X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘লজ্জার কিছু নাই, আমার প্রতিবন্ধী মেয়েটা ন্যায়বিচার পাক’

উদিসা ইসলাম
১৬ জানুয়ারি ২০২০, ২০:৩২আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০২০, ১৯:২০

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে ‘স্বপন মামা’ নামে পরিচিত আবদুল জলিল মিয়া চান তার মেয়েকে ধর্ষণের বিচার হোক। সব ধর্ষণের ঘটনার বিচার হোক।

বাক-প্রতিবন্ধী মেয়ের ধর্ষণের বিচার চেয়ে এখন দুই মামলার আসামি বাবা আবদুল জলিল মিয়া ওরফে স্বপন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাকে চেনেন  ‘স্বপন মামা’ নামে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) এলাকায় দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে চায়ের দোকান তার। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিন ধরে হাসিমুখে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলেও গত দেড়বছর ধরে মুছে গেছে তার মুখের হাসি। সেখানে এখন জমাট অন্ধকার। কারণটা করুণ, শুরুতে প্রায় গোপন রেখেছিলেন। তার প্রতিবন্ধী মেয়ে ধর্ষণের শিকার হওয়ায় ভাঙা মন নিয়ে নিভৃতে চালিয়ে যাচ্ছিলেন ধর্ষকের বিরুদ্ধে মামলা। অভিযুক্তকে গ্রেফতারও করে পুলিশ। বছরখানেক জেলখাটার পর জামিনে বের হয়ে আসে সে আসামি। এরপর শুরু হয় তার খেল। ভিকটিমের বাবা অর্থাৎ জলিল মিয়াসহ তার পরিবারের সবাইকে আসামি করে দুটো মামলা দায়ের করে আসামির পরিবার । হতবাক জলিল মিয়া ক্যাম্পাসে চা বানান আর মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভাবেন। বিচার ব্যবস্থায় অসীম আস্থাশীল এই ব্যক্তির মনে একটি প্রশ্নই ঘোরে, এরকম ঘৃণ্য অপরাধ যে করে সে কিভাবে জামিন পায়?

গত ৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের ঘটনায় বিচার চেয়ে ক্যাম্পাস যখন উত্তাল তখন পোস্টার হাতে সেখানে সংহতি জানান জলিল মিয়া। অঝোর নয়নে কেঁদে মেয়ের ওপর ঘটা নির্মম নির্যাতনের বিচার চেয়ে জনসম্মুখে কথা বলেন। এরপর পরিচিতদের মনে নানা প্রশ্নের উদ্রেগ হয়: কোন চাপের কারণে এতদিন চুপ করে মামলা চালিয়ে যাচ্ছিলেন? সাধারণত ধর্ষণের ঘটনায় পরিবারও প্রকাশ্যে আসতে চায় না লোকলজ্জায়, জলিল মিয়া এ সাহস কীভাবে সঞ্চার করলেন? এসব নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের কথা হয় জলিল মিয়া ওরফে স্বপন মামার সঙ্গে। 

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর অভিযুক্ত বাচ্চু মিয়া (৫০) স্বপন মামার বাকপ্রতিবন্ধী ২০ বছরের মেয়েকে ধর্ষণ করে। তার নামে আরও একাধিক ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে যেগুলো স্থানীয় সালিশে সমঝোতা করে দেওয়া হয় বলে এলাকাবাসীর দাবি। আসামির ভয়ে ভুক্তভোগী অনেকে আইনের আশ্রয় নেয়নি।

কী ঘটলো গত একবছর ধরে প্রশ্নে জলিল মিয়া বলেন, বাক প্রতিবন্ধী মেয়ে (২০) ধর্ষণের শিকার হলে শুরুতে আমাকেও মীমাংসার প্রস্তার দেওয়া হয়েছে। আমি সালিশ শুনেছি, মানিনি। পরে অভিযুক্ত বাচ্চু মিয়ার (৫০) নামে মামলা করা হয়। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে অভিযুক্তকে কারাগারে পাঠানো হয়। এক বছর জেলে থাকার পর জামিনে এসে আমার পরিবারের সবার নাম দিয়ে দুটি মামলা করেন বাচ্চু মিয়ার ভাই বাহার ও আক্কাস। তারা গ্রামের মানুষদের প্রভাবিত করার কাজও করছে। তাদের কথা হলো, অনেকদিন হলো, এবার মীমাংসা করাই ভালো। কিন্তু আমার মন মানে না। বিচারে কী পাবো জানি না কিন্তু এলাকার ডিসি এসপি, বিশ্ববিদ্যালয়ের এতো ছেলেমেয়ে যারা আমার প্রতিবাদে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে তাদের সামনে সমঝোতার আলাপ করবো কিভাবে? আমি পারিনি।

প্রতিবন্ধী মেয়েকে ধর্ষণের বিচার দাবিতে প্রকাশ্য হয়েছেন জলিল মিয়া ওরফে স্বপন মামা।

মেয়ে এখন ঘর থেকে বের হয় না জানিয়ে জলিল মিয়া বলেন, মেয়ে-মেয়ের মা এলাকায় থাকে। সন্ধ্যার পরে এরা ঘর থেকে বের হতে চায় না। মেয়ে একেবারেই কোথাও যায় না। আসামি বের হয়ে আসলে এধরনের কিছু করবে আমাদের আন্দাজ ছিল। এখন আমরা ভয়ের মধ্যে বাস করছি।

জলিল মিয়া তার প্রতিবন্ধী মেয়েকে ধর্ষণের বিচার চান। তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে কথা বলতে পারে না কিন্তু অবুঝ না। তার কষ্ট আমি দূর করতে পারবো না। ভয়ে আমরা এখন নিজ বাসাতেও আতঙ্কগ্রস্ত থাকি। কিন্তু তাই বলে কি পারব না তাকে ন্যায়বিচার দিতে?’

ধর্ষণের ঘটনা বলতে গিয়ে এই বাবা বলেন, ‘আমি সেদিন এলাকাতে ছিলাম। সচরাচর বাড়ি যাওয়া হয় না। দুপুরের সময়ে। ওই সময়টায় বাচ্চু মিয়ার বাড়ি থেকে রোজই আমার মেয়ে দুধ আনতে যেত। সে দূর সম্পর্কের আত্মীয়ও। সেদিন যাওয়ার পরে আমার মেয়েকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে বাচ্চু। মেয়ে যখন বেরিয়ে এসেছে তখন পাশের বাড়ির মহিলা আমার মেয়েকে জিজ্ঞেস করে কে তার এই অবস্থা করেছে? মেয়েটা বলতে না পারলে কী হবে, দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া অবস্থায় বাচ্চুকে দেখিয়ে দেয়। হাতে নাতে ধর্ষককে ধরার পরেও আমার মেয়ে কি বিচার পাবে না? উল্টো আমার ছেলে মেয়ে স্ত্রী সবাইকে আসামি করে ধর্ষকের পরিবার থেকে মামলা করা হয়। জামিনের নাকি শর্ত থাকে। এই অপরাধী জামিন পেয়ে এসে আমাদের জীবন অতিষ্ঠ করে দিচ্ছে। সে কী করে জামিন পায় এ প্রশ্ন আমি কোথায় করবো?’

গ্রামের লোকজন ধর্ষক বাচ্চুকে কিছু বলে কিনা প্রশ্নে তিনি বলেন, গ্রামের লোক আমাকে এতদিন সাহায্যই করেছে। কিন্তু জামিনে আসামি বের হওয়ার পরে আমাকে নানাজনই বলার চেষ্টা করেছে যেন আমি সমঝোতা করে মামলা তুলে নেই। আমি তাদের বলেছি, প্রতিবন্ধী মাইয়াকে বেচে আমি সেই টাকা খাবো না। আমি আমার মেয়ের জন্য ন্যায়বিচারের জন্য আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছি। বিচার বিচারের নিয়মে হবে।

ঢাবি ছাত্রীকে ধর্ষণের শিকার হওয়ার পরে আপনি সংহতি জানাতে পোস্টার নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। কী মনে হওয়ায় আপনি প্রকাশ্যে এলেন? এ প্রশ্নের জবাবে জলিল মিয়া বলেন, ‘আমিতো বাবা। ২০বছরের মেয়ে আমারও ছিল। কী দুর্বিষহ কষ্ট নিয়ে আমরা দিন কাটিয়েছি আমরাই জানি। এবার যখন ঢাবিতে আন্দোলন হচ্ছে, আমারই আরেক মেয়ে একইরকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সময় কাটাচ্ছে তখন আমার মনে হলো মুখ খোলা দরকার। ধর্ষণের ঘটনা যত ঘটবে তত পরিবার অভিভাবককে সামনে আসতে হবে। মেয়ের এতে কোনও দোষ নেই, মেয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই এটা আমার সমাজকে বুঝাতে হবে। আমার মেয়েটা আর আগের মতো নেই, ভয় পায়। আমি বারবার বলতে চাই এতে কোনও লজ্জা নেই, আমি আমার মেয়ের বিচার চাওয়ার জন্য যা করতে হবে করবো। আমি সব ধর্ষণের ঘটনার বিচার চাই।’

ছবি: নাসিরুল ইসলাম 

/ইউআই/টিএন/
সম্পর্কিত
পরিকল্পনাবিহীন ডিগ্রি অর্জনের কারণে বেকার থাকতে হচ্ছে: সালমান এফ রহমান 
কামরাঙ্গীরচর থেকে কাউকে উচ্ছেদ করা হবে না: মেয়র তাপস
নির্মাণাধীন ভবনে এডিসের লার্ভা, লক্ষাধিক টাকা জরিমানা
সর্বশেষ খবর
লবণাক্ততায় আক্রান্ত উপকূলীয় ১৮ জেলার ৯৩টি উপজেলা
লবণাক্ততায় আক্রান্ত উপকূলীয় ১৮ জেলার ৯৩টি উপজেলা
চট্টগ্রামে দন্ত চিকিৎসক হত্যা: মামলা ডিবিতে হস্তান্তর
চট্টগ্রামে দন্ত চিকিৎসক হত্যা: মামলা ডিবিতে হস্তান্তর
ব্রাজিলে বৃষ্টিপাতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৭৮, এখনও নিখোঁজ অনেকে
ব্রাজিলে বৃষ্টিপাতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৭৮, এখনও নিখোঁজ অনেকে
হারিয়ে গেছে প্রাণ, নদীর বুকে বুনছে ধান
হারিয়ে গেছে প্রাণ, নদীর বুকে বুনছে ধান
সর্বাধিক পঠিত
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
কোন পথে এগোচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ?
কোন পথে এগোচ্ছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ?