X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

ফেরত আসা কর্মীদের জন্য শ্রমবাজার কোথায়?

সাদ্দিফ অভি
১১ অক্টোবর ২০২০, ০৯:০০আপডেট : ১১ অক্টোবর ২০২০, ১৭:৩১

আবুধাবি থেকে ফেরত আসা কর্মীরা

করোনাকালে সুনির্দিষ্টভাবে কয়েকটি দেশ থেকে কাজ হারিয়ে দেশে ফিরেছেন প্রায় ৯০ হাজার প্রবাসী। এসব কর্মীর বেশিরভাগই অদক্ষ। কাজ হারিয়ে ফেরত আসা কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আবারও শ্রমবাজারে পাঠানোর কথা ভাবছে সরকার। কিন্তু নতুন শ্রমবাজার বাংলাদেশের জন্য এখনও অধরা। কারণ, সেখানে অদক্ষ কর্মীর কোনও জায়গা নেই। নতুন শ্রমবাজারের খোঁজ চললেও দেখা মেলেনি আলোর। তাই অনেকটাই অনিশ্চিত ফেরত আসা কর্মীদের নতুন শ্রমবাজারে পাঠানো। প্রশ্ন উঠেছে–এই কর্মীরা যাবে কোথায়? অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গত ৪-৫ দশকে খুব বেশি বিকল্প বাজার তৈরি করা যায়নি। তাই এই কর্মীদের নতুন শ্রমবাজারে পাঠানো অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী করোনাকালে এক লাখ ৮১ হাজার ৪৩০ জন কর্মী দেশে এসেছেন। এর মধ্যে ৯০ হাজার ৫০৮ জন কর্মীর কাজ না থাকায় দেশে ফেরত এসেছেন, যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক আছেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এদেরকে আবারও ফেরত নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে ফেরত পাঠিয়েছে চাকরিদাতা কোম্পানিগুলো। ফলে তাদেরও কাজে ফেরত যাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব থেকে এ পর্যন্ত ফেরত এসেছেন ৪৩ হাজার ৪৬১ জন কর্মী। এদের মধ্যে কিছু এসেছেন বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করে, ছুটিতে এবং কাজ হারিয়ে—যার সুনির্দিষ্ট কোনও পরিসংখ্যান নেই। ট্যুরিস্ট-নির্ভর দেশ মালদ্বীপে করোনার কারণে কাজ না থাকায় ফেরত এসেছেন ১১ হাজার ৫৯ জন। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতের পর কাজ না থাকায় সবচেয়ে বেশি কর্মী ফেরত এসেছেন কাতার থেকে, যার পরিমাণ ১৭ হাজার ৬৭৭ জন। কাজ না থাকার কারণে ফেরত আসার তালিকায় আরও আছে বাংলাদেশের জন্য বৃহৎ শ্রমবাজার মালয়েশিয়া। সেখান থেকেও এসেছেন প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কর্মী। গত দুই বছর ধরে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ থেকে কর্মী যাওয়া বন্ধ আছে।

সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৭২টি দেশে চাকরি নিয়ে যায় বাংলাদেশিরা। এরমধ্যে বেশিরভাগই মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক। প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে সরকারিভাবে ৮ থেকে ১০ লাখ কর্মী বিদেশে যান। এদের বেশিরভাগই যান অদক্ষ কর্মী হিসেবে। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দেওয়া তথ্য—এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। সৌদি আরব থেকে দেশে কাজ হারিয়ে ফিরেছেন অনেকেই। তাদেরও অনেকেরই নিয়োগকর্তা ইকামার মেয়াদ আর বাড়াতে রাজিন নন বলে জানিয়েছেন ফেরত আসা প্রবাসীরা। এরপর আছে ওমান, কাতার, বাহরাইনের মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। শ্রমবাজারের দিক থেকে মালয়েশিয়ার অবস্থান প্রথম সারির হলেও সেখানে কর্মী যাওয়া বন্ধ আছে দুই বছর। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার অনেক চেষ্টা করা হলেও তা এখনও অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে।

এর বাইরে জাপান, জর্ডান, মরিশাস, সিঙ্গাপুর, রোমানিয়া, ভিয়েতনাম, ইরাক ইত্যাদি দেশেও অল্পকিছু করে কর্মী যাচ্ছেন। তবে গত বছরের আগস্ট থেকে ইরাকে কর্মীর ক্লিয়ারেন্স দেওয়া বন্ধ আছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে কর্মী নেওয়ার সমঝোতা হলেও আলোর মুখ দেখেনি তা। এছাড়া পোল্যান্ড, বলিভিয়ার মতো দেশে কর্মীরা যাওয়া শুরু করলেও তা সংখ্যায় অনেক কম। বাংলাদেশিদের জন্য কুয়েতের শ্রমবাজার বন্ধ হয় ২০০৭ সালের শেষ দিকে। ২০১৪ সাল থেকে সীমিত আকারে কর্মী প্রেরণ শুরু হলেও সেটি চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। দেশটির শ্রমবাজার দখল করে নিয়েছে শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভারত ও ফিলিপাইন। এসব শ্রমবাজারের বাইরে অধিকহারে কর্মী যাওয়ার মতো আর তেমন কোনও শ্রমবাজার আপাতত নেই।

সেপ্টেম্বর মাসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমবাজার যাতে সংকুচিত না হয়, সেজন্য বিকল্প শ্রমবাজারের অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিদেশে থাকা বাংলাদেশ মিশনগুলোও তৎপর রয়েছে। এরই অংশ হিসেবে নতুন করে ছয়টি দেশে শ্রমিক পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সেগুলো হলো—চীন, রোমানিয়া, কম্বোডিয়া, পোল্যান্ড, সেশেল ও ক্রোয়েশিয়া। মন্ত্রণালয় আরও বলছে, বিশ্ব শ্রমবাজারে বাংলাদেশের অবস্থান যাতে সংকুচিত না হয়, সেজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা বাংলাদেশ মিশনগুলো নিরলসভাবে কাজ করছে। পাশাপাশি নতুন শ্রমবাজারের সন্ধানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টাও জোরদার করা হয়েছে।

এছাড়া প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বলছে, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবারও ফিরতে পারবেন কর্মীরা। ফিরে আসা কর্মীদের দক্ষ করে আবারও বিদেশ পাঠানো হবে। তাদেরকে বিনামূল্যে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়া বিদেশে যারা কাজ হারিয়েছেন, তাদের সেখানেই মন্ত্রণালয়ের খরচে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, যাতে তারা নতুন কাজ খুঁজে পান। ইতোমধ্যে গ্রিসে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে ৪-৫ দশকে নতুন শ্রমবাজার তৈরি করা যায়নি। তাই নতুন শ্রমবাজারে কর্মসংস্থান করা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে দক্ষ কর্মী তৈরির বিকল্প নেই।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কিছু কিছু দেশে ভিজিট করেছেন সরকারের প্রতিনিধিরা। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় নিজেরাও কিছু উদ্যোগ নিয়েছে ৫০টিরও বেশি দেশে লোক পাঠানোর জন্য। কিন্তু সেগুলো উন্মোচন করা পর্যন্তই। সেখানে কী ধরনের কর্মী প্রয়োজন এবং তার জন্য কী ধরনের প্রস্তুতি দরকার এতটুকু পর্যন্তই। এর কোনও ফলোআপ হয়নি। তাতে দেখা যাচ্ছে, আমরা প্রস্তুত না। করা উচিত বলেই শেষ কিন্তু আর কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আমরা যে শ্রমবাজারের কথা বলি, সেখানের অর্থনীতি কিন্তু ঘন ঘন পরিবর্তন হয়। কাজেই যখন একটা দেশের কথা চিন্তা করা হয়, সেখানকার অর্থনীতি অনুযায়ী কী কাজের লোক দরকার, এটা কিন্তু বদলাবে। এখন করোনার কারণে যেকোনও নির্দিষ্ট দেশে সেদেশের লোক বা অন্য দেশের লোকের জন্য কী ধরনের ক্ষেত্র আছে, সেটা বদলাচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন যেটা দরকার সেটা হচ্ছে— সেসব দেশে কিন্তু ভিজিটের প্রয়োজন নেই। আমরা দেখেছি যে, আমাদের সরকারের প্রতিনিধি দল বিভিন্ন কাজে বিদেশে যায়। কিন্তু ফলশ্রুতিতে তাদের কাজের বিষয়ে প্রশ্ন থেকেই যায় যে, সেটা কতটা কাজে দিচ্ছে। এখন অনলাইনের যুগ, অনেক জায়গায় আমাদের মিশন আছে। যেসব দেশে নতুন কাজের ক্ষেত্র আছে, কিন্তু আমাদের মিশন নাই, সেসব দেশে স্থানীয় কাউকে যুক্ত করে খোঁজ নেওয়া যেতে পারে। প্রাথমিকভাবে কিন্তু অনেক দেশেও তা প্রয়োজন নাই। অল্প কয়েকটা দেশে খোঁজ করে এখানকার প্রশিক্ষণ সক্ষমতা তৈরি করতে হবে। আমাদের এখানে খুব ট্রেডিশনাল টেকনিক্যাল কাজ শেখান হয়। বেসিক শিক্ষার জায়গা এখনও শক্তিশালী করা হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘শ্রম অভিবাসনের ক্ষেত্রে বড় ইস্যু হচ্ছে ভাষা। যেদেশে যাক কর্মী ওই দেশে গিয়ে ভাষা শিখে কাজ করতে সময় লাগে। বেসিক ইংরেজি না জানার কারণে আমাদের কর্মীরা অন্যদেশের কর্মীর চেয়ে প্রাধান্য পায় না। বাংলাদেশি কর্মীদের ক্ষেত্রে নিপীড়নের ঘটনা, বেতন কম পাওয়ার অনেক বড় কারণ হচ্ছে তারা দক্ষতার দিক থেকে সমসাময়িক না এবং ভাষাগত সমস্যা। এগুলো নিয়ে আলোচনা হয় অনেকদিন ধরেই, কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। আমাদের সামনে আরও কয়েকমাস বাজারের চাহিদা কম হবে। যারা যেতে পারছেন না, তাদের জন্য ধীরে ধীরে কিছু নতুন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে তাদের দক্ষ করা জরুরি।’

তিনি আরও বলেন, ‘করোনা পরবর্তী সময়ে কেয়ার গিভার এবং স্বাস্থ্যকর্মীর একটি চাহিদা থাকতে পারে। তার জন্য আমাদের প্রস্তুতি দরকার।’

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘আমাদের বৈদেশিক কর্মসংস্থান পরিস্থিতি আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ের আগে স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা কম। কাজেই ফেরত যারা এসেছে তাদের নতুন করে বাইরে পাঠানো একটা চ্যালেঞ্জ। নতুন শ্রমবাজার এক্ষেত্রে আরও বড় চ্যালেঞ্জ। গত চার-পাঁচ দশকে আমরা খুব বেশি বিকল্প বাজার তৈরি করতে পারিনি। সেটা কঠিন, কিন্তু এক্ষেত্রে নিবন্ধন জরুরি, তাহলে আমরা একটু যাচাই করতে পারবো যে, আমাদের কী ধরনের দক্ষতাসম্পন্ন লোক আছে। এরা কারা, কোন দেশ থেকে এসেছে, দেশে তাদের কাজে লাগানো যায় কিনা। আমরা যতই বলি অনেক কমিটি হয়েছে, অনেক পরিদর্শন হয়েছে, সেই অর্থে আমাদের শ্রমবাজার গড়ে ওঠেনি। এখন যেসব দেশের নাম নতুন করে বলা হচ্ছে, এগুলো আজ থেকে ৮-১০ বছর আগে প্রস্তাব দেওয়া। আমার মনে হয় না নতুন শ্রমবাজার আমাদের তৈরি হবে, যদি দক্ষ কর্মী তৈরি করতে না পারি। দক্ষ কর্মী তৈরি করা গেলে তারা কিন্তু এমনিতেই নানা জায়গায় কর্মসংস্থান করে নিতে পারবে।’

 

আরও পড়ুন:
করোনাকালে দেশে ফিরেছেন ৬৪ হাজার প্রবাসী কর্মী

ফেরত আসা কর্মীদের আবারও বিদেশ পাঠানোর ব্যবস্থা করবে সরকার

বিদেশ থেকে নারীকর্মী ফেরত আসার হার কমছে

কর্মস্থলে ফিরতে সরকারের সহযোগিতা চান ছুটিতে আসা মালয়েশিয়া প্রবাসীরা

লেবানন থেকে ফেরত আসা ৩২ জন কারাগারে

বিদেশ ফেরতরাও পাবেন সরকারি ত্রাণ

আবুধাবি কেন ফেরত পাঠালো বাংলাদেশি কর্মীদের

বিদেশফেরত ৮১ প্রবাসী গ্রেফতারের নিন্দা ও মুক্তি দাবি




 

 

/এপিএইচ/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির জন্য বাড়ছে হাহাকার
বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির জন্য বাড়ছে হাহাকার
চট্টগ্রামে তিন ভাইবোনকে হত্যা: ২ জনের মৃত্যুদণ্ড
চট্টগ্রামে তিন ভাইবোনকে হত্যা: ২ জনের মৃত্যুদণ্ড
অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় বাধ্যতামূলক অবসরে পুলিশ সুপার
অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় বাধ্যতামূলক অবসরে পুলিশ সুপার
ওমর: ‘নায়িকাবিহীন’ এক থ্রিলার
সিনেমা সমালোচনাওমর: ‘নায়িকাবিহীন’ এক থ্রিলার
সর্বাধিক পঠিত
এএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
রেস্তোরাঁয় ‘মদ না পেয়ে’ হামলার অভিযোগএএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট