X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১
দেবেশ রায়ের গল্পপাঠ

‘হাড়কাটা’ থেকে ‘উদ্বাস্তু’ ।। শেষ পর্ব

প্রশান্ত মৃধা
২৪ মার্চ ২০২২, ১৮:০৩আপডেট : ২৪ মার্চ ২০২২, ১৮:০৩

এবছর একুশে গ্রন্থমেলায় কাগজ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে দেবেশ রায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প। সম্পাদনা করেছেন সমরেশ রায়। বইয়ের শেষে একটি দীর্ঘ পাঠ-অভিজ্ঞতা লিখেছেন প্রশান্ত মৃধা। সেই লেখাটি পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো।

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন : ‘হাড়কাটা’ থেকে ‘উদ্বাস্তু’

দ্বিতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন : ‘হাড়কাটা’ থেকে ‘উদ্বাস্তু’

তৃতীয় পর্ব পড়তে ক্লিক করুন : ‘হাড়কাটা’ থেকে ‘উদ্বাস্তু’


কিন্তু এর পাশেই, অথবা এরপরই যদি ‘অপেক্ষায়’ (১৯৬১)-র দিকে তাকানো যায়, পড়া যায়, খেয়াল করার প্রয়োজনই হবে না, এমনিতেই মনে হবে, এই গল্পে একেবারেই আলাদা দেবেশ, এ যেন শাস্ত্রবিরোধী গল্প আন্দোলনের যে দাগ ও ঝোঁক তার সেই সমকাল গায়ে মেখেছিলেন তার প্রকৃত উদাহরণ। গল্পহীনতা যেমন আছে এই গল্পে, আছে বিমূর্ততার শিল্পীও, আবার একইসঙ্গে ভাষাকে হাতে তুলে নেওয়ার কৌশলগত ভাষার খেলা, যে খেলা ওই সমকালে দেবেশসহ তার সহযাত্রীরা অনেকেই দেখিয়েছেন, কেন তাও পরস্পরকে দেখানো যেভাবে অনেকজন দক্ষ তিরন্দাজ পরস্পর তির নিক্ষেপের কৌশল দেখায়, বাহবা নেয়, হয়তো ভিতরে ভিতরে তা তাদের একপ্রকার পরচর্চা। সেটা তো আর যুদ্ধের ময়দান নয়। তবু ওই দেখানোর ভিতরে লুকিয়ে আছে পরস্পরের কৌশল দেখা ও একইসঙ্গে নিজেরটা দেখানো। ওই ষাটের দশকের শুরুতে প্রবীণ-নবীন মিলিয়ে কলকাতায় বাংলা কথাসাহিত্যের প্রধান সকল ছোটোগল্প লেখক নিজ নিজ শরচালন দেখিয়ে যাচ্ছেন। সেখানে দেবেশ রায় আর মধ্যবয়স্ক অমিয়ভূষণ মজুমদার ছাড়া প্রান্তবাসী প্রধান গদ্যলেখক প্রায় নেই, কারণ তারাশঙ্করও ততদিনে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় থিতু, এবং প্রধান লেখাগুলো প্রায় সব লিখে ফেলেছেন। বরং, অমিয়ভূষণ মজুমদার পঞ্চাশের দশকে আগত অতি তরুণদের মতোই সাহিত্য ক্ষেত্রে অনেকটাই তরুণ আর কখনো ‘বড়ো কাগজ’ যাকে বলে সেখানে অপ্রকাশিতই প্রায়।

‘অপেক্ষায়’ প্রায় সংলাপে বলা গল্পে, উত্তমপুরুষ, কে কাকে বলছে তা বোঝা যায়, আর কোথাও যেন একটু রোম্যান্টিকতার আবেশও ছড়ানো। ‘কলকাতা ও গোপাল’ তো বটেই, সেই ‘নাগিনীর উপমেয়’ কিংবা ‘আহ্নিক গতি ও মাঝখানের দরজা’র যে দেবেশ রায় ততদিনে ‘দেশ’ নামক ভীষণ জনপ্রিয় সাপ্তাহিক কাগজটির পাঠকের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছেন, তাদের তিনি জানিয়ে দিলেন যে দেবেশ চাইলে এই গল্পও লিখতে পারেন, এবং সেখানেও তিনি দারুণ স্বতঃস্ফূর্ত! সেই যে দুজনার সংলাপ, সেখানে একজন মানসিকতার অসুস্থ নাকি শারীরিকভাবে, তাদের দুজনার কথা গড়িয়ে চলে। একসময়ে এই গল্প শেষ হয়। শেষ অংশটা যেন কবিতা। এই সময়ের আগে-পরে দেবেশ রায়ের জীবনানন্দ মুগ্ধতার কথা জানি। পাঠক হিসেবে সর্বগ্রাসী দেবেশ তখন মাইকেল-রবীন্দ্রনাথ থেকে সাম্প্রতিক শঙ্খ ঘোষ মুখস্থ রাখছেন, আর তার একেবারে সমকালীন সুনীল-শক্তিকেও নিশ্চিত। কিন্তু পাশাপাশি জীবনানন্দকে নিয়ে সেই লেখায় একথা জানাতে ভোলেন না, তার আর তাদের গদ্যভাষাকে সেই সময়ে কীভাবে প্রভাবিত করেছিলেন জীবনানন্দ। ফলে, এ যেন সেই প্রভাবের অনুবাদ, একেবারেই বিমূর্ত কাহিনিগদ্যে :
“ও আমার দু-কাঁধের ওপর দুহাতের দশটা আঙুল সাঁড়াশির মতো চেপে ধরে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। আর রাত্রির পাখির পাখার শব্দে সারা আকাশের হাহাকারের মতো এক হাহাকারের ওপর আমরা আকাশ ফাটানো হাহাকার করার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকলাম। সেই পোড়া অনুর্বর জলা জমির অপর পারে চাঁদের আরো ক্ষয় ধরেছে, যেন এক বিশেষ জাতীয় জন্তুর শেষ নিদর্শন মুখব্যাদান করে মারা যাচ্ছে। আর মৃত্যুমুখী চাঁদের গা-চোঁয়ানো ক্ষীণ আলোতে আমরা পরস্পর জড়াজড়ি করে ভবিষ্যৎ নামক কোন এক চিত্রকরের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম—আহত চাঁদের মৃত্যু, নতুন চাঁদের জন্ম ও বাঁচব কেন, বাঁচা কেন, স্বপ্ন ও স্মৃতি কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত জনৈক মানুষের উত্থাপিত এ প্রশ্নের জবাবের অপেক্ষায়।”
এই গল্পের শেষ জায়গাটুকু যেন আরও কথার অপেক্ষায় রেখেই শেষ হলো, আর তা একেবারেই কবিতাংশ, এ কি দেবেশ রায়ের সেই অন্য এক অপেক্ষারই স্বীকারোক্তি? হোক কিংবা না হোক, এই গল্পও যে এক তরুণ লেখকের, যিনি নিষ্করুণ চোখে আগের কয়েকটি গল্প লিখে এখানে এমন কাব্যিকতার ভিতরেও চরাচর ধ্বনিত করার হাহাকারকে বুনে নিতে পারেন।

সেখান থেকে ‘উদ্বাস্তু’তে গেলেই সেই পাঠককে একেবারে উলটে যেতে হয়। সেটি যে কতটা তা একটানে এভাবে সরাসরি কোনোভাবেই লিখে বোঝানো সম্ভবও নয়। ‘উদ্বাস্তু’ নামেই যেন একপ্রকার বুঝে নেওয়া যায়, গল্পটা দেশভাগজনিত। সেদিক থেকে বিষয়ভিত্তিক গল্প এটি। তাই, তখন পাঠকের পাঠের ঐতিহ্যগত কাঠামোতে তো ওই পটভূমিকায় লেখা বিখ্যাতগুলো একটা আকার নিয়ে নিয়েছে। সেখানে একেবারে দেশভাগের আগেপাছে সময়ের লেখা সমরেশ বসুর ‘আদাব’, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’ (এই দুটো গল্পই ঢাকা শহরের পটভূমিতে রচিত) থেকে দেবেশের সমকালীন অতীন বন্দোপ্যাধ্যায়ের ‘কাফের’, প্রফুল্ল রায়ের ‘রাজা যায় রাজা আসে’, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘উইপোকা’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পুরী এক্সপ্রেসের রক্ষিতা’ ইত্যাদি গল্পের কথা ঘোরাফেরা করে। আর তা, পটভূমিজনিত কারণে স্বাভাবিকই। সেই দিক থেকে, অমন প্রত্যাশার স্বাভাবিক এক গড়ন মাথায় থাকতেই পারে। তা অস্বাভাবিকও নয়। দেশভাগের পটভূমির গল্পও না চাইতেই এক গড়নও মাথায় তৈরি করে নেয়। ‘উদ্বাস্তু’ সেই গড়ন ভাঙার গল্প। সেদিক থেকে ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’, ‘পুরী এক্সপ্রেসের রক্ষিতা’ আর ‘উদ্বাস্তু’—প্রতিটিই এগুলোর রচয়িতাদের কলমের স্বাভাবিক শক্তি আর কাহিনির বিস্ময় জাগানিয়া কল্পনায় ওই গড়নকে ভেঙে গড়ে তোলে। এর ভিতরেও ‘উদ্বাস্তু’—গল্পলেখার কৌশলে আজকে যাকে লাতিন কাহিনিগদ্যের ভিতর থেকে খুঁজে নিয়ে জাদুর এক বাস্তবতা নামে লেপন দিয়ে দেওয়া হয়, সেই ‘বিস্ময়কর’ বিষয়টিও এখানে খুঁজে পাওয়া যায়। কারণ ভাঙা দেশ বা স্বদেশে সেই কল্পনা এক জাদুরই সহায়তায় যেন বাস্তবতার সকল আড়ালকে ভেঙে দিয়ে একাকার করে দিয়েছে। একইসঙ্গে খেয়াল রাখতে হচ্ছে দেবেশ রায় এই গল্পটি লিখেছেন ১৯৬২ সালে, ‘পরিচয়’-এ। তখন বাংলা ভাষায় লাতিন আমেরিকার সাহিত্যের ওই তর বাস্তবতার কোনো প্রলেপ লাগার কোনো সুযোগ নেই, ছিলও না। ওই অঞ্চলের সাহিত্য সেই ধরনের, যাকে আমরা ‘জাদুবাস্তবতাবাদ’ বলছি, সেই নৌকা বা জাহাজ চালাতে শুরু করে মোটামুটিভাবে সত্তর আর আশির দশকে। তাদের যে ‘বুম’ বা জাগরণ তাও তো ষাটের দশকের মাঝামাঝির আগেকার কোনো সাহিত্যিক যাত্রা নয়, অন্তত এ বিষয়ে পেরুর ঔপন্যাসিক হোসে দানোসো যে বইটি লিখেছেন, সেখানেও সেই সাক্ষ্যই বহমান। সেই হিসেবে, এই গল্পে দেবেশ রায়, ওই সময়েই গল্প রচনায় যে কুশলার ছাপ রেখেছেন, অথবা উনিশত সাতচল্লিশই তাকে এই গল্প রচনা করিয়েছেন, ১৯৬২-তে, আর সেখানে দেশভাগজনিত যে কুহক আর বাস্তব আর বাস্তবের যে কুহক, যা ওই গল্প পড়ার পরেও তো কোনো সমাধান পাওয়া যায় না। শুধু ভেবে নেওয়া যায় ১৯৪৭-ই তাই, এখানে যা ঘটছে আর তা প্রকাশিত হচ্ছে ১৯৬২-তে স্থানীয় থানা থেকে বল্লভপুর-নিবাসী জনৈক শ্রীসত্যব্রত লাহিড়ীকে প্রমাণ দিতে বলা হয় তিনিই যে সত্যব্রত লাহিড়ী। তখন দেখা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুই জন সত্যব্রত লাহিড়ী বিএ পাস করেছিলেন।

গল্পটা ভীষণ জটিল, আবার খুবই সহজ। দেবেশ রায় তার জানাশোনা আর সেই ভাঙনের কালের আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু সমস্যার সঙ্গে মিলিয়ে বিষয়টি দেখেছেন। এখানে একেবারে ভাষ্যকার তিনি। যখন, কোনো একসকালে থানা থেকে লোক এসেছে, সত্যব্রত লাহিড়ীকে থানায় যেতে বলা হয়েছে। সেই সুযোগে ভারতীয় ইউনিয়নে তখন (১৯৬২) ক্রিয়াশীল আইনটি বা যে ঘটনার কারণে এই খোঁজ নেওয়ার কারণ, তাও তিনি জানিয়ে দিলেন যে, ‘১৯৩৯ থেকে ’৪৫ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে পৃথিবীর ভূগোল ও ইতিহাসে যে গুরুতর পরিবর্তন ঘটেছে।’ তার জের তো চলমান। তাতে ১৯৫০-এর দাঙ্গার পরে ‘মৃত কদম শেখের তাঁর পুত্র মনসুর, কন্যা আনিমা ও স্ত্রী নুরাকে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলে যাবার পূর্বে’ এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব শ্রীবনবিহারী মল্লিককে দিয়ে যান। ‘ঐ বৎসরই শ্রীবনবিহারী মল্লিক ঐ হোল্ডিংয়ের মালিক হিসাবে শ্রীসত্যব্রত লাহিড়ীর নিকট বিক্রি করেন। পাবনা অন্তর্গত রায়চরে শেখ মনসুর আলির নিকট ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ১৩ ডিসেম্বর তারিখের মূল দলিলের নকল আছে।’ ফলে, ‘বল্লভপুর মিউনিসিপ্যালিটির ২৩০/এ/৬ নং হোল্ডিংস্থ মোকামের মালিকের নাম শ্রীসত্যব্রত লাহিড়ী নয়।’ এইটুকুই এই গল্পের সূচনা। কিন্তু গল্পটা একেবারেই ভিন্ন। আর সেখানেই ১৯৪৭, সেখানেই উদ্বাস্তু, আর সেখানেই ওই যে জাদু যা কখনো কখনো বাস্তব।

এই সত্যব্রত লাহিড়ীর সঙ্গে বিয়ে হয় পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত অনিমা সান্যালের। সেখানেই গল্পটা। কারণ অনিমা সান্যালকে রেখে এক কাপড়ে তারা বাবা হেমচন্দ্র সান্যাল ভারতে চলে এসেছেন। সেটাও ১৯৫০। এসে বলেছেন, এই মেয়েটি তার দিদির কাছে চাবাগানে আছে। তারা যে ভারতবর্ষে আসতে পেরেছে তার কারণও অনিমা। তার এনামুল হক চৌধুরীর সঙ্গে সম্পর্ক। আর সেই কারণে দাঙ্গায় তাদের কোনো ক্ষতি হয়নি। শুধু অনিমা রয়ে যায়। এবং এরপর কুমকুম নাম নিয়ে এনামুলকে বিয়ে করে। ১৯৫১-এর ৫ ফেব্রুয়ারি। তারপর পরস্পর ‘সংস্কারবশত’ই তারা দূরত্বও রাখে। এবং, এক বছর পরে ১৯৫২-র মাঝামাঝি তার গর্ভসঞ্চার হয়। আর তখন ‘অনিমার শারীরিক অবস্থায় বাপ-মায়ের কাছে থাকলে ভালো হবে ও শ্বশুর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হবে বিবেচনায় এনামুল অনিমাকে মুখেরা পাঠাবার ব্যবস্থা করে।’ এরপর ১৯৫২-রই ৩০ জুলাই অনিমা পাকিস্তান থেকে আসার দেড়মাসের মধ্যেই, ‘মৃত পুণ্যব্রত লাহিড়ীর পুত্র শ্রীসত্যব্রত লাহিড়ীর হেমচন্দ্র দুই মাসের গর্ভবতী অনিমার বিবাহ দেন। ও সেই বিবাহের সাত মাস পরে সে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মার্চ বল্লভপুর হাসপাতালে একটি পূর্ণাঙ্গ সুস্থ ও স্বাস্থ্যবান সন্তান প্রসব করে। এ সন্তানের গর্ভসঞ্চার হয়েছে এনামুল হক চৌধুরীর স্ত্রী রূপে, প্রসব হয়েছে সত্যব্রত লাহিড়ীর শ্রীরূপে।’ সেই সন্তান অঞ্জনা। অবশ্য এইসব মতের ভিন্ন মতও আছে। সেগুলোও এখানে আছে। জটিল আবর্ত এই গল্পে।

‘উদ্বাস্তু’র শেষের আগে, সেই সমস্ত মতামত এক করে মিলিয়ে নিয়ে এ যেন রহস্য উন্মোচন, কিন্তু তাতে এইসব মানুষ উদ্বাস্তুই থেকে যান :
“সমস্ত মতামত বিবেচনা করলে দেখা যায়—(ক) অনিমা এনামুলকে ভালোবাসত, না কি এনামুল জোর করে অনিমাকে আটকে রেখেছিল (খ) অনিমা এনামুলকে নামান্তরিত হয়ে স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছিল, নাকি বাধ্য হয়ে (গ) অনিমা সত্যব্রতকে গোত্রান্তরিত হয়ে স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছিল, নাকি বাধ্য হয়ে (ঘ) অঞ্জনা কার কন্যা, এনামুলের না সত্যব্রতের—এই চারটি প্রশ্নের সঠিক উত্তরের ওপর অনিমার প্রকৃত পরিচয় নির্ভর করছে এবং অঞ্জনার। এবং প্রশ্নগুলি মানুষ সম্পর্কে কতকগুলি মৌলিক প্রশ্নের কাছাকাছি নিয়ে যায়, অতি দ্রুত ও অতি সোজাসুজি।
যতদিন এই সোজাসুজি প্রশ্ন চারটির সত্য জবাব পাওয়া যাচ্ছে না ততদিন—যাঁকে আপনি স্ত্রী বলে জানেন, তিনি আপনার স্ত্রী নন; যাকে আপনাদের সন্তান বলে জানেন, সে আপনাদের সন্তান নয়।
সুতরাং, নিজের আদি, অকৃত্রিম ও মৌলিক আত্মপরিচয়সহ নিকটবর্তী থানায় হাজিরা দিয়ে প্রমাণ করুন আপনি যে, আপনি সত্যি সে।”

এরপর গল্প তো প্রায় শেষ। মহাকালের প্রান্তে, অথবা মধ্যিখানে, যেখানে দেবেশ রায় সত্যব্রত অনিমা আর অঞ্জলিকে দাঁড় করিয়ে রাখল, অথবা স্থাপন করলেন, সেই বর্ণনা। বলা যায় গ্রন্থিমোচন। তাতেও “সেই ক্রমঘনিষ্ঠ অন্ধকারের আকাশে নিঃশব্দ ঘোষণা—‘তুমি, তুমি নও সত্যব্রত; তুমি তুমি নও অনিমা।”—এই বিলাপ তো থাকেই।

কিন্তু, গল্প শেষ হওয়ার পরেও পাঠকের বিস্ময় কিন্তু ঘুচবে না। এই ঘটেছিল, কিংবা ঘটেছে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ পর্বে। যার জের টানছে ১৯৬২ সালেও। তারপরও পরে। এই বাংলায়। এই রহস্য তো কোনোকালেই যেন ভেদ হওয়ার নয়। কোনোদিনও। আর দেবেশ রায় রচনার যে কৌশল নিয়েছে, সেখানেই জাদু, নাকি বাস্তবটাই এখানে অমন লুকানো জাদুর আশ্রয় নিয়েছে। বাংলা ভাষার এমন গল্প রচনার কৌশল বহুদিন পরে শহীদুল জহিরের হাতে দেখা যায়। অন্তত তার ‘কোথায় পাব তারে’ কিংবা ‘মনোজগতের কাঁটা’য়, সেগুলোকে জাদুবাস্তবতাবাদের ছোঁয়ার কথা বলেন, হয়তো সেই লাতিন তরঙ্গের ধুঁয়োর আগেই দেবেশ রায় সেটি করে দেখিয়েছেন, অথবা, দেশভাগ নামক বাস্তব তাই তাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছে।

দীর্ঘ লেখক জীবনকে দেবেশ রায় নদীর উজান দেখা জোয়ার, আর ভাসবার ভাটির কথা বলেছেন নিজের সম্পর্কে :

“একটু বেশিদিন বেঁচে-থাকা ও লিখতে লিখতে বেঁচে থাকার মধ্যে জোয়ার ভাটার খেলা ঘটতে থাকে। জোয়ার মানে তো নদীর বিপরীত গতির প্রবলতর স্রোত নদীর ভিতরে ঢুকে পড়া। আর, ভাটা মানে তো সেই প্রবলতার বিপরীত স্রোতের নদীস্রোতের অনুকূলেই ফিরে যাওয়া। নদী স্রোতের উজানে যেতে হলে, জোয়ারের জন্য বসে থাকতেই হয়। নদী স্রোতেই ভাসতে হলে, ভাটার জন্যও অপেক্ষায় থাকতে হয়।”

গল্পলেখক হিসেবে তার প্রস্তুতি ও যাত্রা, সেখানে ১৯৬১-৬২ পর্যন্ত, গল্প রচনারই কাল, এই ১৯৬২ নাগাদ—তিনি, উপন্যাসও ভাবতে শুরু করেছেন। সেই দিক, এই সময়ে ‘কালীয় দমন’ নামক একটি উপন্যাসও লিখেছেন, যদিও তাকে তখনও তিনি বড়ো গল্পই বলতে চান। তাই, এই পর্বে, ওটি বড়ো গল্প হলেও গল্পের ওপর ‘অনন্য নির্ভরতা’ কমায়, আর ‘উপন্যাসও ভাবতে’ থাকায়, উদ্বাস্তু থেকে ‘কালীয় দমন’ একটা পর্বও। ফলে, এখানেই একঅর্থে গল্পযাত্রার দ্বিতীয় পর্বের শুরু, আর উপন্যাসযাত্রার সূচনাও।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২০ এপ্রিল, ২০২৪)
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
চাটমোহরে ঐতিহ্যবাহী ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
রাজশাহীতে দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো বিভাগীয় সর্বজনীন পেনশন মেলা
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া