X
মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ঠিকঠাক চলছে কি?

রঞ্জন বসু, দিল্লি
২৯ জুলাই ২০২০, ১৮:৩৪আপডেট : ৩০ জুলাই ২০২০, ১২:০৮

বাংলাদেশ-ভারতের পতাকা

‘রক সলিড’। ‘রক্তের রাখিবন্ধনে আবদ্ধ’।

বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ককে বর্ণনা করতে গিয়ে মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে এই দুটো শব্দবন্ধ ব্যবহার করলেন বাংলাদেশের দুজন প্রভাবশালী ও সিনিয়র কেবিনেট মন্ত্রী। 

প্রথমটা বলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন, সোমবার (২৭ জুলাই) ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশে ১০টি ডিজেল লোকোমোটিভ হস্তান্তর অনুষ্ঠানে। আর দ্বিতীয় উক্তি সড়ক পরিবহন তথা সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের, যখন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলি দাশ মঙ্গলবার (২৮ জুলাই) সচিবালয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে যান। 

কিন্তু এটাই যদি বাস্তবতা হয়, তাহলে গত কিছু দিন ধরে ভারতের একশ্রেণির সংবাদমাধ্যমে যে ক্রমাগত লেখা হচ্ছে—ঢাকা ও দিল্লির সম্পর্কে শীতলতার ছায়া দেখা যাচ্ছে, তাতে কি একেবারেই কোনও সত্যতা নেই? চীনের ওপর বাংলাদেশের কথিত ক্রমবর্ধমান ‘নির্ভরতা’ আর ইমরান খানের পাকিস্তানের সঙ্গে বরফ গলার আভাসে দিল্লি কি মোটেও চিন্তিত নয়?

‘উত্তরটা আসলে একইসঙ্গে হ্যাঁ এবং না’, বলছিলেন দিল্লির জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর সাউথ এশিয়া স্টাডিজের প্রধান সঞ্জয় ভরদ্বাজ।

ড. ভরদ্বাজের কথায়, ‘ইমরান খান ঢাকায় একটা কি দুটো ফোন করলেই যে সর্বনাশ হয়ে যাবে না, সেটা ভারত খুব ভালো করেই জানে। কিন্তু তিনি যদি বাংলাদেশের মতো মুসলিম-প্রধান একটা দেশে কাশ্মির আবেগকে উসকে দিতে চান, তাহলে ভারতকে যে কূটনৈতিকভাবে তার মোকাবিলা করতে হবে, দিল্লি সে বিষয়েও সচেতন!’

‘চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্যি। অর্থনৈতিক স্বার্থে, বিনিয়োগের স্বার্থে ঢাকাকে যে বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেই হবে—এটা উপলব্ধি করার মতো বিচক্ষণতা ভারতের নেই, এটা ভাবাটাও চরম ভুল হবে’, বলছিলেন অধ্যাপক ভরদ্বাজ।

ফলে লাদাখের গালওয়ান ভ্যালিতে ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পরও বাংলাদেশ কেন ভারতের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিবৃতি দিলো না, তা নিয়ে দিল্লি ঢাকার ওপর রুষ্ট হয়ে আছে, এই ধারণাটাও একেবারেই ভুল।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব তথা মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তব বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা আসলে ঐতিহাসিক এবং সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। জম্মু ও কাশ্মিরকে এবং সেখানে যা-ই ঘটুক সেটাকে তারা চিরকাল ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলেই স্বীকৃতি দিয়েছে এবং সেই অবস্থানেই তারা অনড় আছে।’ এর মাধ্যমে যে কথাটা তিনি অনুচ্চারিত রেখেছেন তা হলো—ইমরান খান টেলিফোনে যতই কাশ্মির প্রসঙ্গ খুঁচিয়ে তুলুন না কেন, শেখ হাসিনা তাতে যে মোটেই আমল দেবেন না, ভারতের সেই ভরসা আছে পুরোমাত্রায়।   

এর পাশাপাশি দিল্লির সাউথ ব্লকে শীর্ষস্থানীয় একাধিক কর্মকর্তাও গত কয়েকদিনে এই প্রতিবেদককে বারবার বলেছেন, বাংলাদেশের বাধ্যবাধকতা ভারত খুব ভালোই বোঝে এবং সেটাকে সম্মান করে। ‘ভারত ও চীনের মধ্যে একজনকে পার্টনার হিসেবে বেছে নাও—এটা আমরা বাংলাদেশকে কখনোই বলতে পারি না। আমাদের পররাষ্ট্রনীতিও সে কথা বলে না’, দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানাচ্ছেন তারা। 

তাহলে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের বর্তমান মেয়াদে ভারতীয় প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়নে যে স্থবিরতা এসেছে বলে বলা হচ্ছে, সে কথাটা কতটা ঠিক?

এ প্রশ্নের জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিন্তু অনেকটাই দায়ী করছে কোভিড মহামারিকে। 

‘তবে লকডাউনের মধ্যেও যেভাবে রেলপথে বাংলাদেশ–ভারত বাণিজ্যের নতুন নতুন দিগন্ত খুলছে, কিংবা চট্টগ্রাম হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে জাহাজে পণ্য পাঠানোর উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়েছে, তাতে স্পষ্ট বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন কিন্তু থেমে নেই। এমনকি, দুদেশের যৌথ উদ্যোগে নির্মীয়মাণ রামপাল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কাজও কিন্তু লকডাউনে থেমে থাকেনি’, মনে করিয়ে দেন সাউথ ব্লকের এক কর্মকর্তা। 

ঢাকায় নিযুক্ত সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘গত মার্চ মাসে মুজিববর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যদি সশরীরে ঢাকায় যেতে পারতেন, তাহলে কিন্তু ভারতের এই প্রজেক্টগুলো আরও গতি পেতো। প্রধানমন্ত্রী মোদির সফর নিশ্চয়ই একটা ‘মোমেন্টাম’ যোগ করতে পারতো, যেটা কোভিডের কারণে সম্ভব হয়নি।’’

তবে মহামারিতে কয়েক মাস দেরি হলেও বাংলাদেশের মাটিতে ভারতের প্রকল্পগুলো নিয়ে বিন্দুমাত্র অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে বলেও তিনি মনে করেন না। 

সেই সঙ্গে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলছেন, ‘ঢাকায় ক্ষমতার অলিন্দে বা পাওয়ার করিডরে চীনের সমর্থনকারী একটা গোষ্ঠী বা ‘লবি’ বরাবরই ছিল, এখনও নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু তাতে ভারত ও বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিকশিত হতে কখনও অসুবিধা হয়নি, আমি নিশ্চিত এখনও হবে না!’

কিন্তু তাহলে কি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে একেবারেই কোনও অস্বস্তির উপাদান নেই? 

ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মুচকুন্দ দুবের মতে, ‘অবশ্যই আছে। আর সেটা হলো ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের প্রতি রাষ্ট্রের ব্যবহার।’ বর্ষীয়ান এই সাবেক কূটনীতিবিদ ঢাকায় আশির দশকে ভারতীয় হাইকমিশনার ছিলেন। এখনও তিনি প্রায়শই বাংলাদেশে যান ও সেখানকার নানা শ্রেণির লোকজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশাও করেন।

‘বাংলাদেশে সবার সঙ্গে কথা বলে আমি যেটা বুঝেছি, তা হলো ভারতে মুসলিমদের কেন বিফ খাওয়ার জন্য পিটিয়ে মারা হবে এবং শুধু মুসলিম হওয়ার অপরাধে কেন একদল মানুষ বঞ্চনা ও নিপীড়নের শিকার হবে—এটা তাদের ক্ষুব্ধ ও হতাশ করে’, বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন মুচকুন্দ দুবে। 

সে দেশে ভারতকে যারা ধর্মনিরপেক্ষতার আলোকবর্তিকা হিসেবে দেখতেন, তাদের জন্য এই বাস্তবতা মেনে নেওয়া হৃদয়বিদারক হয়ে ওঠে বলেও তার পর্যবেক্ষণ! আসামের এনআরসি বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরির প্রক্রিয়া এবং গত বছর পাস হওয়া ভারতের নাগরিকত্ব আইন সেই পরিস্থিতিকেই আরও জটিল করে তুলেছে নিঃসন্দেহে।

এই পটভূমিতেই আগামী সপ্তাহে ৫ আগস্ট মহাধুমধামে ভারতের অযোধ্যায় সুবিশাল রামমন্দিরের ভূমিপূজা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। অর্থাৎ তিন দশক আগে ভেঙে ফেলা বাবরি মসজিদের জায়গায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এখন যে রামমন্দির তৈরি হবে, তারই নির্মাণকাজ শুরু হতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও সে অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।    

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন এ সপ্তাহেই ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, রামমন্দিরের নির্মাণ দুদেশের দৃঢ় সম্পর্কে ছায়া ফেলবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন না। কিন্তু একইসঙ্গে তিনি এই সতর্কবাণীও উচ্চারণ করেছেন, ‘ভারতেরও (এই মন্দির নির্মাণ নিয়ে) এমন কিছু করা উচিত হবে না, যাতে দুদেশের গভীর সম্পর্কে চিড় ধরতে পারে।’

এর আগে গত ডিসেম্বরে ভারত নাগরিকত্ব বিল পাস করার পর ড. মোমেনই তার নির্ধারিত দিল্লি সফর স্থগিত করেছিলেন। সে সময় ভারতে আসার কথা ছিল বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানেরও। কিন্তু আসেননি তিনিও। ওই দুটো সফরের কোনোটাই আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি এবং ভারতে মুসলিমদের প্রতি বঞ্চনার প্রশ্নে ঢাকার যে একটা অভিমান বা অনুযোগ রয়েই গেছে, সেটাও গোপন নেই। 

ফলে অস্বস্তি বলতে সেটুকুই। কিন্তু মূল বাস্তবতা তার চেয়ে অনেক বড়।

‘ইমরান খান কয়েক মিনিট কথা বললেই বাংলাদেশের কাশ্মির নীতি বদলে যাবে—এটা যেমন আমরা বিশ্বাস করি না, তেমনি বাংলাদেশ গালওয়ান নিয়ে বিবৃতি দিলো না বলেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ভেঙে পড়বে, এটাও একেবারেই হাস্যকর ভাবনা। আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক শক্ত ভিতের ওপরই দাঁড়িয়ে আছে। আর আগামী বছর মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীতে দেখবেন তা আরও জোরালো হবে’, গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে এ কথা বলেছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা।

/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
টেকনাফে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
টেকনাফে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
ঝড়ে গাছ ভেঙে পড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বন্ধ ছিল এক ঘণ্টা
ঝড়ে গাছ ভেঙে পড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বন্ধ ছিল এক ঘণ্টা
‘স্বাভাবিক পরিবেশে বাঁচতে প্রত্যেককে গাছ রোপণ করতে হবে’
‘স্বাভাবিক পরিবেশে বাঁচতে প্রত্যেককে গাছ রোপণ করতে হবে’
ভিটামিন ডি কমে গেলে কীভাবে বুঝবেন?
ভিটামিন ডি কমে গেলে কীভাবে বুঝবেন?
সর্বাধিক পঠিত
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব যার হাতে গেলো
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব যার হাতে গেলো
চাসিভ ইয়ার ঘিরে হাজার হাজার সেনা জড়ো করছে রাশিয়া
চাসিভ ইয়ার ঘিরে হাজার হাজার সেনা জড়ো করছে রাশিয়া
যেভাবে অপহরণকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে এলো স্কুলছাত্র
যেভাবে অপহরণকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে এলো স্কুলছাত্র
আজও ঝোড়ো হাওয়াসহ শিলাবৃষ্টির আভাস
আজও ঝোড়ো হাওয়াসহ শিলাবৃষ্টির আভাস
যে শিশুকে পাচারের অভিযোগে মিল্টনের বিরুদ্ধে মামলা
যে শিশুকে পাচারের অভিযোগে মিল্টনের বিরুদ্ধে মামলা