X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

এবার কালো টাকা আলোতে আসবে?

গোলাম মওলা
২০ জুন ২০২০, ১০:২০আপডেট : ২০ জুন ২০২০, ১০:২০

টাকা প্রতি বছরের মতো এবারও বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। শুধু সুযোগই নয়, কালো টাকা অর্থনীতির মূল ধারায় নিয়ে আসতে এবার ব্যাপকহারে সুযোগ দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, ব্যাংকে রেখেও কালো টাকা সাদা করা যাবে। এত দিন ফ্ল্যাট কেনায় এই সুযোগ ছিল। এখন নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে জমি কেনাতেও এই সুযোগ দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, এলাকাভিত্তিক নির্দিষ্ট হারে কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করতে পারবেন। এমনকি অপ্রদর্শিত অর্থে আগের কেনা সম্পদের বিপরীতেও নির্ধারিত হারে কর দিয়ে যেকোনও পরিমাণ টাকা সাদা করা যাবে। এ ব্যাপারে কোনও প্রশ্ন করবে না আয়কর বিভাগ। শুধু আয়কর বিভাগ নয়, প্রশ্ন করবে না দুদকও।

বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশনের (রিহ্যাব) সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া। তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমরা বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ চেয়ে আসছিলাম। প্রায় একযুগ পর সুযোগটি দেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি, এই সুযোগ আবাসন খাতকে ঘুরে দাঁড়াতে বড় ধরনের সহায়তা করবে।’

তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এত সুযোগের পরও হয়তো কালো টাকা অর্থনীতির মূল ধারায় আসবে না। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘যারা অবৈধ পথে আয় করেছে, তারা ঘোষণা দিয়ে কালো টাকা সাদা করবে না, বা দেশের কোথাও বিনিয়োগ করবে না। কারণ, কার কাছে কালো টাকা আছে, এটা সহজে কেউ প্রকাশ করতে চাইবে না।’ তিনি উল্লেখ করেন, ব্যাপক ধড়পাকড় ও জেল জরিমানা শুরু হলে তবেই মানুষ কালো টাকা সাদা করবে। কালো টাকা সাদা করার জন্য সরকার যদি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিতে পারে, তবেই এর সুফল পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, ‘নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিনিয়োগ না করলে কালো টাকা বাতিল হয়ে যাবে। সম্পদ বাজেয়াপ্ত হবে। এরকম ব্যাপক ধড়পাকড় শুরু হলেই কেবল কালো টাকা অর্থনীতিতে আসবে।’ তার মতে, সরকার কঠোর হলে অর্থাৎ কারও কাছে যদি একলাখ কালো টাকা ধরা পড়ে এবং তার পুরো সম্পতি বাতিল করা হয়, তাহলে সব কালো টাকাই হয়তো অর্থনীতিতে চলে আসবে।

তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘কালো টাকা অর্থনীতিতে আনার আরেকটা পথ আছে, সেটা হলো— ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে যারা ৪০ বা ৫০ শতাংশ কর দিয়ে বিনিয়োগ করবে, সরকার তাদের কাছ থেকে গ্যাস বিল, বিদ্যুৎ বিলসহ বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল নেবে না। বিনা খরচে তাদের ছেলে-মেয়েদের ভালো বা নামিদামি স্কুল-কলেজে পড়ার সুযোগ করে দেবে। তাহলেও কালো টাকা অর্থনীতিতে চলে আসতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ এবং ২০০৮ সাল ছাড়া কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে তেমন সুফল মেলেনি।’

তবে মূলধারার অর্থনীতিতে এবার কালো টাকা আসতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘আগে কখনও এমন সুযোগ দেওয়া হয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না। ঘুষ-দুর্নীতি করে যারা টাকা কামাইছেন, চুরি-ডাকাতি করে টাকার মালিক হয়েছেন, তারাও এবার টাকা বৈধ করতে পারবেন।’ ঢালাওভাবে এই সুযোগ দেওয়া ঠিক হয়নি বলেও মনে করেন তিনি। কারণ, এতে চোরদের উপকার হলেও সৎ করদাতারা হতাশ হয়ে পড়ছেন। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর আন্ডার ইনভয়েসিং-ওভার ইনভয়েসিংসহ নানাভাবে প্রচুর কালো টাকা দেশ থেকে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এটা দ্রুত বন্ধ হওয়া দারকার।’

প্রসঙ্গত, এবার মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করা যাবে। এর মধ্যে রয়েছে— শেয়ারবাজার, বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড, ডিবেঞ্চার এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানির অন্যান্য সিকিউরিটি। তবে এ সুযোগ দেওয়া হয়েছে এক বছরের জন্য। এছাড়া, ১০ শতাংশ কর দিয়ে ব্যাংকেও জমা রাখা যাবে এই টাকা।

এতদিন যারা নিয়ম মেনে কর পরিশোধ করেছেন তাদের ৩০ শতাংশ হারে কর দিতে হয়েছে। নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী, যারা নিয়ম মানছেন না, তারা কর দেবেন মাত্র ১০ শতাংশ হারে। তাদের গুনতে হবে না কোনও ধরনের জরিমানাও।

অতীতে কালো টাকা সাদা করার সুবিধা দেওয়া হলেও নির্দিষ্ট হারে কর পরিশোধ করে ওই পরিশোধিত করের ওপর আরও  ১০ শতাংশ জরিমানা দিতে হতো।

কেউ শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোনও শেয়ারে অপ্রদর্শিত আয়ের টাকা বিনিয়োগ করতে চাইলে, তা কমপক্ষে তিন বছরের জন্য করতে হবে। তিন বছরের ‘লক ইন’ বা বিক্রয় নিষেধাজ্ঞার শর্তে এ সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এদিকে  ‘লক ইনের’ শর্ত তুলে দেওয়ার সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের  (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াৎ-উল-ইসলাম। বৃহস্পতিবার (১৮ জুন) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সঙ্গে দেখা করে তিনি এই  সুপারিশ করেন।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, নগদ, ব্যাংক জমা, সঞ্চয়পত্রসহ বিভিন্ন ধরনের স্কিমে কালো টাকা বিনিয়োগ করা যাবে। এবার কালো টাকা বিনিয়োগের সবচেয়ে বড়ো সুবিধা হলো— এই বিনিয়োগ নিয়ে কোনও সংস্থা প্রশ্ন করতে পারবে না। প্রশ্ন করতে পারবে না দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক)।

অর্থমন্ত্রী এ সংক্রান্ত প্রস্তাবে বলেন, ‘করদাতার রিটার্ন দাখিলে অজ্ঞতার কারণে কিছু অর্জিত সম্পদ প্রদর্শনে ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে। আগামী এক বছরের মধ্যে এসব অর্থ পুঁজিবাজারসহ অন্যান্য খাতে বিনিয়োগে ১০ শতাংশ কর প্রদান করলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ কোনও কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন করতে পারবে না। এর ফলে অর্থনীতির মূল স্রোতে অর্থপ্রবাহ ও কর্মসংস্থান বাড়বে এবং রাজস্ব আদায় বাড়বে।’

গত অর্থবছরেও ১০ শতাংশ কর দিয়ে কোনও প্রশ্ন ছাড়াই ফ্ল্যাট ও অ্যাপার্টমেন্ট কেনা, দালান নির্মাণ এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে অপ্রদর্শিত আয়ের অর্থবিনিয়োগের সুযোগ ছিল।

জানা গেছে, এ পর্যন্ত দেশে ১৫ অর্থবছরে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সব মিলিয়ে ২০ হাজার কোটি টাকাও সাদা হয়নি। ফলে সরকার এই কালো টাকা থেকে কাঙ্ক্ষিত করও পায়নি। অবশ্য ২০০৭ ও ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ৩২ হাজার ৫৫৮ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নিয়েছিল। ওই সময় সাদা হয়েছিল ৯ হাজার কোটি টাকা। তা থেকে সরকার কর পেয়েছিল এক হাজার ২০০ কোটি টাকার কিছু বেশি।

বিশ্ব ব্যাংকের ২০০৫ সালের  হিসাব অনুযায়ী, ২০০২-২০০৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে কালো টাকার পরিমাণ ছিল মোট জিডিপির ৩৭ দশমিক ৭ শতাংশ। যদিও বিশ্ব ব্যাংকের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে কালো টাকার পরিমাণ ছিল জিডিপির ৭ শতাংশ।

২০১১ সালে অর্থ মন্ত্রণালয় কালো টাকা নিয়ে একটি জরিপ করেছিল। তাতে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে ২০১০ সালে কালো টাকার পরিমাণ ছিল জিডিপির ৬২ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

 

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
জাবির সিনেট ও সিন্ডিকেট প্রতিনিধি নির্বাচন: বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নিরঙ্কুশ জয়
ঝুঁকি নিয়ে পজিশন বদলে সব আলো কেড়ে নিলেন রাফায়েল
ঝুঁকি নিয়ে পজিশন বদলে সব আলো কেড়ে নিলেন রাফায়েল
স্টয়নিস ঝড়ে পাত্তা পেলো না মোস্তাফিজরা
স্টয়নিস ঝড়ে পাত্তা পেলো না মোস্তাফিজরা
রানা প্লাজা ধস: ১১ বছরেও শেষ হয়নি তিন মামলার বিচার
রানা প্লাজা ধস: ১১ বছরেও শেষ হয়নি তিন মামলার বিচার
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
সকাল থেকে চট্টগ্রামে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন না ডাক্তাররা, রোগীদের দুর্ভোগ
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক