X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

ভেতরে আর্তচিৎকার, বাইরে মায়েদের প্রশ্ন: দেশটার হলো কী?

উদিসা ইসলাম
০২ নভেম্বর ২০১৬, ১০:৪২আপডেট : ০২ নভেম্বর ২০১৬, ১৫:১৫

ওসিসির বাইরে এক মায়ের অপেক্ষা

‘মেয়ের পুরা কথা ফোটেনি এখনও। সেই মেয়ের চোখের দিকে আজ ‍ দুদিন  ধরে তাকানো যায় না। ভয়ে এতটুকু করে রেখেছে মুখটা, মাগো। এই মেয়েরে আমি কী করে ভয় কাটায়ে বাসায় নিয়ে যাব। আমার মেয়ের এই বয়সে যা হলো, তা কেউ ভুলায়ে দিতে পারবে না। এ মেয়েরে সমাজ নেবে না।’ কথাগুলো বলছিলেন শ্রীপুরের এক গ্রামের চার বছর বয়সী এক মেয়ে শিশুর মা। শিশুটি যৌন হয়রানির শিকার হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) চিকিৎসাধীন। ঠিক যতটা ফিসফিস করে কাঁদলে কেবল পাশের জন শুনতে পায়, সেটুকু শব্দ করে ওসিসির বাইরে বসে কাঁদছেন এই মা।

ওসিসির সামনে বসে নির্যাতনের শিকার শিশুদের অভিভাবকদের উদ্বিগ্ন চেহারা দেখা যায় প্রতিনিয়ত। সংরক্ষিত এই এলাকায় পুরুষের প্রবেশ নিষেধ থাকায় ভেতরে বসে একা মা বা বাড়ির অন্য নারীরা নিজেদের মধ্যে কথা বলেন।কষ্ট ভাগাভাগি করেন।সবার মধ্যেই মেয়ের সমাজে ফেরার বিষয় নিয়ে শঙ্কা। মাথা উঁচু করে বাঁচার পথ খুঁজছেন শত প্রশ্ন নিয়ে।

শ্রীপুরের এই চার বছরের মেয়েশিশুর সঙ্গে কী ঘটেছিল প্রশ্নে আরেকটু স্বর নামিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘দ্যাশে কী হইসে বলেনতো। এত টুকু মাইয়াদেরও ছাড়ে না বদগুলা। এরা আসলে চায় কী। চার বছরের বাচ্চার কাছে কী চায় ?’ মায়ের এ প্রশ্নের উত্তর মেলে না। আবার বলেন, ‘আমার মেয়ে সন্ধ্যার সময় উঠানে ছিল। টিভি দেখার কথা বলে ডেকে নিয়ে গেছে। ফিরে এসে কিছু বলতে পারে না। কেবল বলে, ভয় দিয়েছে। কে ভয় দিয়েছে জিজ্ঞেস করতে পাশের বাসার ২৫ বছর বয়সী গার্মেন্টকর্মীর কথা বলে। চার বছরের মেয়ে বুঝিয়ে বলতেও পারে না। খালি সারা শরীর কাঁপে।’ কথাগুলো বলতে বলতে এই মা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে সম্বিত হারান। গায়ে হাত দিয়ে ডাক দিতেই সম্বিত ফিরে বলেন, ‘মেয়েটা ভয় পাইসে আপা।’

দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ধর্ষণের শিকার পাঁচ বছরের শিশুর মা গত ছয়দিন ধরে নিরলস প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত। কী হয়েছিল মেয়ের। তার প্রশ্ন কি কেউ শোনে, বলে তিনি জানতে চান, ‘আমার মেয়ে যদি আমাকে প্রশ্ন করে, তারে নিরাপত্তা দিয়ে রাখতে পারিনি কেন,সে প্রশ্নের উত্তর কি দেবো? আমিতো আগলে রাখছিলাম। পাশের মানুষদেরও কি বিশ্বাস করবো না? তাহলে আর আমরা মানুষ দাবি করি কেন নিজেদের।’

পূজার মায়ের কাছে সবাই জানতে চেয়েছেন তিনি বিচার চান কিনা। তার মেয়ের ঠিক কি ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।পূজার মা এখন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে মেয়ের সুস্থতা কামনা করছেন। তিনি উল্টো অনেক প্রশ্ন নিয়ে ঘুরছেন, ‘এমন কোনও পরিবার আছে, যারা আমার মেয়ের এই কাটাছেঁড়া শরীরকে আপন করে নেবে। তার ওপর আমরাতো সংখ্যালঘু হিন্দু।’ চোখ চলে যায় মেয়েটির মায়ের চোখের দিকে। সে চোখ কাউকে আর বিশ্বাস করে না।

কথা হয় ধর্ষণের শিকার আরেক ১২ বছরের কিশোরীর মায়ের সঙ্গে। চোখে ক্ষোভ। তিনি বলেন, ‘আমার জীবনের দাম দিয়েওতো মেয়ের জীবন তৈরি করতে পারবো না।যেসব মানুষের মুখে শুরুর দিকে সহানুভূতি পাওয়া যায়, ওই মানুষগুলোই কি আমার মেয়েকে ঘরে নেবে? কোনও ঘটনা ঘটলেই শুরু হয়ে যায় তাদের নাম ঠিকানা প্রকাশ করা। আপনাদের চাকরি বাঁচে, আমার মেয়ে তো হারায়ে যায়। এই মেয়ের নাম ঠিকানা জানার পর কে তারে সমাজে নেবে।’

ভেতরে আর্তচিৎকার, বাইরে মায়েদের প্রশ্ন: দেশটার হলো কী?

মামলা করেন নাই কেন প্রশ্নে মেয়ের ধর্ষণের শিকার হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মেয়ে আমার কেবল জীবন শুরু করল। সে এখনও দিন দুনিয়া চেনে নাই। সে কেন মানুষের প্রশ্নের মুখে পড়বে?’

মেয়ের শরীরের নানা কালসিটে পড়া জায়গা দেখিয়ে দেখিয়ে মায়ের কান্না আর থামে না। সাভারের জাহাঙ্গীরনগরের এই মা মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন পাত্রপাত্রীর নিজেদের পছন্দেই। বিয়ের তিনবছর পার হওয়ার পর শুরু হয় মারধর। যৌতুকের জন্য হয়রানি। এই মায়ের প্রশ্ন, ‘আমার মেয়েকে পছন্দ করে বিয়ে করলে যৌতুক দিতে হবে কেন? তারপরও দিয়েছি, যা পেরেছি বাপ মরা মেয়েটারে দিয়েছি। তাও মারে।’ তিনবছর ধরে মারে, নাকি নতুন নির্যাতন শুরু করেছে প্রশ্নে এই নির্যাতনের শিকার নারী বলেন, ‘বরাবরই মারে। পরিবারের সবাই মিলেই মারে। আমি চুপ করে থাকছি।’

ঢামেক এর ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের সমন্বয়ক ডা. বিলকিস বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখন হঠাৎ করেই নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে গেছে। এবং বীভৎসতাও বেড়েছে। এত ছোট শিশুদের যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো সাধারণত বাবা মা প্রকাশ না করার কারণে জানা যায় না। আর প্রকাশ পেলেও সেটা নিয়ে খুব বেশি আইনি লড়াইয়ে উৎসাহিত থাকে না। কারণ, শিশুর ভবিষ্যত তাদের চিন্তিত করে তোলে।’

/এপিএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সম্পূর্ণ দুর্ভিক্ষের কবলে উত্তর গাজা: ডব্লিউএফপি প্রধান
সম্পূর্ণ দুর্ভিক্ষের কবলে উত্তর গাজা: ডব্লিউএফপি প্রধান
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীর মুখেই কুলুপ
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীর মুখেই কুলুপ
চিনি-লবণ মিশিয়ে নকল প্যাকেটে স্যালাইন তৈরি, গ্রেফতার ৩
চিনি-লবণ মিশিয়ে নকল প্যাকেটে স্যালাইন তৈরি, গ্রেফতার ৩
জিকোর কপালে গভীর ক্ষত, সার্জারির পর হাসপাতালে ভর্তি 
জিকোর কপালে গভীর ক্ষত, সার্জারির পর হাসপাতালে ভর্তি 
সর্বাধিক পঠিত
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
মিল্টনের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতদের এখন কী হবে
মিল্টনের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতদের এখন কী হবে
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
বিসিএসে সফলতায় এগিয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা
বিসিএসে সফলতায় এগিয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা
চট্টগ্রামে যান চলাচলের জন্য প্রস্তুত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
চট্টগ্রামে যান চলাচলের জন্য প্রস্তুত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে