X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

কাঁচাপাকা ধানই এখন হাওরের কৃষকদের সম্বল

শফিকুল ইসলাম, নেত্রকোনা থেকে ফিরে
২৭ এপ্রিল ২০১৭, ২২:০০আপডেট : ২৮ এপ্রিল ২০১৭, ১৫:৫১

পথের ধারে রাখা কাঁচাপাকা ধান পথে পথে কাঁচাপাকা ধানের স্তুপ। কিছু আছে আধাকাঁচা, আধাপাকা। নেত্রকোনা জেলার মদন, আটপাড়া, খালিয়াজুড়ি ও বারহাট্টা উপজেলার বিভিন্ন পথে চোখে পড়লো এমন দৃশ্য। হাওরের পানিতে তলিয়ে গেছে হেক্টরের পর হেক্টর জমি। আর ১০-১৫ দিন গেলেই হয়তো ঘরে তোলা যেতো পাকা ধান। কিন্তু সেই সুযোগ হারিয়ে আধাপাকা ধানই এখন এই অঞ্চলের কৃষকের একমাত্র সম্বল।

গত ২৪ ও ২৫ এপ্রিল নেত্রকোনার হাওর এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা গেছে, হাওরের পানিতে তলিয়ে যাওয়া কাঁচাপাকা ধান কোনোরকম কেটে তুলে এনে তা স্তুপ করা হচ্ছে পথের ধারে। কারণ শুকনো জায়গা নেই ভাটি এলাকার গ্রামগুলোতে। বৃষ্টির পানি আর হাওরের উপচেপড়া পানিতে তলিয়ে গেছে বাড়িঘরের আঙিনা। তাই ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলার কৃষকদের কাছে ধান রাখার জন্য এখন পথই একমাত্র ভরসা।

মদন উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়ালিউল হাসান খান বললেন, ‘বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করতে কৃষকরা পলিথিন দিয়ে ঢেকে রাখছেন ধান। দিনরাত চেষ্টা করে কেউ কেউ মেশিনে মাড়িয়ে ধানগুলো রাস্তার ওপরেই শুকানোর চেষ্টা করছেন। এগুলোই নেত্রকোনা জেলার বানভাসি মানুষের আগামী এক বছরের সম্বল! ’

একই উপজেলার উচিতপুর গ্রামের বাসিন্দা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘পানিতে তলিয়ে যাওয়া ধান আমরা যে যেটুকু পেরেছি কেটে এনেছি, যদি কিছু পাওয়া যায়! কেটে আনা ধান রাখার জায়গাও নেই। তাই রাস্তার ধারেই স্তুপ করে রাখছি।’

নেত্রকোনার জেলা প্রশাসক ড. মুশফিকুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, জেলার ছোটবড় মিলিয়ে মোট হাওরের সংখ্যা ১৩৪টি। এবারের বন্যায় ৭৩ লাখ হেক্টর জমির ফসল এবং ৮ লাখ ১৩ হাজার গবাদি পশুর মধ্যে ৪ লাখের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ ৮০-৮৬ শতাংশ। তবে গরু-হাঁস মরেনি বলে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও স্থানীয় সংসদ সদস্য যুব ও ক্রীড়া উপ-মন্ত্রী আরিফ খান জয় এসেছিলেন বন্যাদুর্গত হাওরবাসীকে ত্রাণ দিতে। সেই ত্রাণের আশায় বসেছিলেন বারহাট্টা উপজেলার চিরাম ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন। বয়স আনুমানিক ৫০-৫৫ বছর। তাহেরা-মান্নান স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে কথা হয় তার সঙ্গে।

বাংলা ট্রিবিউনকে আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘গত ৩০-৩৫ বছরে এ অঞ্চলের হাওরে এত পানি আসেনি। এ বছরই হঠাৎ পানি এসে আমাদের সবকিছু ডুবিয়ে দিলো। এক রাতের মধ্যে তলিয়ে গেলো সারাবছরের সঞ্চয়। সিঙ্গুর হাওরের ৬ বিঘা জমিতে চাষ করেছিলাম ইরি ২৯। সকালে হাওরের পাড়ে গিয়ে দেখি সব পানির নিচে।’

পানিতে নেমে ধানা কাটার চেষ্টা করে ৩৫ কেজি ধান তুলতে পেরেছেন বলে জানান আনোয়ার হোসেন। এর মাধ্যমে সর্বোচ্চ ২০-২২ কেজি চাল পাওয়া যেতে পারে বলে মনে হচ্ছে তার। কিন্তু এই চাল দিয়ে বছর যাবে কীভাবে? তাই স্থানীয় প্রশাসনের মাইকিং শুনে তাহেরা-মান্নান স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এসেছেন ত্রাণের আশায়। কিন্তু স্থানীয় চেয়ারম্যানের দেওয়া স্লিপ না থাকায় ত্রাণ না পেয়ে হতাশা নিয়ে বসেছিলেন তিনি।

একই ওয়ার্ডের হাফিজ উদ্দিন, রহমত আলী ডাকুয়া, আমেনা বেগম, একই ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা আবদুল খালেক, নসিরন বানু, আবদুস সালাম, আবদুল জব্বারও এসেছেন ত্রাণের আশায়। তারা সবাই জানান, তাদের সারাবছরের সম্বল ডুবে গেছে অসময়ে হাওরে আসা পাহাড়ি ঢলে।

হাফিজ উদ্দিন জানান, স্থানীয় ধামারুক হাওরের ৮ কাঠা জমিতে ধান চাষ করেছিলেন তিনি। পাননি এক কেজি ধানও। সবই ডুবে গেছে। রহমত আলী ডাকায়া টেংরাম হাওরের ১৬ কাঠা জমিতে চাষ করেছিলেন ইরি। তারও জমি পুরোটাই তলিয়ে গেছে। সেই তলিয়ে যাওয়া ধান কেটে এনে দেখেন অধিকাংশই কাঁচা। ২৬-২৭ কেজি ধান শুকানোর চেষ্টা করছেন এখন। পথের ধারে এই ধান দুই দফায় বৃষ্টিতে ভিজেছে।

চিরাম ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডের মেম্বার রতন মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বললেন, ‘আমার ওয়ার্ডের ৮০-৯০ শতাংশ মানুষই হাওরের ওপর নির্ভরশীল। কৃষক ও জেলেদের এখন রাস্তায় নামার দশা। গবাদি পশুর খাদ্য সংকটও তীব্র। কারণ ঘাস নেই। পশুর খাবার কিনে দেওয়ারও সামর্থ্য নেই কারও।’

৭ নং ওয়ার্ডের মেম্বার রতন মিয়া জানান— এই উপজেলার ধামারুক, সিঙ্গুর, ঝিন্দাঝুড়ি, টেংরাম, ধুরখাট হাওরের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৬-৭ ফুট বেশি পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব হাওরে মাছ তেমন মরেনি। তবে ভেসে গেছে। এখানকার হাঁসেরও কোনো ক্ষতি হয়নি বলে জানান তিনি।

বারহাট্টা উপজেলার চেয়েও পার্শ্ববর্তী খালিয়াজুড়ি উপজেলায় বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান ৬ নং ওয়ার্ডের মেম্বার আতিকুর রহমান। সব মিলিয়ে নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা, কেন্দুয়া, দুর্গাপুর ছাড়া বাকি উপজেলাগুলোতে হাওর বেশি। এর মধ্যে মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুড়ি উপজেলায় হাওর বেশি। তাই সেইসব স্থানে ক্ষতির পরিমাণও বেশি।

আটপাড়া উপজেলার বানিয়াজান ইউনিয়নের সোনাইখালী গ্রামের বাসিন্দা গোলাব জান বিবির সঙ্গে কথা হলো বাংলা ট্রিবিউনের এই প্রতিনিধির। ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধা জানান, তার স্বামী নেই, বেঁচে আছেন তিন ছেলেকে নিয়ে। ছেলেরা হাওরে মাছ ধরে। অন্যের জমিতে ধান চাষ করে। যা পায় তা দিয়েই নাতি-নাতনিদের নিয়ে বছর কেটে যায়। মন্ত্রীকে পেয়ে তার ভুবন কাঁপানো আর্তনাদ— ‘আমরা এহন কি খাইয়্যাম? (কি খাবো) ক্যামনে বাচবাম? (কীভাবে বাঁচবো)’ কোনও উত্তর নেই মন্ত্রীর মুখে।

এ সময় উপস্থিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘আমাদের ওপর ভরসা রাখুন। একজন মানুষও একবেলা না খেয়ে থাকবে না। সরকারদলীয় নেতারা ও স্থানীয় সংসদ সদস্যরা প্রশাসনের সহায়তায় খাদ্য সহায়তা নিয়ে দাঁড়াবে প্রতিটি পরিবারের পাশে। আপনাদের ঘরে খাদ্য পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের।’

বারহাট্টা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ‘উপজেলার মানুষগুলো হাওরের ওপর নির্ভরশীল। বানভাসি মানুষগুলোর এখন দুর্দশা। তবে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সহযোগিতা করা হচ্ছে। এ সাহায্য চলবে পরবর্তী ফসল না ওঠা পর্যন্ত।’

/এসআই/এফএস/ জেএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সুন্দরবনে আগুন লাগা স্থানে ধোঁয়া দেখলেই পানি দেওয়া হচ্ছে
সুন্দরবনে আগুন লাগা স্থানে ধোঁয়া দেখলেই পানি দেওয়া হচ্ছে
আজকের আবহাওয়া: ঝড়ো হাওয়াসহ শিলাবৃষ্টির আভাস
আজকের আবহাওয়া: ঝড়ো হাওয়াসহ শিলাবৃষ্টির আভাস
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্বে স্কটল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্বে স্কটল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা
ভারতের উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস অফিসে হামলা, গাড়ি ভাঙচুর
ভারতের উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেস অফিসে হামলা, গাড়ি ভাঙচুর
সর্বাধিক পঠিত
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
অভিযোগের শেষ নেই মাদ্রাসায়, চলছে শুদ্ধি অভিযান
অভিযোগের শেষ নেই মাদ্রাসায়, চলছে শুদ্ধি অভিযান