X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

গ্যাস বেলুন কতটা নিরাপদ?

সাদ্দিফ অভি
৩১ অক্টোবর ২০১৯, ২১:৫৩আপডেট : ০১ নভেম্বর ২০১৯, ১৬:০৭

শাহবাগে গ্যাসবেলুন বিক্রেতা ফজর আলীর দোকান, বুধবার রূপনগরে গ্যাসবেলুন সিলিন্ডার বিস্ফোরণের আগে ও পরে (ডানে)।

শিশুদের খুব পছন্দের জিনিস রঙবেরঙের বাহারি বেলুন। এই বেলুন আকাশে ওড়ানোর খেলাতে বেশ মজা পায় ছোট শিশুরা। এসব বেলুন বিক্রি করতে আসেন পেশাদার বেলুন বিক্রেতারা। স্কুল, মার্কেট, রাস্তার পাশের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় এমন জায়গা, বস্তির সামনে, খোলা খাবার বিক্রেতার পাশে, মেলায় অহরহই দেখা যায় বেলুন বিক্রেতাদের। যেহেতু মুখের বাতাসে বারবার ফুলিয়ে বেলুন বিক্রি করার কাজটা কঠিন তাই তারা সহজে কাজটা করার জন্য ব্যবহার করে গ্যাস। বিশ্বজুড়ে এমন কাজে হিলিয়াম গ্যাস ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও ফাঁকফোকর খোঁজার এ দেশে নিয়ম ভেঙে বেলুন ফোলাতে বিক্রেতাদের অনেকেই ব্যবহার করে থাকেন সস্তা হাইড্রোজেন গ্যাস। বেশি লাভের আশায় এই গ্যাস ব্যবহার করলেও বেশিরভাগ বিক্রেতাই জানেন না তাদের সঙ্গে রাখা হাইড্রোজেন গ্যাসভর্তি সিলিন্ডারের পাশাপাশি বহন করছেন ‘মৃত্যু’। আর সেই গ্যাস দিয়ে তৈরি বেলুনের মাধ্যমে শিশুদের হাতে তুলে দিচ্ছেন বিপজ্জনক ‘বোমা’।

বিশেষজ্ঞদের মতে, হিলিয়াম গ্যাস আবিষ্কারের পর বিশ্বের অন্যান্য দেশে বেলুনে হাইড্রোজেন গ্যাসের ব্যবহার বন্ধ হয়ে গেছে ২০০ বছর আগেই। অথচ দেশে প্রকাশ্যে হাইড্রোজেন গ্যাসের বেলুন বিক্রি হচ্ছে। এই বেলুনকে এক একটি বোমার সঙ্গেও তুলনা করেছেন তারা। কারণ, তাপের সংস্পর্শে হাইড্রোজেন গ্যাসের বেলুন বিস্ফোরিত হবেই।

হাইড্রোজেন গ্যাস দিয়ে অহরহই তৈরি হচ্ছে গ্যাস বেলুন বুধবার (৩০ অক্টোবর) রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে বেলুন ফোলানোর সময় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মারা গেছে এখন পর্যন্ত ৭ জন। আর আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) চিকিৎসাধীন আছে ৬ জন। নিহত প্রত্যেকেই শিশু। এরপর আবারও আলোচনায় আসে বেলুনে হাইড্রোজেন গ্যাসের অপব্যবহার প্রসঙ্গ। বিস্ফোরণের পর রাতেই আহত অবস্থায় আটক দেখানো হয় গ্যাস বেলুন বিক্রেতা আবু সাঈদকে। তাৎক্ষণিক জিজ্ঞাসাবাদে আবু সাঈদ জানিয়েছে, সে চকবাজার থেকে কেমিক্যাল কিনে নিজেই গ্যাস উৎপাদন করে বেলুন বিক্রি করতো।

রূপনগর থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিস্ফোরণ ঘটনার পর সোহরাওয়ার্দীতে চিকিৎসাধীন ছিল আবু সাইদ। আমরা তাকে সেখান থেকে আটক করে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। চকবাজার থেকে কেমিক্যাল কিনে নিজেই গ্যাস উৎপাদন করে বেলুন ব্যবসা শুরু করার কথা স্বীকার করেছে সে। এর আগে সে একটি পোশাক কারখানায় এবং পরে টেইলার্সের দোকানে কাজ করতো। সেই কাজ ছেড়ে রঙিন গ্যাস বেলুনের ব্যবসা শুরু করেছে ১৫-২০ দিন থেকে।  

বেলুন বিক্রেতা সাইদের গ্যাস তৈরি করার পদ্ধতি নিজ চোখে দেখেছেন রূপনগরের বাসিন্দা এবং বিস্ফোরণের আহত ৯ বছরের ছেলের বাবা মহিউদ্দিন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন , ‘কয়েক দিন ধরে তাকে দেখতেছি এই জায়গায় বেলুন বিক্রি করতে। তাকে এই জায়গায় না বসতে অনেকবার মানা করছি। সেদিন আমি আমার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। প্রতিদিনের মতো বেলুনওয়ালা সেই জায়গায় এসে দাঁড়ায়। প্রথমে দেখি একটা বোতলে কী যেন ঢুকিয়ে প্রথমে ঝাঁকি দিলো। এরপর সিলিন্ডারের ওপরে যে চাবি থাকে সেখানে কোনও একটা সমস্যা ছিল। দুইবার সেই জায়গায় ইট দিয়ে বাড়ি দেয়। এরপর একটা বিকট শব্দ শুনতে পাই। তারপর দেখি সব ধোঁয়ায় অন্ধকার।’

রূপনগরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আহত শিশুদের উদ্ধার করে নেওয়া হচ্ছে হাসপাতালে  

দেশে গ্যাস বেলুনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা প্রায় প্রতিবছরই একাধিকবার ঘটছে। গত বছর ছাত্রলীগের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত র‌্যালিতে যোগ দিতে যাওয়ার সময় বাসের মধ্যে গ্যাস বেলুন বিস্ফোরণে ১০ জন অগ্নিদগ্ধ হন। তাদের সবার কাছে গ্যাস বেলুন ছিল বলে আহতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। হঠাৎ করে গরম বা দাহ্য কিছুর সংস্পর্শে গ্যাস বেলুনগুলো বিস্ফোরিত হয়ে অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হয়।

এরপর গ্যাস বেলুনে হিলিয়ামের বদলে হাইড্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করা নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ‘বেলুন বিক্রেতারাই তৈরি করছে হাইড্রোজেন গ্যাস!’ প্রকাশ করে। বাংলা ট্রিবিউনের অনুসন্ধানে জানা যায়, বেলুন বিক্রেতারা কয়েক ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করে সিলিন্ডারের ভেতরেই হাইড্রোজেন গ্যাস উৎপাদন প্রক্রিয়া চালায়। গ্যাস তৈরি করার জন্য এসব কেমিক্যাল তারা সংগ্রহ করেন চকবাজার থেকে। সে সময় শাহবাগের বেলুন বিক্রেতা ফজর আলী নিজেই স্বীকার করেছিলেন, হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরি করে বেলুনে ব্যবহার করা হয়।

বুধবারের ঘটনার পর দোকানে তালা লাগিয়ে সিলিন্ডারগুলোসহ গাঢাকা দিয়েছে শাহবাগের পাইকারি বেলুন বিক্রেতা ফজর আলী। গ্যাস বেলুনের চাহিদা থাকলেই ঢাকায় সবার আগে তার নাম আসে বলে জানা যায়। বৃহস্পতিবার সরেজমিন তার শাহবাগের দোকানে গিয়ে দেখা যায় সেটি তালা দেওয়া। বাইরে থেকে টিনের ফাঁক দিয়ে দেখা যায় তার খালি জায়গায় কোনও সিলিন্ডার নেই। স্থানীয় দোকানদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিরপুরের ঘটনার পর এখান থেকে চলে গেছে ফজর আলী। তার কর্মীরা সঙ্গে নিয়ে গেছে সিলিন্ডার। খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, সেগুলো তারা নিয়ে গেছে কামরাঙ্গিরচর এলাকায়। ফজর আলীর বাসা চকবাজার এলাকায়। সে শাহবাগ থেকে যাওয়ার সময় বলে গেছে গ্রামে যাওয়ার কথা। তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়।  

বিশেষজ্ঞদের মতে, হিলিয়াম গ্যাস হাইড্রোজেন থেকে অপেক্ষাকৃত ভারী বলে বেলুন কম উচ্চতায় ওড়ে। অন্যদিকে, এই গ্যাস দাহ্য না হওয়ায় তা বেলুনে ব্যবহার করা হয় সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে। এর বিপরীতে হাইড্রোজেন গ্যাস ব্যবহার জননিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, এই গ্যাস বেলুন বিস্ফোরিত হতে সিগারেটের সামান্য আগুনই যথেষ্ট। হিলিয়াম গ্যাস ‘নন রিঅ্যাক্টিভ’ বা নিষ্ক্রিয় হওয়ায় ব্যবহারে এই ঝুঁকি থাকে না। এই গ্যাসের বেলুন ফেটে গেলেও আগুন ধরার কোনও সম্ভাবনা নেই। এজন্যই হিলিয়াম গ্যাস ব্যবহার নিরাপদ।

রূপনগরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে নিহত এক শিশুর পরিবারের আহাজারি

গ্যাসের বিষয়ে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য ও বুয়েটের পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মিনারেল রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, হাইড্রোজেন গ্যাস হিলিয়ামের চেয়ে হালকা। বেলুনে গ্যাস ভরার ক্ষেত্রে হিলিয়াম গ্যাস ভরার কথা থাকলেও এটি খুবই দামি। তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হাইড্রোজেন ব্যবহার করা হয়। আর হাইড্রোজেন গ্যাস যখনই তাপের সংস্পর্শে আসবে, তখনই বিস্ফোরণ ঘটবে। গ্যাস বেলুনগুলোতে হাইড্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করা হলে তা সবসময়েই বিপজ্জনক।

বেলুন বিক্রেতাদের গ্যাস উৎপাদনের পদ্ধতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ বলে জানিয়েছে বিস্ফোরক পরিদফতর। সংস্থাটির মুখ্য পরিদর্শক সামসুল আলম  বলেন, গ্যাস সিলিন্ডারকে নিজেদের মতো করে সিলিন্ডারের ভেতরেই হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরি করার পদ্ধতি বানিয়েছে। সিলিন্ডারের ভেতরে কস্টিক সোডা ও অ্যালুমিনিয়াম পাউডার দিয়ে হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরি করতে থাকে। এর সাহায্যে বেলুন ফোলাতে থাকে। এরমধ্যে কিছুক্ষণ ফোলানোর পরে কোনও কাস্টমার না থাকলে সাধারণত সিলিন্ডারের নবটি বন্ধ করে রাখে। এই সময়ের মধ্যে হাইড্রোজেন গ্যাস তৈরি হতে থাকে। এতে সিলিন্ডারের ওপর গ্যাসের চাপ বাড়তে থাকে। আর তাতে ভেতরে ক্ষয় হতে থাকে। একপর্যায়ে গ্যাসের চাপ বেশি বেড়ে গেলে সিলিন্ডারটি গরম হয়ে নরম হয়ে যায়। এ অবস্থা যখন আবার বেলুনে গ্যাস ভরার জন্য নব খোলা হয়, তখনই বিস্ফোরণ ঘটে।

রূপনগরে গ্যাস বেলুনের সিলিন্ডার বিস্ফোরণ

বিস্ফোরক পরিদফতরের প্রধান পরিদর্শক আরও বলেন, এ ধরনের রিঅ্যাক্টর একেবারে নিষিদ্ধ। এ ধরনের সিলিন্ডার যার কাছে দেখবে, তাকেই পুলিশের ধরা উচিত। পুলিশ প্রশাসনকে আমরা বহুবার চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে জানিয়েছি। কিন্তু পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করছে না। এ সময় মিরপুরের ঘটনাটি দুইজন কর্মকর্তা তদন্ত করছে বলেও জানান তিনি।  

পুলিশ কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পুলিশ আদৌ ঘোষণা দিয়ে গ্যাস বেলুনের কার্যক্রম বন্ধ করতে পারে কিনা এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগ কাজ করছে।

আরও পড়ুন:
বেলুনের গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ: নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৭

মিরপুরে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় বেলুনওয়ালা আটক

বেলুনে ‘নিষিদ্ধ হাইড্রোজেন’, ঘটছে প্রাণহানি

হঠাৎ বিস্ফোরণের পর কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় চারপাশ

 

 

 

/টিএন/এমওএফ/
সম্পর্কিত
হজ ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলার শঙ্কা এজেন্সি মালিকদের
গরমে পানির সংকট রাজধানীতে, যা বলছে ওয়াসা
পাট শিল্পের উন্নয়নে জুট কাউন্সিল গঠন করা হবে
সর্বশেষ খবর
কুবিতে উপাচার্য-ট্রেজারার-প্রক্টরকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা, ৩ দফতরে তালা
কুবিতে উপাচার্য-ট্রেজারার-প্রক্টরকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা, ৩ দফতরে তালা
ইউরোপ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে: সতর্ক ম্যাক্রোঁর
ইউরোপ ধ্বংস হয়ে যেতে পারে: সতর্ক ম্যাক্রোঁর
রবিবার থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলছে, শনিবারও ক্লাস চলবে
রবিবার থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলছে, শনিবারও ক্লাস চলবে
অবৈধ ব্যবহারকারীদের ধরতে বাড়ি বাড়ি যাবে তিতাস
অবৈধ ব্যবহারকারীদের ধরতে বাড়ি বাড়ি যাবে তিতাস
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা