীনতা তাঁর কবিতা বহুমাত্রায়। এই মাত্রা থেকেই খাঁটি অসাম্প্রদায়িক। সব মানুষই আপন, ঘরোয়া। বাঙালি মাত্রই স্বজন। সজ্জন। দুই বাংলার মানুষ নিজস্ব।

অলোকের কবিতায় ঘর, পরিবার, বন্ধু, আত্মিকতা, সাহচর্যের আধিক্য। স্বীকার করতেন নিজেও।

অলোকরঞ্জনকে পাঠ-পঠন সীমাহীন। ওঁর হির্শবার্গের বাড়িতে দু’বার গিয়েছি।

‘বাড়ি না লাইব্রেরি? বসব কোথায়? থাকব কোথায়?’

উত্তর : ‘মেঝেয়।’

নানা ভাষার বই। ভাষাভিত্তিক বই সাজানো। আলমারির পর আলমারি। ইংরেজি, জার্মান তো প্রায় মাতৃভাষা। স্প্যানিশ, ইটালিয়ান, ফ্রেঞ্চও আয়ত্ত করেছিলেন। তুর্কি সাহিত্যে বিশেষ উৎসাহী (জার্মান অনুবাদ)। তুর্কির নোবেলজয়ী সাহিত্যিক ওরহান পামুকের চেয়ে ইয়াসার কেমাল ছিল প্রিয়। বলতেনও। পারস্যের ফিরদোসী, হাফিজ, ওমর খৈয়াম নয়,, ‘রুমিই সুপাঠ্য।’

জার্মান বেতার কেন্দ্রের ডয়েচে ভেলের বাংলা বিভাগে প্রাক্তন প্রধান আবদুল্লাহ আল ফারুক জড়িত কণ্ঠে বললেন (ফোনে), ‘অলোকদা ছিলেন মাথার ওপরে। কোনো শব্দ, বাক্য নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত হলেই অলোকদাকে ফোন। তক্ষুণি সুরাহা। সাহিত্য অনুষ্ঠানে, কারোর বিষয়ে জানতে চাইলেই সবিস্তারে বলতেন। ইন্টারভিউ দিতেন ব্যস্ততা সত্ত্বেও।’

বাংলাদেশের বহুমান্য কবি শহীদ কাদরী বলতেন, ‘কলকাতার ৫০ দশকের কবিকুলের প্রধান অলোকরঞ্জন। ওঁর মতো স্মার্ট কবি, স্মার্ট গদ্যলেখক আর কেউ নন।’ একই কথা তুলনামূলকের ছাত্র প্রশান্ত সামন্তের। বাংলাদেশে অলোকরঞ্জনের পাঠক বিস্তর, জাহিদ হায়দারের বয়ানে ‘ইনটেলেকচুয়াল কবিকুল। গদ্যপাঠক।’

অলোকরঞ্জনের বহুবিধ স্বভাবের একটি, কোনো তরুণ কবির কাব্যগ্রন্থ পড়ে ভালো লাগলে উচ্ছ্বসিত। প্রগলভ। চিঠিও লিখতেন কবিকে।

স্বভাবের আরও একটি, চিঠি লিখলে, ছোট হোক, বড় হোক, সঙ্গে সঙ্গে উত্তর। অলোকের বহু চিঠি পেয়েছি, প্রকাশিত করব কখনো।

‘আমাকে আপনি কেন বলেন?’ প্রশ্নে উত্তর, ‘আপনি এখনও তুমি নন।’ বলি, ‘যৌবনের আত্মিক বন্ধু শঙ্খ ঘোষকেও আপনি বলেন।’

—‘তিনি সর্বদা মান্য।’ বলেন।

অলোকরঞ্জন আছেন, থাকবেন।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
রাঙামাটিতে হলো সংসদীয় কমিটির বৈঠক
রাঙামাটিতে হলো সংসদীয় কমিটির বৈঠক
ডুবে যাওয়া জাহাজের ১১ নাবিক উদ্ধার, সবার আগে লাফ দেওয়া মাস্টার নিখোঁজ
ডুবে যাওয়া জাহাজের ১১ নাবিক উদ্ধার, সবার আগে লাফ দেওয়া মাস্টার নিখোঁজ
জাকার্তায় সোনা জিতে বাংলাদেশ পুলিশের ভানরুমের চমক
জাকার্তায় সোনা জিতে বাংলাদেশ পুলিশের ভানরুমের চমক
রাব্বির ব্যাটে শাইনপুকুরকে হারালো শেখ জামাল
রাব্বির ব্যাটে শাইনপুকুরকে হারালো শেখ জামাল
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা