X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

জন্মদিনে শক্তি-স্মরণ : 'শীতে আমি ছুটি বনের ভিতরে একা'

অরুণাভ রাহারায়
২৫ নভেম্বর ২০২০, ১৭:২৫আপডেট : ২৫ নভেম্বর ২০২০, ১৭:৩২

জন্মদিনে শক্তি-স্মরণ : 'শীতে আমি ছুটি বনের ভিতরে একা' প্রায় এক দশক আগে সমীর সেনগুপ্তর লেখা 'কবি শক্তি' বইটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তখন সবে কবিতা লিখতে শুরু করেছি। কলেজ স্ট্রিটে প্রতি বৃহস্পতিবার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা হত বসন্ত কেবিনে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা পড়তে শুরু করি তখনই। ৫১ এম জি রোডে নিক্কো বোর্ডিং-এ আমার ঘরে এসে তরুণ কবি অরিত্র সান্যাল পাঠ করে শুনিয়েছিল জরাসন্ধ : 'আমাকে তুই আনলি কেন ফিরিয়ে নে'। তাঁর পদ্য সমগ্রের নানা খণ্ডে 'সম্পাদনা বিষয়ে' শিরোনামে সমীর সেনগুপ্তর গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলি। যা কবির মনোভূমিকে স্পর্শ করতে সাহায্য করেছে। সেইসব লেখা থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিত্ব শক্তি এবং লিখিত শব্দ সম্পর্কে আমাদের গভীর ধারণা জন্মাতে পারে।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতা 'অনন্ত নক্ষত্রবীথি তুমি অন্ধকারে' নামের সুদীর্ঘ কবিতাটি পড়ে অনেকের মতোই বিস্মিত হই। প্রথম লাইনগুলো এ রকম:

সারাবেলা বৃষ্টিতে বিষণ্ণ হয়ে এলো

কাঁটাঝোপ থেকে ডাক এলো কানে বিদায়-মধুর

নতুন বাসার চেষ্টা এ-বছর এত আগে—বারান্দার জল—

শোয়ার ঘরের ছাদ চিড় খেয়ে গেছে সেই জলপিপিদের

যাকে আমি ভালোবাসি—যাকে আমি বিদায় নেবার আগে—

                                       দেখে যাব।

(অংশ)

'পদ্য সমগ্র' প্রথম খণ্ডের শেষে অমিতাভ দাশগুপ্তর লেখা পড়ে জানা যায় ৬৩২ লাইনের সুদীর্ঘ কবিতাটি নাকি মাত্র একদিনে লেখা হয়। অমিতাভ এবং শক্তি—দুই কবিবন্ধুরই জন্মদিন আজ। কবিতাটি শেষ হওয়ার পরবর্তী ঘটনা অমিতাভ লিখেছেন এভাবে, "রাত ন'টা নাগাদ হঠাৎ চিৎকার করে আমার নাম ধরে ডাকল শক্তি। দেখি ঘরময় লেখার পাতা উড়ছে, টেবিলে পাতার পর পাতা, শক্তি প্রায় মৃতের মতো চেয়ারে এলিয়ে আছে। ওর পাশে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পর ধড়মড়িয়ে উঠে ওই পাতাগুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে জড়ো করল শক্তি। তারপর একেবারে মনোসিলেবিক-এ বলল—শোন। এবং কম্বুকণ্ঠে একটানে পড়ে যেতে লাগল দীর্ঘ, সুদীর্ঘ একটিই কবিতা। এতবড় কবিতা সারা কবিজীবনে (আর) লেখেনি শক্তি। পাণ্ডুলিপি নেড়েচেড়ে দেখি, গোটা লেখায় মার্জনা, কাটাকুটি বলতে প্রায় কিছুই নেই। আমি এই ঘটনার ঝাপটে এমনই বেসামাল যে, সম্পূর্ণ বোবা মেরে যাই।" পুরো লেখাটি জুড়ে শক্তির কবি প্রতিভার আরও অনেক অবাক করা তথ্য ছড়িয়ে আছে।

একবার টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখার জন্য দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ মনে পড়ল তাঁর কবিতা—

টেবিল পাহাড়ের মাথায় রঙের কলসিখানি ভেঙে গেছে

রোজই ভাঙে

রোজ বৃষ্টি হয়—অনবরত, টুপটাপ টুপটাপ

শব্দ ছড়িয়ে পড়ে শব্দের সমুদ্রে

যেখানে শব্দের চেয়ে রং বড়

রঙের চেয়ে বড় মাধুর্য

সেখানে মূল শব্দ উঠে আসে

উপকূলের বালুতে রাখে বুকের দাগ

মুখ লালায় দেয় ভরিয়ে

কাঁধে মাথা রেখে বলে:

ক্ষমা করো আর বাজতে পারি না।

(ক্ষমা করো/ সোনার মাছি খুন করেছি)

সূর্য উঠতেই 'টেবিল পাহাড়ের মাথায় রঙের কলসিখানি ভেঙে গেছে।' যেন কোনও শিল্পীর রঙের কলসি ভেঙে রঙ ছড়িয়ে পড়েছে। নানা রং লেগেছে পাহাড়ের শিখরে শিখরে। তারপরই কবি লিখছেন 'রোজই ভাঙে'। কেননা সূর্য ওঠে প্রতিদিনই। এই কবিতা পরক্ষণেই আমাদের নিয়ে যায় সমুদ্র-সৈকতের কাছে। তাই 'উপকূলের বালুতে রাখে বুকের দাগ'। সৈকতের পাশেই রয়েছে সমুদ্র আর মনে পড়ে তাঁরই অপর কবিতা: আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে সমুদ্র তোর আমিষ গন্ধ'। যেন গোটা সমুদ্র একটা কড়াই হয়ে বসে আছে ওভেনের উপর। জল ফুটছে টগবগ করে। মাছগুলো প্রচণ্ড লাফাচ্ছে আর আঁশটে গন্ধ উঠছে... আর আমি সৈকতে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখছি।

২০১৪ সালে এবং ২০১৮ সালে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী মীনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়কে আমি নন্দন চত্বরে দুটি অনুষ্ঠানে দেখেছি। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তাঁর গলায় কখনও বেজে ওঠে আক্ষেপের সুর: "শক্তির সৃজনশীল কাজগুলো আজ লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গিয়েছে। কেবলই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে ওর মদ্যপান পরবর্তী নানা ঘটনা।" তাঁর লেখা 'আন্তরিক পর্যটনে' বইটি পড়লে শক্তির সৃজনশীল কাজের নানা পরিচয় পাওয়ার যায়। বইটি প্রকাশ করেছে 'কারিগর' প্রকাশনা।

শক্তি চট্টোপাধ্যায় যেন সব সময় সংবেদনশীল কাজের মধ্যে ডুবে থাকতে পছন্দ করতেন। সাত খণ্ড 'পদ্য সমগ্র' (আনন্দ) ছাড়াও, 'অনুবাদিত পদ্য' (সিগনেট), গদ্যসংগ্রহ (দে'জ), সমীর সেনগুপ্তর সম্পাদনায় প্রকাশ পেয়েছিল 'অগ্রন্থিত শক্তি চট্টোপাধ্যায়' (প্রতিক্ষণ), শক্তি চট্টোপাধ্যায় নির্বাচিত লেখার সংকলন (বসুমতী)। উল্লেখিত শেষ বই দুটির পেছনের গ্রন্থপঞ্জির দিকে চোখ রাখলে আরও তথ্য জানা যাবে। তবু 'অগণ্য' কাজ বাকি রয়ে যাওয়ার ঘোষণা করেছিলেন তিনি—

অগণ্য কাজ রয়ে গেলো বাকি—বাধা কি প্রচুর?

রাজবাড়ি থেকে ভেসে আসে ক্ষীণ সানায়ের সুর

    কী যেন কথায় রয়ে গেল ঢাকা

    মাথার উপর চাঁদ মেঘে-মাখা

আজ সন্ধ্যায় আতঙ্কহীন অট্টরোলে

তুমি যদি পারো ফিরে এসো কাছে সময় হলে

(সময়/ ধর্মে আছো জিরাফেও আছো)

শক্তি চট্টোপাধ্যায় এলিজি-ও লিখেছেন অনেক। তাঁর সাত খণ্ডের পদ্য সমগ্রে নানা এলিজি পড়ার সুযোগ পাই আমরা। সেইসব এলিজির নির্বাচিত ৫৭ খানা খুঁজে দুই মলাটে গেঁথেছেন সমীর সেনগুপ্ত। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। এখন পাওয়া যায় 'কারিগর' প্রকাশিত সংস্করণ। বইটির 'সম্পাদনা বিষয়ে' সমীর সেনগুপ্ত লেখেন: আধুনিক কালে এসে এলিজি তার গুরুত্ব হারিয়েছে। সংকলক সেখানে বলতে চেয়েছেন, বাংলার কবিদের মধ্যে এলিজি লেখার প্রবণতা কম! কিন্তু শক্তি আজীবন এলিজি কবিতার ধারাটি বহন করেছেন। এ বইয়ের পেছনে কবিতা পরিচিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যা পড়ে জানা যায়, ওই এলিজিগুলি কাদের উদ্দেশ্যে লিখেছিলেন কবি।

আজ শীতের বেলায়, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিনে তাঁর একটি কবিতা (আমার ভালো লাগা) দিয়ে এই সংক্ষিপ্ত লেখা দিয়ে শেষ করছি—

শীতে আমি ছুটি বনের ভিতরে একা

গাছ পড়ে থাকে, গাছই শুধু থাকে পড়ে

মেপল, তুমি কি খাবো বলে দাও দেখা?

ফলেছো কি তুমি আমারই মতন করে?

 

ঘড়ি বাজে চার, তুলেছি কুড়ুল কাঁধে

এবং সূর্য ডুবন্ত হা-হা আলোয়

নিজের ছায়ায় পা মেলাতে লাগে ভালো

সামনে তুষার, পিছনে তুষার ঝরে

 

প্রকৃতির হার প্রকৃত কিছুতে নেই

ভেঙে যদি যায় একটি বা দুটি গাছও--

আমার পালানো—পরাজয় বলে আঁকো?

কখখনো নয়, যতই আঘাত করো

(শীতে একদিন/ সুন্দর এখানে একা নয়)

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!