X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

বুদ্ধদেব বসু : 'এ কী অপরূপ রূপান্তরের মায়া'

অরুণাভ রাহারায়
৩০ নভেম্বর ২০২০, ১৮:৫৬আপডেট : ৩০ নভেম্বর ২০২০, ১৮:৫৭

বুদ্ধদেব বসু : 'এ কী অপরূপ রূপান্তরের মায়া' ছেলেবেলা তো মন গঠনের সময়। বুদ্ধদেব বসুর 'ছেলেবেলা' বইটি পড়লে তাঁর ছোটবেলা সম্পর্কে আমাদের ধারণা জন্মায়। কীভাবে এক শিশু ধীরে ধীরে বড় (মেধাবী) হয়ে উঠছেন তা পুঙ্খানুপুঙ্খ জানা যায় বইটি নিবিড়ভাবে পড়লে। কী অপূর্ব আর রংময় ছেলেবেলা! যার পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে মনন-চর্চার সৌন্দর্য।

অধুনা বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলায় জন্ম এবং মূলত দাদামশায়ের (চিন্তাহরণ সিংহ) স্নেহাশিসে বেড়ে উঠেছিলেন বুদ্ধদেব বসু—"বিশেষত আমার দাদামশায়ের সঙ্গে আমি এমন এক ধরনের স্নেহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলাম, যার বুননটা খুব ঘন, প্রায় কোথাও ফাঁক নেই—পিতাপুত্রের সম্পর্কের চেয়ে অনেকটাই বড় তার আয়তন।... শীতের ভোরে বেড়াতে বেরিয়েছি তাঁর সঙ্গে—আমার পরনে কান-ঢাকা টুপি আর আলস্টার—তিনি চলতে চলতে জিজ্ঞেস করছেন : 'Do you see what I see?' আর আমি তাঁর চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে বলে উঠছি 'A tree!', 'A dog!', 'A bullock-carti!'—এমনই সারাটা সময়।" বুদ্ধদেব এখানে কবুল করেছেন, ইংরেজি শিক্ষার জন্য তাঁর দাদামশাই বড় বেশি যত্নবান ছিলেন।

এই শিক্ষাই কি পরিণত বয়সে কাজে এসেছে কবিতার অনুবাদ করতে গিয়ে? বুদ্ধদেব বসু যেভাবে বাংলা কবিতার অনুবাদের ধারাটি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মসৃণ করে গিয়েছেন—তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের অনেকের পক্ষেই একাধিক ভাষা জানা সম্ভব নয়। ভাষাজ্ঞান সীমিত হওয়ার কারণে অনুবাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। দে'জ থেকে প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসুর পাঁচ খণ্ড কবিতা সংগ্রহের শেষ দুটি খণ্ডে রয়েছে অনুবাদ। কালিদাসের মেঘদূত, বরিস পাস্টেরনাক, এজরা পাউন্ড, ই ই কামিংস, হ্যেন্ডার্লিন, রাইনের মারিয়া রিলকের কবিতা অনুবাদ করেছেন বাংলায়। তাঁর সমস্ত অনুবাদ-কর্মকে ছাপিয়ে বোধ হয় 'বোদলেয়ার'-এর অনুবাদ (ইংরেজি থেকে বাংলা) কিংবদন্তি হয়ে ওঠে। সেই অনুবাদ থেকে ভালো-লাগা একটি কবিতা তুলে দিচ্ছি:

সেদিন সকালে শয়তান এলো চলে

উঁচু ঘরে আমি যেখানে লুকিয়ে থাকি,

ছিদ্রান্বেষী মনের কৌতূহলে

আমাকে ঠকাতে, শুধলো সে: 'বলো দেখি,

 

তার সম্পদ যত সুন্দর, ভালো

যত মায়া তার মুখশ্রী রয় ছেয়ে,

যত সামগ্রী, অরুণ অথবা কালো,

সাজায় সে-তনু, তা থেকে, সবার চেয়ে

 

কোনটিতে মানো মধুর?'—আমার প্রাণ,

ঘৃণ্য পিশাচে দিলে তুমি উত্তর:

'সর্বাঙ্গীণ কল্যাণে তার পণ,

নির্বাচনের প্রশ্ন অবান্তর।

 

উন্মাদনার সাধারণে ডুবে গিয়ে

করি না লক্ষ বিশেষের মন্ত্রণা,

উষসীর মতো দৃষ্টি ধাঁধিয়ে দিয়ে

রাত্রীরূপিণী সে বিলায় সান্ত্বনা

 

মোহন তনুর ললিত নিয়ন্ত্রণে

একচ্ছন্দে বাঁধা যে-বিচিত্রতা,

তার তাল মান, লয়ের বিশ্লেষণে

ব্যর্থ আমার মৌল অক্ষমতা।

 

এ কী অপরূপ রূপান্তরের মায়া!

সব ইন্দ্রিয় এক অন্বয়ে দান্ত—

নিশ্বাস তার সংগীতে নেয় কায়া,

কণ্ঠস্বরে সৌরভ নিষ্ক্রান্ত।'

(একে সব/ বোদলেয়ার/ বুদ্ধদেব বসু)

'ছেলেবেলা' বইয়ের এক জায়গায় পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর দেখা হওয়ার প্রসঙ্গ : "রবীন্দ্রনাথকে আমি প্রথম চোখে দেখেছিলাম বুড়িগঙ্গার উপর নোঙর-ফেলা একটি স্টিম-লঞ্চে... উপরের ডেক-এ ইজি-চেয়ারে ব'সে আছেন তিনি—ঠিক তাঁর ফটোগ্রাফগুলোর মতোই জোব্বা-পাজামা পরনে...। রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে কবিতা-পাঠ আমি প্রথম শুনেছিলাম তাঁরই বাড়িতে এক রবীন্দ্র-সন্ধ্যায়, সবান্ধবে বরাহূতভাবে উপস্থিত হয়ে।" রবিঠাকুরকে নিয়ে কবিতাও লিখেছেন বুদ্ধদেব। মনে আছে, তাঁর '২২শে শ্রাবণ' কাব্যগ্রন্থের বিখ্যাত কবিতা 'রবীন্দ্রনাথের প্রতি' কলেজে পড়ার সময় আমাদের পাঠ্যে ছিল। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অন্য একটি কবিতায় বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন—

ছিলে না বনের মৃগ, ঘাস, ফুল, মেঘের গহ্বরে

রঙিন আলোর খেলা। এমনকি, বালক ছিলে না

তীক্ষ্ণ চোখ ঘিরে ছিল সারাদিন। হাতের খেলনা

ভারি হয়ে পড়ে গেছে হাত থেকে। তবু ছিলে অবসরে ভ'রে

 

তুমিও পাওনি দেখা নাপোলিতে নীলনয়নার।

চিঠির উত্তর নেই! দেখে ছিল, আমাদেরই মতো।

হয়তো ঘামাচি, মশা প্রতিকূল বাতাসে প্রহত

ভূলুণ্ঠিত ঘুড়ির আঁধার ঘণ্টা। তবু ছিলে প্রতিযোগিতার

 

পারাপারে, বিশ্রামে শুভ্রতাময়, যেন তুমি কখনো করোনি

চেষ্টা, কিংবা যেন কলস গিয়েছে ভেসে, তুমি শুধু জল।

যা পেয়েছি দু-দণ্ড তোমার কাছে, নিঃশব্দ, কেবল

 

সন্ধ্যার নিবিড়তায় বসে থেকে, আজ তাকে নির্ঘুম যামিনী

জ্বেলে দেয় কূট গ্রন্থে ভাবনার পাণ্ডুর অনলে,

বাক, অর্থ, সম্পর্কের হিংসুক দাঙ্গা শেষ হ'লে।

(রবীন্দ্রনাথ/ যে-আঁধার আলোর অধিক)

বুদ্ধদেব বসু যখন আমেরিকায় অধ্যাপনা করতে গেলেন, তখন কলকাতায় 'কবিতা' পত্রিকার দায়িত্ব সামলাচ্ছেন নরেশ গুহ। সেই সময় তাঁদের মধ্যে বহু চিঠি আদান-প্রদান হয়, চিঠিগুলো বাংলা সাহিত্যে নানা দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। বিশেষ করে তরুণ কবিদের কাছে চিঠিগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। এমনই একগুচ্ছ অপ্রকাশিত চিঠি প্রকাশ করেছে 'উত্তরকাল' পত্রিকা। একটি চিঠিতে পাই : "শিল্পী হওয়া সহজ না নরেন, অনেক দুঃখের জন্যে তৈরি হতে হয়। ধরে নিতে হবে কেউ তোমার কথা শুনবে না। সমস্ত পৃথিবী তোমার বিরুদ্ধে কিংবা উদাসীন আর তার পরেও যার কলম চলে তাকেই তো শিল্পী বলব বা শিল্প স্রষ্টা"। এইসব চিঠি পড়তে গিয়ে আমদের মনে পড়ে যেতে পারে জনৈক তরুণ কবিকে লেখা রিলকের বিখ্যাত চিঠিগুলি। যার বাংলায় অনুবাদ করেছেন অমিতাভ চৌধুরী। রিলকেও এক তরুণ কবিকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন, "আমাদের অধিকাংশ অভিজ্ঞতাই অবর্ণনীয়। যেখানে তার অবস্থান, বর্ণনা সেই পরিসরের মধ্যে ঢুকতে পারে না, আর অন্য সব কিছুর শিল্পী অনেক বেশি অবোধ্য ও অবর্ণনীয়। যে রহস্যের মধ্যে মধ্যে সৃষ্টির আত্মার অবস্থান সেখানে আমাদের ব্যক্তিগত অতি ক্ষুদ্র ও স্বল্পস্থায়ী জীবনের চেয়ে তাকে অনেক বেশি কিছু সহ্য করতে হয়।"

বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত 'কবিতা' পত্রিকার কাছে নানা প্রজন্মের বাঙালি পাঠক ঋণী হয়ে থাকবে। বাংলা কবিতার যে বহুল স্বরকে এই পত্রিকা ধারণ করে আছে তা ভবে বিস্মিত হতে হয়। শুধু বাংলা কবিতা কেন, কবিতাপাঠকের অজানা নয় যে, নানা দেশের কবিতার সঙ্গে বাঙালির পরিচয় করিয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিল 'কবিতা' পত্রিকা। পরে মীনাক্ষী দত্ত’র সম্পাদনায় 'প্যাপিরাস' থেকে তিন খণ্ডে প্রকাশ পায় 'কবিতা' পত্রিকার সংখ্যাগুলি। যা আস্বাদন করার জন্য ধৈর্যের সঙ্গে মনোনিবেশ করা প্রয়োজন। জীবনানন্দ দাশ থেকে সমর সেন, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত থেকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের বহু কবিতা এখানেই প্রথম প্রকাশিত হয়।

পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশ করেছে বুদ্ধদেব বসুর 'প্রবন্ধ সমগ্র'। এমন সুপরিকল্পিত গ্রন্থের সম্পাদনা করেছেন, শঙ্খ ঘোষ, অমিয় দেব, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, দময়ন্তী বসু সিং, প্রভাতকুমার দাস। স্বল্প পরিসরে বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে লেখা দুরূহ কাজ। এক দিকে আলো ফেলতে চাইলে অন্য দিকে বাদ পড়ে যায় আস্ত সমুদ্র! ছাত্র জীবনে বুঁদ হয়েছিলাম 'কালের পুতুল' বইটিতে। নজরুল, জীবনানন্দ, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণ দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, সুভাষ মুখোপাধ্যায়দের কবিতাকে স্পর্শ করতে এ বই এখনও অভূতপূর্ব সাহায্য করে।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা