X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

ত্রাণে কাটছে না খাদ্য সংকট

বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট
২৬ আগস্ট ২০১৭, ০১:০০আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০১৭, ০৯:৪৫

এক মৌসুমে টানা দু’বার ঘন বর্ষা ও ভয়াল বন্যায় ভেসে গেছে দেশের উত্তর, মধ্য ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ২২টিরও বেশি জেলা। তাৎক্ষণিক উদ্যোগে বন্যা পরিস্থিতি আপাত মোকাবিলা করা সম্ভব হলেও দুর্গতদের সংকট কাটছে না। এদিকে শুরু হয়েছে ত্রাণ নিয়ে ত্রাহি অবস্থা। প্রশাসনের দাবি, পর্যাপ্ত ত্রাণ আছে। কিন্তু দুর্গতরা বলেছেন, খাদ্য সংকটে ভুগছেন তারা। সরেজমিনে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সার্বিক অবস্থা নিয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন বাংলা ট্রিবিউনের জেলা প্রতিনিধিরা।

বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ (ফাইল ছবি) বন্যাদুর্গতদের দুর্ভোগ মোকাবিলায় সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে জানিয়েছেন আমাদের নীলফামারী প্রতিনিধি তৈয়ব আলী সরকার। সরেজমিনে বন্যা-পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও দুর্গতদের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানান, সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও ত্রাণের সংকট আছে বানভাসি এলাকায়।

এ ব্যাপারে সদর উপজেলার চেয়ারম্যান আবুজার রহমান বলেন, ‘আমরা মোট ৭শ’ মেট্রিকটন চাল ও ৩৪ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছি। আরও বরাদ্দের জন্য চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে।’

জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এটিএম আখতারুজ্জামানের জানান, এখন পর্যন্ত ৫শ’ ২৫ মেট্রিকটন চাল, ১৭ লাখ ৫০ হাজার নগদ টাকা ও ৬ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

ত্রাণ নিচ্ছেন এক বানভাসি নারী (ফাইল ছবি) কুড়িগ্রামের বন্যাদুর্গত গ্রামগুলোতে ত্রাণের জন্য হাহাকার রয়েছে। অনেকে বন্যার শুরুতে একবার ত্রাণ পেয়েছেন, তারপর থেকে আর কোনও সাহায্য নাই। গত ১০-১২ দিন থেকে মানবেতর জীবন যাপন করছেন সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের দোয়ালী পাড়া, চাকেন্দার পাড়া, ফারাজী পাড়া ও পাঁচগাছি ইউনিয়নের গরুহারা গ্রামের বন্যাদুর্গতরা। এমন তথ্যই জানিয়েছেন বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম।

এ ব্যাপারে যাত্রাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আইয়ুব আলী সরকার বলেন, ‘এ পর্যন্ত আমার ইউনিয়নে ৪৩ মেট্রিকটন চাল বিতরণ করা হয়েছে। বন্যার প্রথম দিকে যারা ত্রাণ সহায়তা পেয়েছিলেন তা শেষ হয়ে গিয়েছে। ফলে তারা কিছুটা খাদ্য সংকটে আছেন।’ বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষ থেকেও ত্রাণ তৎপরতা চলমান থাকায় অনেকে ত্রাণ পেলেও তা পর্যাপ্ত নয় উল্লেখ করে চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে এমন প্রায় তিন হাজার পরিবার রয়েছে যাদের দ্বিতীয় পর্যায়ে ত্রাণ দেওয়া জরুরি।’

কুড়িগ্রাম জেলায় বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির সরকারি প্রতিবেদন চেয়ারম্যান আরও জানান, বন্যার পানিতে প্রায় ৫শ’ পরিবারের বাড়িঘর লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। অনেকের ঘর ভেসে গেছে। কিন্তু এখনও কারও ঘরবাড়ি মেরামতের জন্য সহায্য করা সম্ভব হয়নি।

এ ব্যাপারে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা আমিন আল পারভেজ বলেন, ‘পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ আছে। আমরা ইতোমধ্যে কয়েকটি ইউনিয়নে দ্বিতীয় পর্যায়ে খাবার সরবরাহ করেছি। অন্যান্য ইউনিয়নেও শুরু হচ্ছে।’

বন্যায় গৃহহারাদের সহায়তার ব্যাপারে ইউএনও আরও বলেন, ‘প্রত্যেক ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রস্তুত করার জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তালিকা পেলে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের অগ্রাধিকার দিয়ে পর্যায়ক্রমে সবাইকে গৃহ নির্মাণের জন্য টিন ও নগদ অর্থ দেওয়া হবে।’

কুড়িগ্রামের বন্যা পরিস্থিতির সরকারি হিসাব

বাংলা ট্রিবিউনের জামালপুর প্রতিনিধি বিশ্বজিৎ দেব জানান, জামাপুরের বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন স্থানীয়রা। মূলত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও স্থানীয়দের স্বতঃস্ফূর্ত ত্রাণ বিতরণের কারণেই বড় ধরণের বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়েছেন বন্যাদুর্গতরা। স্থানীয়দের উদ্যোগে মোট ৮৫ হাজার পিস রুটি, ৭ হাজার ৪১ কেজি চিড়া, ৬শ’ ৩৫ কেজি মুড়ি, ১ হাজার ৩শ’ কেজি আটা, ৪২ কার্টুন বিস্কুট ও ৫ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে জামালপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) আহমেদ কবীর বলেন, ‘বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ৮শ’ ৭২ জন আশ্রিতকে ত্রাণ দেওয়া হয়েছে। ত্রাণ হিসেবে ইতোমধ্যে ২ হাজার ৩৮ মেট্রিকটন জিআর চাল, নগদ ৪ লাখ ৭০ হাজার ৫০ টাকা, ২ হাজার শুকনো খবারের প্যাকেট ও ৬ হাজার ২শ’ ৩৪ পিস রুটি বিতরণ করা হয়েছে।’

জামালপুরে বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ (ফাইল ছবি)

আমাদের নওগাঁ প্রতিনিধি আব্দুর রউফ পাভেল জানিয়েছেন, আত্রাই নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১৫টি স্থান ভেঙে ৪ লাখ ৭৯ হাজার ৪শ’ ৫৫ জন মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ইতোমধ্যে ৬শ’ ৪২ মেট্রিকটন চাল, নগদ ২৫ লাখ ৯৫ হাজার ৫শ’ টাকা ও ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। নওগাঁ জেলা  ত্রাণ ও পুনর্বাসন  কর্মকর্তা একেএম আব্দুল মান্নান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

এ ব্যাপারে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মান্দা উপজেলার প্রসাদপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে ৭শ’ মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আমরা ত্রাণ হিসেবে পেয়েছি মাত্র সাড়ে ৩ টন চাল ও ৭৫ কেজি চিড়া। যা একেবারেই অপ্রতুল।’

স্থানীয়দের উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ

তবে সরকারি সাহায্যের পাশাপাশি নওগাঁর বানভাসিদের পাশে দাঁড়িয়েছে স্থানীয় সামাজিক সংগঠন ‘একুশে পরিষদ’। নওগাঁর বিভিন্ন স্থানে ৮ দিন ধরে ত্রাণ বিতরণ করছে সংগঠনটি। সংগঠনটির  সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল বারী বলেন, ‘এবারের বন্যায় এখন পর্যন্ত অনেক এলাকায় ত্রাণ পৌঁছায়নি।’ ঈদ পর্যন্ত ত্রাণ তৎপরতা চালু রাখার দাবি জানান তিনি।

এ ব্যাপারে নওগাঁর জেলা প্রশাসক ড. আমিনুর রহমান জানান, ত্রাণের চাল ও নগদ অর্থ প্রদানের পরিমাণ বাড়ানো হবে। ইতোমধ্যে আরও ১ হাজার মেট্রিকটন চাল ও নগদ ৪০ লক্ষ টাকা বরাদ্ধ চাওয়া হয়েছে।

সুনামগঞ্জবাসীর চোখজুড়ে শ্রাবণধারা,  ত্রাণেই শেষ ভরসা খুঁজছেন তারা (ফাইল ছবি)

সুনামগঞ্জ থেকে হাওড়াঞ্চলের হালনাগাদ তথ্য জানিয়েছেন আমাদের প্রতিনিধি হিমাদ্রি শেখর ভদ্র। তিনি জানান, হাওরাঞ্চলে কিছু ত্রাণ বিতরণ হয়েছে কিন্তু মানুষের খাদ্য সংকট কাটছে না। তার ওপর বোরো ও আমন তলিয়ে যাওয়ায় সামনের দিনগুলো নিয়ে আশাহত হয়ে পড়েছে বানভাসিরা। 

জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মাহাবুবুর রহমান জানান, বন্যার্ত ৭টি উপজেলায় ৩০ টন করে মোট ২১০ টন জিআর চাল ও প্রত্যেক উপজেলায় নগদ ১ লাখ টাকা করে মোট ৭ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া দিরাইয়ে ৬০ টন চাল ও নগদ ২ লাখ ১০ হাজার টাকা, শাল্লায় নগদ ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ও ৫০ টন চাল, দক্ষিণ সুনামগঞ্জে নগদ ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা ও ৪০ টন চাল, জগন্নাথপুরে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও ৪০ টন জিআর চাল বরাদ্দ করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. হারুন অর রশিদ বলেন, ‘হাওর এলাকায় মানুষ এখন খাদ্য ও কাজের সংকটে আছেন।’

দিনাজপুরে সরকারি ত্রাণ বিতরণ (ফাইল ছবি)

তবে বন্যা-পরবর্তী পরিস্থিতির ব্যাপারে ভিন্ন তথ্য এসেছে এবারের বন্যায় অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দিনাজপুর জেলা থেকে। দিনাজপুর জেলার বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিনিধি বিপুল সরকার সানি জানান, আগাম সতর্কতা ও সময়মতো ত্রাণ বিতরণের কারণে দিনাজপুরের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছায়নি। বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণের আগেই নিজ উদ্যোগে দুর্যোগ মোকাবিলায় এগিয়ে আসেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। সেই সঙ্গে শুরু থেকেই ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রেখেছেন জেলা প্রশাসন। এছাড়া সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় ও বেসরকারি সংগঠনের উদ্যোগের কারণেই মানুষের দুর্ভোগ কমানো গেছে। 

নীলফামারীতে আমনের চারা বিতরণ করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী (ফাইল ছবি)

এ ব্যাপারে জেলা ত্রাণ ও পুর্নবাসন কর্মকর্তা মোকলেসুর রহমান বলেন, ‘দিনাজপুরে বন্যা মোকাবিলায় মোট বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৯৫ মেট্রিকটন চাল ও ৮৬ লাখ নগদ টাকা টাকা। এর মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে ১ হাজার ৫শ ৯৫ মেট্রিকটন চাল ও ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকা।

তিনি আরও জানান, দিনাজপুরে ১ লাখ ৫৬ হজার ৪শ ৭১টি পরিবার পানিবন্দি ছিল। এদের মধ্যে প্রায় ৩৫ হাজার পরিবারকে পুনর্বাসনের প্রয়োজন করবে। এ ব্যাপারে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানানো হয়। 

গাইবান্ধার দুর্গম চরে ত্রাণের হাহাকার (ফাইল ছবি) দিনাজপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ইকবালুর রহিম বলেন, ‘এমন কোনও জায়গা নাই যেখানে ত্রাণ পৌঁছায়নি, কেউ ত্রাণ পায়নি এমন কোনও অভিযোগ পাওয়া যায়নি। এ ধরণের তথ্য পেলে দ্রুত তাদের দ্রুত পুনর্বাসনের আওতায় আনার জন্য নির্দেশনা দেওয়া আছে।’

এছাড়া গাইবান্ধা প্রতিনিধিও চরাঞ্চলের বন্যাদুর্গতদের খাদ্য সংকট ও দুভোর্গের কথাই জানিয়েছেন। তার মতে, সংকট মোকাবিলায় আরও সাহায্য প্রয়োজন বলে দাবি করেছেন স্থানীয়রা।

 

 

 

/এএইচ/আপ-এসএনএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পঞ্চম বারের মতো কমলো সোনার দাম
পঞ্চম বারের মতো কমলো সোনার দাম
নেত্রীর জন্য জান দেবেন আর সিদ্ধান্ত মানবেন না, সেটা উচিত না: দীপু মনি
নেত্রীর জন্য জান দেবেন আর সিদ্ধান্ত মানবেন না, সেটা উচিত না: দীপু মনি
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই বন্ধ করতে পারে: আব্বাস
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রই বন্ধ করতে পারে: আব্বাস
টেন মিনিট স্কুলে বিকাশ পেমেন্টে ক্যাশব্যাক
টেন মিনিট স্কুলে বিকাশ পেমেন্টে ক্যাশব্যাক
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে