X
বুধবার, ০১ মে ২০২৪
১৮ বৈশাখ ১৪৩১

সংলাপে নানামুখী প্রস্তাব, কী করবে ইসি?

এমরান হোসাইন শেখ
২০ অক্টোবর ২০১৭, ২১:৪৫আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০১৭, ২১:৫৪

 

রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ইসির সংলাপ বৃহস্পতিবার শেষ হলো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সংলাপ। এই পর্যন্ত ৪০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ইসি সংলাপ করেছে। সংলাপের এজেন্ডা হিসেবে  রোডম্যাপ-নির্ধারিত ৭টি ইস্যু ঠিক করে দেয় ইসি। কিন্তু নির্ধারিত এজেন্ডাগুলোর বাইরের অনেক বিষয়ে পরামর্শ-প্রস্তাব দিয়েছে সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো। এর বেশিরভাগ পরামর্শ-প্রস্তাবই ইসির এখতিয়ার বহির্ভূত বলে দাবি করেছেন কমিশনের কর্মকর্তারা। এছাড়া দলগুলোর পক্ষ থেকে পরস্পর বিরোধী প্রস্তাবও এসেছে। এই প্রসঙ্গে নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, কমিশনের দায়িত্ব হলো দলগুলোর স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রস্তাবগুলোর সমন্বয় করা। এরপর এসব পরামর্শ-প্রস্তাবকে অভিন্ন প্রস্তাবে পরিণত করে তা বাস্তবায়নের পথে যাওয়া। ইসির এখতিয়ার বহির্ভূত বলে কোনও প্রস্তাবকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাদের মতে, কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা। এজন্য প্রয়োজনীয় সব কাজই ইসিকেই সম্পন্ন করতে হবে। তাদের এখতিয়ারের বাইরে কিছু থাকলে সেটা করিয়ে নিতে সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এর কোনও বিকল্প নেই বলেও নির্বাচন বিশ্লেষকরা মনে করেন।

রাজনৈতিক দলগুলো সংলাপ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ৪০টি দল থেকে মোট ৫৯৫ দফা সুপারিশ এসেছে। এসব দফার  শতাধিক উপদফা রয়েছে। সুপারিশমালায় কালো টাকা-পেশিশক্তি বন্ধ ও নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতার যথাযথ প্রয়োগসহ কিছু প্রস্তাবনা সবগুলো দল থেকেই এসেছে। কিছু প্রস্তাবনা এসেছে অর্ধেক-সংখ্যক বা তার বেশি দল থেকে। এভাবে ঘুরেফিরে সব দলের প্রস্তাবেই মোটামুটি ৫০টি মৌলিক পরামর্শের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে।

এদিকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জোটভুক্ত রাজনৈতিক দল থেকে পরস্পরবিরোধী প্রস্তাব এসেছে। একটি জোটের শরিক দল থেকে যে প্রস্তাবগুলোর সমর্থন করা হয়েছে, অন্য জোট থেকে ঠিক ওই প্রস্তাবগুলোর বিরোধিতা করা হয়েছে। নির্বাচনকালীন সরকার, সেনা মোতায়েন, ইভিএম ব্যবহার ও সীমানা পুনঃনির্ধারণসহ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে পরস্পরবিরোধী মত দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। বেশ কিছু প্রস্তাব এসেছে, যেগুলোর ইসির এখতিয়ারের বাইরে। তবে, কালো টাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার বন্ধ, অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা, প্রবাসীদের ভোটার করা, সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা, প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো, ইসির সক্ষমতা বৃদ্ধি ও ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা স্থাপনসহ বেশ কিছু অভিন্ন প্রস্তাবনা ছিল সংলাপে।

সংলাপের প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সেনা মোতায়েনের পক্ষে প্রস্তাব করেছে বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ ২৪টি রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে কোনও দল বলেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুরূপ, কোনও দল বলেছে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনা নিয়োগের কথা।

সেনা মোতায়েন না করার প্রস্তাব করেছে আওয়ামী লীগসহ ৮টি দল। ৫টি দল সেনা মোতায়েনের বিষয়টি ইসির সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। নির্বাচনে প্রার্থীদের মধ্যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির স্বার্থে সংসদ ভেঙে ভোট গ্রহণের দাবি করেছে ১৮টি দল। আর ৯টি দল মত দিয়েছে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচনের পক্ষে।

নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছে ১২টি রাজনৈতিক দল। আর ১০ দল ইভিএমে ভোটগ্রহণের বিপক্ষে অবস্থান জানিয়েছে। সংসদ নির্বাচনের সময় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাব করেছে জাতীয় পার্টিসহ ১২টি রাজনৈতিক দল। কোনও কোনও দল বর্তমান সংসদের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথা বলেছে। কোনও কোনও দল টেকনোক্র্যাট কোটায় বিএনপির প্রতিনিধিত্ব রাখার পক্ষে মত দিয়েছে। এদিকে বিএনপিসহ ১১টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনের সময়  নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি জানিয়েছে। নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে সেই বিষয় আওয়ামী লীগসহ কয়েকটি দল কোনও প্রস্তাবনাই দেয়নি। আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন কোন সরকারের অধীনে হবে, সেটা সংবিধান অনুযায়ী একটি মিমাংসিত বিষয়। কাজেই এখানে কোনও প্রস্তাবনার বিষয় নেই।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ ছহুল হোসাইন বাংলা ট্রিবিউন বলেন, ‘বাস্তব কারণেই ইসিকে সংলাপ করতে হয়েছে। সংলাপের কোনও বিকল্প নেই। কারণ দলগুলোর নিজেদের মধ্যতার মতপার্থক্যগুলোই সংলাপে উঠে আসে। পথ বেরিয়ে আসে মতপার্থক্যগুলো মিটিয়ে সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসার।’

এই সংলাপে সব দলের অংশগ্রহণ ও প্রস্তাবকে ইতিবাচক উল্লেখ করে মোহাম্মদ ছহুল হোসাইন বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের যত স্টেকহোল্ডার রয়েছে, এই সংলাপের মাধ্যমে তাদের নির্বাচনমুখী করা সম্ভব হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘সংলাপে পাঁচ শ’য়ের বেশি প্রস্তাব এসেছে। তবে এর সব প্রস্তাবই যে ইসিকে মানতে হবে, তা নয়। কমিশনের টার্গেট হচ্ছে, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করা। আর এই নির্বাচন করার লক্ষ্যে সংলাপে যেসব সুপারিশ এসেছে, সেগুলো পর্যালোচনা করে যেগুলো দরকার, সেগুলো আমলে নেওয়া। এক্ষেত্রে তাদের সাহস, আন্তরিকতা ও প্রজ্ঞা দেখাতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে হবে।’

নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার বহির্ভূত প্রস্তাব সম্পর্কে সাবেক কমিশনার বলেন, ‘অনেকগুলো প্রস্তাব এসেছে যেগুলোতে ইসির কোনও হাত নেই। তবে, আমার ধারণা রাজনৈতিক দলগুলো ওই কথাগুলো বলার কোনও প্ল্যাটফর্ম পাচ্ছিল না বলেই ইসির কাছে বলেছে, যেন সংশ্লিষ্টদের কাছে তাদের দাবি-দাওয়ার বিষয়টি পৌঁছানো যায়।

নির্বাচন বিশ্লেষক ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো তাদের প্রস্তাবে যার যার অবস্থান তুলে ধরেছে। নির্বাচন ইস্যুতে নিজেদের অবস্থান বর্ণনা করে সেভাবে সুপারিশ করেছে। এখন বল ইসির কোর্টে। তারা এই বল কোর্ট থেকে কতটুকু নিতে পারবে বা কতটুকু পারবে না, তা তাদেরই ঠিক করতে হবে।’

প্রতিটি দল নিজ নিজ স্বার্থের জায়গা থেকে কী চায়, তা ইসিকে জানিয়েছে উল্লেখ করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল যেসব ইস্যুতে একমত হয়েছে, সেগুলোকে কমিশন আমলে নিয়ে সেই অনুযায়ী নিয়ম-কানুন ঠিক করতে পারলেই বোঝা যাবে কাজ হচ্ছে।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের স্বার্থের অনুকূলেই প্রস্তাবগুলো দিয়েছে। যা বললে নিজেদের সুবিধা হয়, তারা তাই বলেছে। অবশ্য নিজেদের সুবিধামতো প্রস্তাব দেওয়াটাই তাদের জন্য স্বাভাবিক ছিল। কারণ তাদের লক্ষ্য হলো, ক্ষমতায় যাওয়া। তবে কাউকে ক্ষমতায় নেওয়া বা না নেওয়া নয়। নির্বাচন কমিশনের কাজ হলো, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা। সেই মানদণ্ডে যেসব প্রস্তাব এসেছে, তা বিবেচনা করতে হবে ইসিকে। অবাধ নির্বাচনের জন্য গ্রহণযোগ্য প্রস্তাবনাগুলোই তাদের বিবেচনায় নিতে হবে। বাকিগুলোকে বাদ দিতে হবে।’

কোনও প্রস্তাবকে এখতিয়ারের বহির্ভূত বলে ইসির পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, ‘কেবল নির্বাচন করাই ইসির দায়িত্ব নয়, তাদের দায়িত্ব হচ্ছে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের। এজন্য কমিশনকে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যা যা করণীয় তা করতেই হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য বিষয়গুলো বাস্তবায়নে সরকারকে প্রভাবিত করতে হবে। সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। চেষ্টার পর ব্যর্থ হলে তা জাতিকে জানাতে হবে। নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হবে কিনা, সেই সিদ্ধান্ত দরকার হলে তাদের নিতে হবে।’  

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দলগুলো প্রত্যেকের স্বার্থে প্রস্তাব দেবে, এটাই স্বাভাবিক। প্রত্যেক দলের স্বার্থগুলো একটি কমন জায়গায় আনা হলে সেটা সবার স্বার্থেই পরিণত হবে। তবে আমরা বেশকিছু প্রস্তাব পেয়েছি, যেগুলো বেশিরভাগই দলেরই অভিন্ন প্রস্তাব। এমনকি প্রধান দুই রাজনৈতিক দল থেকেও আমরা কিছু অভিন্ন প্রস্তাব পেয়েছি।’ তিনি জানান, ‘নির্বাচন কমিশন সবগুলো প্রস্তাব নিয়ে শিগগিরই বসবে। এগুলো যাচাই-বাছাই করে কমিশনের হাতে যেগুলো রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা হবে। আর কমিশনের এখতিয়ারের বাইরে যেগুলো থাকবে, সেগুলো  সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।’

/এমএনএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মর্যাদাপূর্ণ জাতীয় মজুরির দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান
মর্যাদাপূর্ণ জাতীয় মজুরির দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান
মিল্টন সমাদ্দার গ্রেফতার
মিল্টন সমাদ্দার গ্রেফতার
মে দিবসের কর্মসূচিতে এসে ‘গরমে অসুস্থ’ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু
মে দিবসের কর্মসূচিতে এসে ‘গরমে অসুস্থ’ হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু
খোলা ভোজ্যতেলে মিলছে না ভিটামিন ‘এ’, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি
খোলা ভোজ্যতেলে মিলছে না ভিটামিন ‘এ’, বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি
সর্বাধিক পঠিত
চকরিয়ার সেই সমাজসেবা কর্মকর্তা ও অফিস সহকারী বরখাস্ত
চকরিয়ার সেই সমাজসেবা কর্মকর্তা ও অফিস সহকারী বরখাস্ত
কালবৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে শিলাবৃষ্টিতে ভেঙেছে ঘরবাড়ি, ধানের ক্ষতি
কালবৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে শিলাবৃষ্টিতে ভেঙেছে ঘরবাড়ি, ধানের ক্ষতি
শিশু ঝুমুরকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ মুছলেন র‌্যাব কর্মকর্তা
শিশু ঝুমুরকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ মুছলেন র‌্যাব কর্মকর্তা
‘মানুষের কত ফ্রেন্ড, কাউকে পাশে পাইলে আমার এমন মৃত্যু হইতো না’
‘মানুষের কত ফ্রেন্ড, কাউকে পাশে পাইলে আমার এমন মৃত্যু হইতো না’
অষ্টম শ্রেণির স্কুল বাড়াতে চায় সরকার
অষ্টম শ্রেণির স্কুল বাড়াতে চায় সরকার