২০১১ সালে হাশেম খানের নেতৃত্বে ২০ জন শিল্পীর একটি দল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যবইয়ের অলংকরণের কাজ করেন। সেই একই অলংকরণ বছরের পর বছর কপি-পেস্ট করে ব্যবহার করা হচ্ছে পাঠ্যপুস্তকে। ছবি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কাগজ বা রঙ তো বটেই, টেক্সটের ভেতর কোথায় বসবে তা বিবেচনা করা হচ্ছে না। এতে বইয়ের অলংকরণ কোথাও কোথাও অপ্রাসঙ্গিকও হয়ে পড়েছে। সব মিলিয়ে বই অলংকরণের বিষয়টি ‘ফালতু’ হয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন শিল্পী হাশেম খান। তবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) দাবি করছে, তাদের অলংকরণই বিশ্বসেরা।
যথেচ্ছভাবে বইয়ে ছবির ব্যবহার প্রসঙ্গে হাশেম খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ছবির রঙ, কোন কাগজে ছাপা হচ্ছে ও কোথায় ব্যবহার হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করবে ছবিটা দেখতে কেমন লাগবে। কিন্তু এসবের ধার ধারে না এনসিটিবি।’
ছাগলের গাছে চড়ে আম খাওয়া, বিদেশি কার্টুন দেখে বিকৃত আকৃতির ভ্রমর— এমন সব ছবি স্থান পেয়েছে পাঠ্যপুস্তকে। যবের বোঝা নিয়ে কৃষকের হেঁটে যাওয়ার ছবিতে যবের যে রঙ দেওয়া হয়েছে তা বাস্তবসম্মত নয়। বইয়ের বিভিন্ন পৃষ্ঠায় অপ্রয়োজনীয় ছবিও রয়েছে অনেক। এগুলো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় উল্লেখ করে হাশেম খান বলেন, ‘আর্ট কলেজে পড়লেই কেউ অলঙ্করণ বা ইলাস্ট্রেশন করতে পারবে, বিষয়টি এমন নয়। এটি আলাদা একটি বিষয় হিসেবেই পড়তে হয়। এই অলংকরণ করতে সাহিত্যপ্রীতিও থাকতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হয় না।’
প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের বইয়ে অলংকরণ নিয়ে এত সমালোচনা সত্ত্বেও এনসিটিবি’র সদস্য ড. মোহাম্মদ আবদুল মান্নান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের বইয়ের অলংকরণ ওয়ার্ল্ড বেস্ট। কাজটি হাশেম খানেরই করা।’
নতুন ছাপা পাঠ্যপুস্তকগুলো হাশেম খান দেখেননি বলে জানান। এসব বইয়ের কোনও কোনোটিতে শিল্প সম্পাদনা ও চিত্রাঙ্কণে তার নাম রয়েছে জানালে তিনি বলেন, ‘২০১১ সালে পাঠ্যপুস্তকের ছবি বা অলংকরণ সংস্কারের কথা উঠেছিল। ওই সময় অধ্যাপক কফিলউদ্দিন বিষয়টি সমন্বয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তিনিই আমাকে নতুন করে সংস্কার করে দিতে বলেন। জাতীয় কাজ বিবেচনায় আমি ২০ জনের শিল্পীর দল তৈরি করি। তাদের নিয়ে দুই-তিন দিনের কর্মশালা করে তারপর তাদের দিয়ে অলঙ্করণের কাজটি করি। প্রায় তিন মাস কাজ করেছিলাম আমরা।’
পাঁচ বছর আগের অলংকরণ বছরের পর বছর কপি-পেস্ট করে ব্যবহার করা যায় কিনা জানতে চাইলে হাশেম খান বলেন, ‘এটা অসম্ভব। প্রতিবছর এই কাজ নতুন করে করতে হবে।’
ওই অলংকরণের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিল্পীরা অভিযোগ করেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ওরা আমাকে জানিয়েছে, ড্রয়িং নষ্ট করা হয়েছে। রঙ ইচ্ছা মতো ব্যবহার করেছে। এটা আমাদের আঁকা ছবি কিনা সেটা বোঝার কোনও উপায় নেই।’
এনসিটিবি’র সমালোচনা করে তিনি আরও বলেন, ‘প্রেস কেমন হবে, কী কাগজে ছাপা হবে, কয় রঙে ছাপা হবে— এসবের সমন্বয় দরকার। ছবি মেশিনে কিভাবে আসবে সেটারও মনিটরিং দরকার। পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সেই সক্ষমতা নেই। দুজন শিল্পী খুবই নিম্নপদে আছেন। তাদেরও তেমন কোনও দায়িত্ব দেয় না।’
এ নিয়ে বিরক্ত হাশেম খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ছবি জিনিসটাকে ফালতু বানিয়ে ফেলেছে এরা। এখন আমাকে চিঠি দিয়ে কিংবা মামলা করে তাদের ইচ্ছা মতো ছবির পুণর্মুদ্রণ বন্ধ করতে হবে।’
এ ধরনের ভুলগুলো এড়াতে করণীয় কী— জানতে চাইলে শিল্পী বলেন, ‘বোর্ডে যারা আছেন তাদের গ্রাফিক ডিজাইন, কাগজ, মুদ্রণ, রঙ সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই। গত ৪০ বছর ধরে বিভিন্ন সময় এনসিটিবিতে শক্তিশালী গ্রাফিক ডিজাইনিং বিভাগ খোলার কথা বলেছি। বলেছি শিল্পীর দায়িত্বে এমন একজন রাখার কথা যিনি এসব বোঝেন। সে কথায় গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।’
পাঠ্যবইয়ের অলংকরণে বৈশ্বিক উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘সারাবিশ্বে কেবল পাঠ্যবই নয়, প্রাথমিক পর্যায়ের সব বইয়ের লেখক দুজন। তাদের একজন লেখেন, আরেকজন আঁকেন। শিশুসাহিত্যে দুই বছর পরপর কনভেনশন করে পুরস্কার দেয় ইন্টারন্যাশনাল বোর্ড অব বুক ফর ইয়ং পিপল। এটা শিশুসাহিত্যের নোবেল। বাংলাদেশ আজও সেটার মেম্বার নয়।’
এনসিটিবিকে ছবি এঁকে দিলেও প্রতিবার বই ছাপানোর সময় ছবির ব্যবহার সংস্কার করতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। হাশেম খান বলেন, ‘বোর্ড এটা যত তাড়াতাড়ি শিখবে, তত দ্রুত মানহীন বই বের হওয়া বন্ধ হবে।’
আরও পড়ুন-
প্রাথমিক ও নিম্নমাধ্যমিকের পাঠ্যবইয়ে ভুল বানান ও বিকৃতির ছড়াছড়ি
লিঙ্গ বৈষম্য শেখানোর পাঠ্যপুস্তক
/টিআর/এসটি/