১৯৭২ সালে অনেকগুলো দিক থেকে একেবারে ভিন্ন রকমের আহ্বান নিয়ে এসেছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। স্বাধীন বাংলাদেশের বাতাসে প্রথমবারের মতো বাংলার মানুষ শহীদদের স্মরণ করেছিল মুক্ত বিহঙ্গের মতো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনেকটা পথ খালি পায়ে হেঁটে শহীদদের মাজারে গিয়েছেন। সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে শহীদ মিনারে গেলে তৈরি হয় আবেগময় পরিবেশ। এমন একুশ কখনও কেউ দেখেনি আগে। ফুলের পাপড়ি বর্ষণ হচ্ছে, খালি পায়ে নেতারা এগিয়ে চলেছেন— শ্রদ্ধায় অবনত চিত্তে। সেই জাতীয় শহীদ দিবসের প্রথমদিনে দৃপ্ত কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু জানিয়েছিলেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধী ষড়যন্ত্র এখনও চলছে। ঐক্যবদ্ধ থেকে তার মোকাবিলায় প্রস্তুত হতে হবে।’
ওই মহামানব আসে শুভ্র পাজামায়
পাঞ্জাবি ও কালো মুজিব কোট গায়ে বঙ্গবন্ধু যখন শহীদ মিনারে এলেন, তখন চারপাশ থেকে তার ওপরে পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছিল। দৈনিক বাংলার খবর অনুযায়ী, এর আগে সকাল সকাল বঙ্গবন্ধু খালি পায়ে আজিমপুর গোরস্থানে গিয়ে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের উদ্দেশে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন তার বিশ্বস্ত সহচর তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খন্দকার মোশতাক, ইউসুফ আলী, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা তোফায়েল আহমেদসহ আরও অনেকে। সেখানে তারা শহীদদের মাগফিরাত চেয়ে ফাতেহা পাঠ করেন। সকাল ৮টায় শহীদ মিনারের পাদদেশে উপস্থিত হন বঙ্গবন্ধু। বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে এই প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারির সকালে ভাষা আন্দোলনের পীঠস্থান শহীদ মিনারে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘লাখো মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়েছি। এ আত্মত্যাগ যেন বৃথা না যায়।’ তিনি বলেন, ‘যতদিন পর্যন্ত শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা না হচ্ছে, ততদিন সংগ্রাম চলবে। বাংলার বিরুদ্ধে এখনও ষড়যন্ত্র চলছে। সেই ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় দল-মত নির্বিশেষে প্রস্তুত হয়ে যান।’
বঙ্গবন্ধু সকালের দিকে আজিমপুর গোরস্থানে মোনাজাত শেষে যখন শহীদ মিনার পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যান, তখন বিরাট জনতা ও সহকর্মীরা তাকে অনুসরণ করেন।
বাংলাদেশেই খুনিদের বিচার হবে
ধানমন্ডি ক্লাব ও কলাবাগানে ‘৮ ফাল্গুন পরিষদ’ আয়োজিত এক সভায় বঙ্গবন্ধু বক্তৃতা করেন বলে জানা যায়। সেখানে তিনি ঘোষণা দেন— যারা গণহত্যা চালিয়েছে বাংলাদেশের মাটিতে, তাদের বিচার হবে। যারা ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যায় অংশ নেয়নি, তাদের (মূলত বিহারি) পাকিস্তানে পরিজনের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘তাদের সৈন্যরা বাংলাদেশে যা ঘটিয়েছে, তা জানতে পারলে পাকিস্তানিরাও বিদ্রোহ ঘোষণা করতো।’ বাসস এই খবর প্রকাশ করে।
এখনও চলছে চক্রান্ত
এই উপমহাদেশে স্বাধীনতার আগে থেকে শুরু হয়েছে যে চক্রান্ত, এখনও তার সমাপ্তি ঘটেনি বলে উল্লেখ করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি জানান, চক্রান্ত চলছে, চক্রান্তকারীরা বসে নেই। সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তকারীরা আশপাশে রয়েছে। একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ টেলিভিশনে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু একথা বলেন। এ খবরটিও বাসস প্রকাশ করে।
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘সংগ্রাম শুরু হয়েছে ১৯৪৮ সালে। এরপরে ৫২, ৫৪, ৬২, ৬৬, ৬৯-এর সংগ্রাম এবং একাত্তরের সশস্ত্র লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সংগ্রাম শেষ হয়।’
প্রখ্যাত সাংবাদিক ও বঙ্গবন্ধুর বন্ধুস্থানীয় এবং ভাষা আন্দোলনের কর্মী কে জি মোস্তফা এই সাক্ষাৎকারটি নেন।
পাকিস্তান শোসক হবে: শঙ্কা আগেই ছিল
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘১৯৪৭ সালে এই আমরা বলেছিলাম— বাঙালিরা ডুবে যাবে এবং পাকিস্তানের দ্বারা শোসনের শিকার হবে।’ ৫২-এর স্মৃতিচারণা শীর্ষক এই সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘পাকিস্তানের স্রষ্টা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র মনে বাঙালিদের জন্য দরদ ছিল না। বাংলাদেশকে তিনি পশ্চিম পাকিস্তান এবং ব্যবসায়ী মহলের উপনিবেশ বানাতে চেয়েছিলেন। ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষে বাঙালিরা যখন মরেছে, তখন জিন্নাহ তাদের দেখতে আসেননি।’
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর দালালদের এজেন্টরা প্রশাসনকে কব্জা করতে তাড়াহুড়ো করে ঢাকায় চলে এলো, উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উসকানি দেয় এবং উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা চালায়। বাঙালি জাতিকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র করে, তারা প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে আঘাত করে। ভাষা আন্দোলনের সময় তারা শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দেশ থেকে বহিষ্কার করে।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘তখন ছাত্রলীগ, সাংবাদিক, লেখক, ছাত্রসমাজ এই প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করে। না করলে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত হতো। প্রথম গণপরিষদের সদস্য ধীরেন দত্ত গণপরিষদের ভেতরে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন। ষড়যন্ত্রকারীদের দালালরা তাকে সমর্থন না করে লিয়াকত আলীকে সমর্থন দিয়েছিল।’
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী কে জি মোস্তফা বলেন, ‘১৯৪৭-এর ৩ জুন কলকাতায় সিরাজউদ্দৌলা হলে আপনি বলেছিলেন— ছাত্ররা মনে রেখো, ভবিষ্যতে আমাদের আরও একটি স্বাধীনতা আন্দোলন করতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু তার সঙ্গে মতৈক্য প্রকাশ করেন। বঙ্গবন্ধু বেশ খোশমেজাজে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘মোস্তফা, আমরা শুধু স্বাধীনতাই পেলাম, আমাদের কিছু নেই। ইয়াহিয়ার খান সেনারা আমাদের জনগণকে হত্যা করেছে। হত্যা করেছে বিজ্ঞানী, সাংবাদিক, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও যুবসমাজকে।’
ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ এবং বঙ্গবন্ধু
বঙ্গবন্ধু জানান, ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেসময় তার সঙ্গে ন্যাপের নেতা মহিউদ্দিনও ছিলেন। তখন তিনি ছাত্রদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে বলেন এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করবেন বলেও জানান। তিনি বলেন, ‘মহিউদ্দিনও আমার সঙ্গে অনশন ধর্মঘট করবে বলে জানায়।’
সেই সময়কার প্রহরায় রত পুলিশ সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, ‘তারা রাতে ছাত্রনেতাদের নিয়ে আসতে সহায়তা করেছেন।’ এরপর কোনও সূত্রে বিষয়টি বুঝতে পেরে সরকার বঙ্গবন্ধুকে ফরিদপুর কারাগারে স্থানান্তরিত করেছিল।