X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

কী ছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নোটে?

শফিকুল ইসলাম
১৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ২২:০২আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯, ২২:০৩

‘রাজাকারের তালিকা’ সংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নোট দেশের মানুষকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার উদ্দেশ্যে গত ১৫ ডিসেম্বর রাজাকারদের একটি তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠলে তালিকাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া গেছে বলে জানান মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। এদিকে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, ওই তালিকার সঙ্গে এ সংক্রান্ত একটি নোটও ছিল। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ওই নোটটি আমলে নেয়নি। নোটটি আমলে নিলে  রাজাকারদের তালিকা নিয়ে এত বিতর্কের সৃষ্টি হতো না বলেও মন্তব্য করেছেন খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। এখন প্রশ্ন হচ্ছে—মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠানো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নোটে কী ছিল?

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এই তালিকা সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ওই তালিকাটি কোনও রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যদের নামের তালিকা নয়। এটি ছিল ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সালে দালাল আইনে দায়ের করা মামলায় অভিযুক্ত ১০ হাজার ৭৮৫ জনের নামের তালিকা। তালিকাভুক্ত ১০ হাজার ৭৮৫ জন আসামির মধ্যে ৯৯৬ জনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি বা খালাস দেওয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি নোটও ছিল তালিকার সঙ্গে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক অধিশাখা-২ থেকে উপসচিব মল্লিকা খাতুন স্বাক্ষরিত একটি নোট (যার স্মারক নং-৪৪,০০,০০০০,০৭৫,০৪,০০৩,১৯,১২২৫, তারিখ ০১ ডিসেম্বর ২০১৯) মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবরে পাঠানো হয়েছে।

অতি গোপনীয় এই নোটের ‘বিষয়’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে—‘রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের বিষয়ে সংরক্ষিত ফাইল যাচাই-বাছাই’। 

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠানো নোটের প্রথম দফায় বলা হয়েছে, ‘মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির তৃতীয় বৈঠকে জননিরাপত্তা বিভাগে সংরক্ষিত রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের বিষয়ে সংরক্ষিত ফাইল যাচাই-বাছাই করে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য এ বিভাগের যুগ্ম সচিব (রাজনৈতিক-১)-কে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট উপকমিটি গঠন করা হয়েছে।’

নোটের দ্বিতীয় দফায় উল্লেখ করা হয়েছে—‘উপকমিটি একাধিক সভা করে নথি তালিকাভুক্তির কার্যক্রম সম্ম্পন্ন করেছে। তালিকাভুক্ত ১ হাজার ২৫৪টি নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নথি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সংখ্যা ১০ হাজার ৭৮৫ জন। তবে তালিকাভুক্ত ১ হাজার ২৫৪টি নথির মধ্যে ৩৫২টি নথি দালাল আইন সংশ্লিষ্ট না হওয়ায় রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং স্বাধীনতাবিরোধীদের নাম সংবলিত নথির সংখ্যা পাওয়া গেছে ৯০২টি। ওই নথি সংশ্লিষ্ট তালিকাভুক্ত ১০ হাজার ৭৮৫ জন ব্যক্তির মধ্যে ৯৯৬ জন সরকারের (১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত) সাধারণ ক্ষমা পেয়েছেন অথবা আবেদন করে আদালত থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।’

তালিকা সংক্রান্ত নোটের তৃতীয় দফায় বলা হয়েছে—‘বর্ণিত তালিকা শুধু জননিরাপত্তা বিভাগে সংরক্ষিত নথি যাচাই করে প্রস্তুত করা হয়েছে। রাজাকার, আলবদর, আলশামস এবং স্বাধীনতাবিরোধীর মোট সংখ্যা এ মন্ত্রণালয়ে রেকর্ডভুক্ত নেই। সম্পূর্ণ সংখ্যা নির্ধারণের জন্য দেশব্যাপী আরও যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন। এ কার্যক্রম চলমান থাকবে।’

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো নোটের চতুর্থ দফায় বলা হয়েছে—‘যাচাই করা ৯০২টি নথির অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিদের তালিকা সংবলিত বিভাগ অনুযায়ী ৭ খণ্ড বই পরবর্তী প্রয়োজনীয় কাজের জন্য নির্দেশক্রমে পাঠানো হলো।’ 

এ তালিকা প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমি নিজেও মর্মাহত হয়েছি। কষ্ট পেয়েছি। তিনি বলেন, ‘আমার মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো নোটটি ভালোভাবে আমলে নিলে এমন পরিস্থিতি হতো না। আসলে নোটটি আমলে নেওয়া তো দূরের কথা, পড়েও দেখা হয়নি। আর আমরা যে তালিকা পাঠিয়েছি, তা আসলে কোনও রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্য বা স্বাধীনতাবিরোধীদের কোনও নামের তালিকা নয়। এটি ছিল দালাল আইনে দায়ের করা মামলায় অভিযুক্তদের নামের তালিকা। এছাড়া, তালিকাটি যে প্রকাশ করা হবে, তাও বলেননি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী। তিনি তালিকা চেয়েছেন, আমরা পাঠিয়েছি।’

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এ নথি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব আরিফ উর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নোটসহ তালিকাটি তো দূরের কথা, খামটিও চোখে দেখিনি। মন্ত্রীর একান্ত সচিব নিজে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে খামটি এনে তা মন্ত্রীর হাতে দিয়েছেন। মন্ত্রী তা নিজের মতো করে সংরক্ষণ করেছেন। নিজের দেওয়া তারিখ অনুযায়ী আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তা প্রকাশ করেছেন। আমি শেষ মুহূর্তে সংবাদ সম্মেলনে এসে মন্ত্রীর পাশে বসেছি।  আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না।’ 

এক প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, ‘প্রথা অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লেখা নোটটি সচিবের দফতরে এলে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না। কারণ, আমরা নোটটি পড়তাম। নির্দেশনা অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতাম।’ তিনি বলেন, ‘মন্ত্রী অতি বিশ্বাস ও আস্থার জায়গা থেকেই হয়তো কাউকে কিছু শেয়ার করেননি।’ 

নোটের  বিষয়ে  জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে কোনও মন্তব্য না করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘তালিকাটি অন্যের হাতে গেলে নির্ধারিত সময়ের আগে ফাঁস হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে নিজের কাছে সংরক্ষণ করেছিলাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তালিকার একটি দাঁড়ি-কমা আমি বাদ দেইনি, যুক্তও করিনি এবং সেভাবেই প্রকাশ করেছি।’

এদিকে, ত্রুটিপূর্ণ রাজাকারের তালিকা প্রসঙ্গে বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) গণভবনে আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায়  দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘কীভাবে রাজাকারদের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম চলে এলো তা রহস্যজনক। তালিকা প্রকাশ করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় গোলমাল করে ফেলেছে। এটি খুব খারাপ কাজ হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটি খুব কষ্টের বিষয়। যার পরিবার সদস্যরা শহীদ হয়েছেন, যুদ্ধ করেছেন, তাদের যদি রাজাকার শব্দটি শুনতে হয়, তাহলে খারাপ লাগারই কথা। আমি বলবো, যারা দুঃখ পেয়েছেন তারা শান্ত হোন। যারা মুক্তিযোদ্ধা তারা কোনোদিনও রাজাকারের তালিকায় থাকতে পারেন না।’ এটি হতে পারে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

প্রসঙ্গত, তীব্র সমালোচনার মুখে ইতোমধ্যেই তালিকাটি স্থগিত করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

/এমএনএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
গরমে স্বস্তির খোঁজে লোকালয়ে ঢুকছে সাপ, সচেতনতার আহ্বান ডিএমপির
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী