‘গোবিন্দগঞ্জ থেকে ঢাকায় ফিরছি। প্রায় ২শ’ পরিবার না খেয়ে আছে। কাপড় নেই, ছাদ নেই। অনেক শিশু দেখলাম। গত সোমবারের পুলিশের উপস্থিতিতে হামলার পরই শেষ না। পুলিশের নিপীড়ন অব্যাহত আছে। জরুরি সাহায্য দরকার, আমরা সামান্য সাহায্য করেছি। সরকারের তরফ থেকে কিছুই দেওয়া হয়নি। এমপি মিডিয়ার সামনে কিছু লোককে ক্ষতিগ্রস্ত দেখিয়ে চাল বিতরণের ছবি ছাপিয়েছে।’
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জের সাঁওতাল অধ্যুষিত মাদারপুর গ্রামে পুলিশ ও সন্ত্রাসী হামলার শিকার অধিবাসীদের সাথে সাক্ষাত শেষে ঢাকায় ফেরার পথে কথাগুলো বলছিলেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।
বুধবার ঢাকা থেকে আটজনের একটি দল ঢাকা থেকে গিয়েছিলেন মাদারপুরগ্রামের অসহায় পরিবারগুলো এবং সেই এলাকার পরিস্থিতি দেখতে। গত ৬ নভেম্বর সন্ধ্যায় পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল গ্রামটি। পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করার সময় পুলিশের গুলিতে আহত সাঁওতাল শ্যামল হেমব্রম নিহত হন, আহত হন আরও চারজন। স্থানীয়দের অভিযোগ, এতেই ক্ষান্ত হয়নি এলাকার ক্ষমতাবানরা। পরদিন সকালে চালিয়েছে লুটপাট। অধিবাসীদের দাবি, ঘরের চালের টিন, হাঁড়ি-পাতিল, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি, জামাকাপড় কিছুই বাদ যায়নি।
এই পরিস্থিতিতে উচ্ছেদের নামে সাঁওতালদের ওপর হামলার পরিস্থিতি পরিদর্শনে ঢাকা থেকে যাওয়া মানবাধিকার ও সংস্কৃতিকর্মীদের দলটিতে ছিলেন ড. স্বপন আদনান, জাকির হোসেন, হাসনাত কাইয়ুম, জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ফিরোজ আহমেদ, অরুপ রাহী, মোশাহিদা সুলতানা ও রেজাউর রহমান। বুধবার ফেরার পথে জানিয়েছেন কী ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে আছে প্রায় ২শ’ পরিবার সাঁওতাল। মানবিক বিপর্যয় উল্লেখ করে তারা বলেন, শিশুদের নিয়ে খোলা ছাদের নিচে পরিবারগুলো বসবাস করছে শঙ্কা নিয়ে। ইতোমধ্যে জনপ্রতিনিধিরা সহায়তা দেওয়ার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও আসলে সেটি ছিল গণমাধ্যমের সামনে একধরনের ‘আইওয়াশ’।
দলে থাকা সংস্কৃতিকর্মী অরূপ রাহী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যেখানে দুইদিন আগে ঘর পুড়িয়েছে সেখানে লাঙল দিয়ে চাষ শুরু করেছে। গুলিবিদ্ধ দুইজনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাখার সময় হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়েছে।
তারা বলেন, মাদারপুর গ্রাম থেকে রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ আখ খামারসংলগ্ন উচ্ছেদ করা জমিতে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে পুলিশি পাহারা রয়েছে। রবিবার সাঁওতালদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ফেলার জায়গায় হালচাষ করার চিহ্ন, চিনিকলের ট্রাক্টর দিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে পুড়ে যাওয়ার দাগ।
যদিও চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল আউয়াল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যে ধরনের অভিযোগ করা হচ্ছে তা সত্য নয়। কেবল আইনি প্রক্রিয়ায় চিনিকলের জমি দখলমুক্ত করতে চেষ্টা করা হয়েছে। ওখানে কারোর বসতভিটা ছিল না। একচালা ঘর। সাঁওতালদের বাড়িতে লুটপাট বিষয়ে আমরা কিছু জানি না।
উল্লেখ্য, রংপুর চিনিকলের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের এক হাজার ৮৪২ একর জমির মালিকানা নিয়ে স্থানীয় আদিবাসীদের সঙ্গে চিনিকল কর্তৃপক্ষের দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। রবিবার সকালে ইক্ষু খামারের শ্রমিক-কর্মচারীরা পুলিশ পাহারায় বাগদাকাটা সংলগ্ন এলাকায় আখ কাটতে গেলে সেখানে থাকা সাঁওতালরা বাধা দেয়। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ার ঘটনাও ঘটে।
এ ঘটনায় পুলিশ ও স্থানীয় সাওতালরা পরস্পরকে দায়ী করে অভিযোগ তুলে ধরে। পুলিশের দাবি, সাঁওতালদের ছোড়া তীরে ৯ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। সাঁওতালদের দাবি, পুলিশের গুলিতে চারজন সাঁওতাল গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এলাকাবাসীর দাবি, চিনিকল কর্তৃপক্ষ জমি অধিগ্রহণের সময় জমির মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করে, কখনোজমিতে আখ ছাড়া অন্য কিছু চাষ হলে তা প্রকৃত মালিকদের জমি ফেরত দেওয়া হবে। কিছুদিন ধরে ওই সব জমিতে ধান ও তামাক চাষ হচ্ছে। অথচ জমি ফেরত দেওয়া হয়নি। সাঁওতালরা এসব জমি ফেরত চায়।
/এইচকে/