খেলোয়াড় ও ক্রীড়ানুরাগীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আমরা বিজয়ী জাতি। সবসময় এটা মাথায় রাখতে হবে। খেলার মাঠেও এটা মাথায় রাখতে হবে। যুদ্ধে জয় করেছি। খেলায়ও জয় করবো। এই চিন্তা নিয়ে সবাইকে চলতে হবে। তাহলেই সাফল্য আসবে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে।
বুধবার (৯ নভেম্বর) বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দলকে দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। সাফ উইম্যান্স চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২২-এ অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করায় প্রধানমন্ত্রী এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের শাপলা হলে অনুষ্ঠিত সংবর্ধনায় যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনসহ বিভিন্ন ক্রীড়া সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে সম্মাননা হিসেবে খেলোয়াড়দের পাঁচ লাখ ও কর্মকর্তাদের দুই লাখ টাকার চেক প্রদান করেন সরকারপ্রধান।
প্রশিক্ষণকে কখনও শিথিল করা যাবে না
মনোবল, আত্মবিশ্বাস ও প্রশিক্ষণ খেলার জন্য একান্ত দরকার উল্লেখ প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রশিক্ষণকে কখনও শিথিল করা যাবে না। যত বেশি প্রশিক্ষণ হবে, খেলাধুলায় তত বেশি উৎকর্ষ পাওয়া যাবে।
তিনি বলেন, আমরা চাই আমাদের দেশটা এগিয়ে যাক। আমাদের লক্ষ্য তৃণমূল থেকে উন্নয়ন। সরকার গঠনের পর থেকেই সেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা চাই উন্নয়নটা কেবল শহরকেন্দ্রিক নয়, গ্রাম পর্যায়েও যেন হয়। সেভাবে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চা একান্তভাবে দরকার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের ছেলেমেয়েরা যত বেশি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক চর্চার সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারবে তত বেশি আলাদা একটি মানসিকতা ও দেশপ্রেম গড়ে উঠবে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, তার দল ক্ষমতায় আসার পর খেলাধুলার উন্নয়নে বিশেষ দৃষ্টি দেয়। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল প্রথমবারের মতো আইসিসি ট্রফি পায়। বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলার যোগ্যতা অর্জন করে। ১৯৯৯ সালে বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে পরাজিত করে বিশ্বকে অবাক করে দেয়। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত আবার ক্ষমতায় এসে ক্রীড়াঙ্গনে আবারও কলঙ্কজনক অধ্যায় চলে আসে।
ছেলে ও মেয়ে ফুটবলারদের বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে সরকার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে বলেও সরকারপ্রধান এ সময়ে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, মেয়েরা এভাবে বিদেশে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারবে, এটা হয়তো কেউ ভাবেননি।
সবার জন্য ক্রীড়া, এই নীতিতে বিশ্বাসী
সবার জন্য ক্রীড়া, আমরা এই নীতিতে বিশ্বাস করি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খেলাধুলায় ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জনড, বিশেষ করে অটিস্টিক, শারীরিক বা মানসিক প্রতিবন্ধীরা পিছিয়ে থাকবে কেন। আমরা তাদেরও খেলাধুলায় উৎসাহিত করছি। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর আমরা বিশেষ অলিম্পিকে বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের পাঠাই। সেই সময় তারা বাংলাদেশের জন্য ২১টি পদক নিয়ে আসে। বিশেষ অলিম্পিকে অংশ নিয়ে তারা এ পর্যন্ত ২১৬টি স্বর্ণ, ১০৯টি রৌপ্য ও ৮৪টি ব্রোঞ্জপদক অর্জন করেছে। আমাদের প্রতিবন্ধী ক্রিকেট দলও কিন্তু ভালো করছে। তারা বিদেশে আটটি টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে সবগুলোতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
শহরে খেলাধুলার চর্চা হয় না বললেই চলে– এই মন্তব্য করে তিনি বলেন, ঢাকার বাচ্চারা তো ফ্ল্যাটের মধ্যে থেকে ফার্মের মুরগির মতো হয়ে যাচ্ছে। তারা খেলাধুলায় যেতেই চায় না। এটা হলো বাস্তব কথা। এখন তো ডিজিটাল বাংলাদেশ করে দিয়েছি। সারাক্ষণ হয় মোবাইল না হয় ট্যাব নিয়ে বসে থাকে। তাদের শারীরিক চর্চাটা হচ্ছে না। কিন্তু এটা খুবই দরকার। প্রত্যেকটি অভিভাবককে অনুরোধ করবো, অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও আপনারা বাচ্চাদের খেলাধুলার দিকে নজর দেন। তাদের নিয়ে যান। খেলতে দিন। আমাদের গার্জিয়ানদের এদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া উচিত।
যেমন খুশি তেমন সেজে একটা পুরস্কার পেয়েছিলাম
অভিভাবক-শিক্ষকদের উদ্দেশ করে শেখ হাসিনা বলেন, লেখাপড়া করবে ঠিক আছে। তার সঙ্গে সঙ্গে খেলাধুলা। আর স্কুলগুলোতে খেলাধুলার ব্যবস্থা থাকা উচিত। আমরা তো দেখেছি সবসময় স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হতো। অন্য খেলাধুলায় এক্সপার্ট না হলে স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় যেমন খুশি তেমন সেজে একটা পুরস্কার পেয়েছিলেন বলেও এসময় উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমরা খেলতাম। বেসবল খেলতাম। কামাল আমার ইমিডিয়েট ছোট ছিল। ও সেসব কাজ করতো। ওর সঙ্গে ফুটবল খেলা, সাইকেল চালানো, ব্যাডমিন্টন সবকিছুতেই অংশগ্রহণ করতাম।
ক্রিকেটে সাফল্য অক্ষুণ্ন আছে
ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের সাফল্য তুলে ধরে তিনি বলেন, আমাদের ক্রীড়াঙ্গন এখন যথেষ্ট উৎকর্ষ লাভ করছে। গত ১৪ বছরে ক্রীড়াঙ্গনের সফলতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সময় নানা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ৪৮৫টি স্বর্ণ, ৪৯৯টি রৌপ্য ও ৫৯৫টি তাম্রপদক অর্জন করেছে। ক্রিকেটে সাফল্য অক্ষুণ্ন আছে। সবদিক থেকে আমাদের সবাই যে পারে সেটা প্রমাণ হচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা তৃণমূল থেকেই খেলাধুলার ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। প্রত্যেক জেলায় জেলায় স্টেডিয়াম হয়েছে। এই স্টেডিয়াম সব খেলার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। সব ধরনের খেলাধুলার সুযোগ করে দিতে প্রত্যেক উপজেলায় মিনি স্টেডিয়াম করে দিচ্ছি।
আমাদের পরিবারে ফুটবল খেলার ঝোঁকটা বেশি
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু নিজে ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন উল্লেখ করে আগে থেকেই তাদের পরিবার খেলাধুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
বর্তমান ছেলেমেয়েদের, বিশেষ করে শহুরে ছেলেমেয়েদের খেলাধুলায় ঝোঁক না থাকার প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, আমাদের পরিবারে কিন্তু খেলাধুলা আছে। জয়ের মেয়ে ছোটবেলা থেকেই ফুটবল খেলতো। ববির ছেলে ফুটবল খেলে। ববি নিজেও খেলে। এখনও খেলে। আমাদের পরিবারে সবার মধ্যে ফুটবল খেলার ঝোঁকটা বেশি। এটা বোধহয় আমাদের দাদার থেকে আসছে।
ছেলেরা কিন্তু পারেনি, মেয়েরা পেরেছে
নারী ফুটবলের সাফল্য তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের মেয়েরা যথেষ্ট ভালো করছে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে সাফ অনূর্ধ্ব ১৮ ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০২১ সালে নারী ক্রিকেট দল টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছে। নারী ক্রিকেট দল বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে পাকিস্তানকে পরাজিত করেছে। ছেলেরা কিন্তু পারেনি। মেয়েরা পেরেছে।
এসময় প্রধানমন্ত্রী হেসে ফেলেন এবং বলেন, এখানে একটি কথা না বললেই নয়, আমাদের ছেলেরা যা পারে না, আমাদের মেয়েরা তার থেকে বেশি পারে। শুনলে আবার ছেলেরা রাগ করবে। রাগ করার কিছু নেই। ছেলেদের প্রতিযোগিতাটা একটু বেশি। প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যে অনুষ্ঠানস্থলে হাসির রোল পড়ে যায়। করতালিও হয়।
প্রত্যেকে যেন আমাদের খেলোয়াড়দের চাকরি দেয়
ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের বলবো, তারা যেন আমাদের খেলোয়াড়দের চাকরি দেয়। কাজ দেয়। প্রতিবন্ধী ও হিজড়াদের চাকরি দিলে আপনারা ট্যাক্স রিবেট পাচ্ছেন। আমি বলবো, খেলোয়াড়দের কাজ দিয়ে তাদের যেন উৎসাহিত রাখা হয়। ব্যবসায়ীরা প্রত্যেকে নিজস্ব টিম করে টুর্নামেন্টের আয়োজন করতে পারে। যত বেশি প্রতিযোগিতা হবে তত বেশি স্পোর্টসে উৎকর্ষ বাড়বে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা কয়েকজন সাবেক খেলোয়াড় ও বর্তমানে ব্যবসায়ী-রাজনীতিবিদদের প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা খেলাধুলা শেষ করে এখন টাকা পয়সার মালিক হচ্ছেন তাদের তো উচিত এদিকটা একটু বেশি করে দেখা। এ সময় কেউ কেউ হাত উঁচিয়ে সায় দেন। খেলোয়াড়রা চাকরি পেলে তাদের ঘরের চিন্তা, সংসারের চিন্তাটা দূর হয়ে যায় বলে প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেন।