X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুকন্যার সঙ্গে একবার সাক্ষাৎ চান মোহাম্মদ আলী

জামাল উদ্দিন
১৫ আগস্ট ২০১৬, ১৫:০৬আপডেট : ১৫ আগস্ট ২০১৬, ১৫:০৭

মোহাম্মদ আলী

ঘাতকের বুলেটে সপরিবারে যেদিন বঙ্গবন্ধু জীবন দিয়েছিলেন, সেই ঘাতকদের ছোড়া কামানের গোলায় আমাদেরও রক্ত ঝড়েছে, জীবন গেছে।আত্মতৃপ্তি এখানেই। ঘটনার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করতে পারলেও আজও  বিচার পাননি সেদিনের গোলায় আহত  মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী। এতো বছরেও দেখা করতে পারেননি বঙ্গবন্ধু কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। রবিবার দুপুরে বাংলা ট্রিবিউনের কাছে এমন আক্ষেপের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি।

মোহাম্মদ আলী বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে বঙ্গবন্ধুসহ নিহত হয়েছিলেন ১৭ জন। আর একইদিন ভোর সাড়ে ৫টার সময় রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শেরশাহ শূরী সড়কের ৯ নম্বর বাড়ি ও শাজাহান রোডের ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর বাড়ির মাঝামাঝি স্থানে তিনটি কামানের গোলা বিস্ফোরিত হলে নিহত হন ১৩ জন। আহত হন আরও ২৮ জন। কামানের গোলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় শেরশাহ শূরী রোডের ৮, ৬ ও ২০ নম্বর বাড়ি ও শাজাহান রোডের ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর বাড়ি । শেরশাহ শূরী রোডে মারা যান ১০ জন। শাজাহান রোডে মারা যান আরও ৩ জন।

রবিবার দুপুরে টাউন হলে কথা হয় মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে। ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ৮ নম্বর বাড়িটি ছিল তাদের। ঘটনার সময় সেটা ছিল টিনশেডের। পরে সেটা বিক্রি করে দেন। বাঁশের বেড়া ভেদ করে স্প্লিন্টারের আঘাতে আহত হয়েছিলেন তিনিসহ তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য। তিনি বলেন, গোলার বিকট আওয়াজে ঘুম ভাঙে। পায়ে কিছু একটার আঘাত পেলাম। দেখি রক্ত ঝরছে। গামছা দিয়ে বেঁধে ঘর থেকে দ্রুত বের হয়ে দেখি, পাশের ৯ নম্বর বাড়ি একেবারেই ধ্বংস হয়ে গেছে। ওই বাড়ির বাসিন্দাদের রক্ত, মাংস ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে।

মোহাম্মদ আলী আরও বলেন, ওই বাড়িতেই থাকতেন মৃত্তিকা জরিপ পরিদফতরের কর্মচারী হাবিবুর রহমান। সম্ভবত অফিসে যেতে সাইকেল নিয়ে বেড় হয়েছিলেন। উঠোনেই সাইকেলসহ তার ছিন্নভিন্ন দেহটা পড়ে আছে। ১৩ মাস বয়সী শিশু নাসিমাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিলেন মুসার স্ত্রী রিজিয়া বেগম। গোলার আঘাতে শিশুটি মায়ের বুকেই লেপটে থাকে। রিজিয়ার মাথার খুলি উড়ে যায়। স্থানীয়দের সহায়তায় ঠেলাগাড়িতে তুলে নিয়ে যাই নিকটবর্তী সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। এক নার্স আমাকে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে ছেড়ে দিলেন। অন্যদের ভর্তি করে নিলেন।

মোহাম্মদ আলী বলেন, হাসপাতাল থেকে ফিরে মোহাম্মদপুর থানায় যাই। আবদুর রব নামের এক ওসি ছিলেন তখন। গিয়ে তাকে বিষয়টি জানালাম। মামলা দিতে চাইলাম। কিন্তু তিনি মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানালেন। বললেন, দেশে কী হচ্ছে জানিনা। আপনারা যে যার মতো লাশগুলো যার যার ধর্মমতে সৎকার করে ফেলেন। পরে পাশের জামে মসজিদ কবরস্থানে নিহতদের দাফন করলাম।

মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী আরও বলেন, ঘটনার আকস্মিকতায় কোত্থেকে এ গোলা আসল কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলামনা। ভোর ৬টার দিকে যখন রেডিওতে মেজর ডালিমের স্বকণ্ঠে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ঘোষণা শুনতে পাই, তখন বুঝলাম দেশে কী হতে যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর সেনাবাহিনীর লোকজন সাদা পোশাকে আনাগোনা শুরু করলে ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাই।স্বজন হারিয়েও পরবর্তী কয়েক বছর ফেরারি হয়ে ঘুরে বেড়াই। কোথাও বলারও সাহস করিনি আমার বাড়িতে কামানের গোলা পড়েছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ইনডেমনিটি আইন বাতিল করলে থানায় মামলা করলাম।

মোহাম্মদ আলী বলেন, ১৯৯৬ সালের ২৯ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় মামলা দায়েরের পরও ২০ বছর পার হতে চলেছে। বাদী হিসেবে তিনি আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন প্রায় এক বছর আগে। এরইমধ্যে মামলার সাক্ষীদের মধ্যে আট থেকে ১০ জন মারা গেছেন। কারও কাছ থেকে কোনও সহযোগিতা পাইনি। মামলা দায়েরের পর সরকারের পক্ষ থেকে ১৩ জনের জন্য ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। সর্বসাকুল্যে এটাই সরকারের তরফ থেকে সহযোগিতা। এই মামলা চালাতে গিয়ে লাখ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।

মোহাম্মদ আলী বলেন, বিভিন্ন মাধ্যমে অনেক চেষ্টা করেছি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। সম্ভব হয়নি।  এতো বছরেও বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সামনা সামনি স্বজন হারানোর কষ্টের কথা বলতে পারিনি। তাকেই যদি বলতে না পারি, তাহলে আর কে শুনবে আমাদের কষ্টের কথা। মোহাম্মদ আলীর একটাই দাবী ঘাতকদের হাতে মোহাম্মদপুরে যারা হতাহত হয়েছিলেন, তাদের স্বজনদের পুনর্বাসন করা হোক। 

গোলা বিস্ফোরণে আহত হয়েছিলেন মোহাম্মদ আলীর মামা আবদুর রব মাস্টার। তিনি এখনও শেরশাহ শূরী রোডের বাসাতেই থাকেন। তিনি বলেন, আহতদের অনেকে এখনও তাদের কাছে আসেন। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কিছুই করা হয়নি।

গোলার আঘাতে মোহাম্মদপুরে নিহতরা হচ্ছেন, রিজিয়া বেগম ও তার শিশু কন্যা নাসিমা, হাবিবুর রহমান, মনোয়ারা বেগম, ময়ফুল বিবি, সাবেরা বেগম, আনোয়ারা বেগম, আবদুল্লাহ, সাহাব উদ্দিন আহমেদ, আমিন উদ্দিন আহমেদ, কাশেদা খাতুন, শাফিয়া খাতুন ও মফিজুল। আহত হয়েছিলেন আরও ২৮ জন।

এই ঘটনায় ১৯৯৬ সালের ২৯ নভেম্বর মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটি তদন্ত করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। প্রায় সাড়ে চার বছর তদন্ত শেষে ২০০১ সালের এপ্রিল মাসে ১৮ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। অভিযোগপত্রের  ১৮ আসামির মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে ২০১০ সালে। তারা হলেন মৃত্যুণ্ডপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মহিউদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও মেজর (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ।

এ মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবি এ বি এম বসির উদ্দিন ভুঁইয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মামলাটি বর্তমানে ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। ৫৪ জন সাক্ষীর মধ্যে এ পর্যন্ত বাদীসহ ১৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে। সাক্ষী না পাওয়ার কারণেই এ মামলার কার্যক্রম বিলম্বিত হচ্ছে। অনেক সাক্ষীকেই খুঁজে খুঁজে আনা হয়েছে। অনেকের ঠিকানা বদলে যাওয়ায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। এ জন্য পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে অবহিত করা হয়েছে।

আইনজীবী বসির উদ্দিন বলেন, মামলাটির পরবর্তী কার্যদিবস আগামী ৬ অক্টোবর। কিন্তু এ আদালতে গত আড়াইমাস ধরে  বিচারক নাই।এতে মামলার বিচার কার্যক্রমও বিঘ্নিত হচ্ছে।

আরও পড়ুন: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: লন্ডনে ষড়যন্ত্রের খেলায় মেতেছিলেন জিয়াউর রহমান!

জেইউ/এপিএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে ভিত্তিহীন তথ্য রয়েছে
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিমার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে ভিত্তিহীন তথ্য রয়েছে
পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে হাজার কোটি টাকার কাজ চলছে: প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল
পার্বত্য এলাকার উন্নয়নে হাজার কোটি টাকার কাজ চলছে: প্রতিমন্ত্রী কুজেন্দ্র লাল
‘আশ্রয়ণ’: গ্রামীণ বসতি রূপান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়
‘আশ্রয়ণ’: গ্রামীণ বসতি রূপান্তরের প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়
ছক্কা মেরেও আউট হলেন মুশফিক !
ছক্কা মেরেও আউট হলেন মুশফিক !
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা