X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১
আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস

বনভূমি উজাড় বন্ধ করা যাচ্ছে না

সঞ্চিতা সীতু
০৫ জুন ২০২২, ০১:১৪আপডেট : ০৫ জুন ২০২২, ০৯:০৯

নানা আলোচনা, উদ্যোগ, পরিকল্পনার পরও বনভূমি উজাড় কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। বনের উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে একের পর এক উন্নয়ন কাজ করা হচ্ছে। অনেক বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কার মধ্যেই এগুলো করা হচ্ছে। 

সম্প্রতি লাঠিটিলার মতো উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যপূর্ণ সংরক্ষিত বনে সাফারি পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে সরকার। পরিবেশ মন্ত্রণালয় বলছে, বন রক্ষার জন্যই এই পার্ক করা হচ্ছে। আর এই পরিকল্পনার বিপক্ষে পরিবেশকর্মীরা। তারা বলছে, লাঠিটিলা একটি সংরক্ষিত বনভূমি। এখানে সাফারি পার্ক নয়, কোনও ধরনের স্থাপনা নির্মাণেরই সুযোগ নেই। এ ধরনের অভিযোগ শুধু লাঠিটিলায় নয়; দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বনভূমি এবং কৃষি জমি ধ্বংসের অনেক উদাহরণ রয়েছে। পরিবেশ-প্রতিবেশ নষ্ট করে নানা স্থাপনা তৈরি অভিযোগ অনেক দিনের।

এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে দেশে পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস।আজ ৫ জুন (রবিবার) সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পালিত হবে এ দিবস।

এ দিন সকালে সরকারি অনুষ্ঠানগুলোর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া বাপাসহ পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো নানা আয়োজনে পালন করতে যাচ্ছে পরিবেশ দিবস।

লাঠিটিলায় সাফারি পার্ক

পরিবেশবাদীরা বলছেন, পার্ক করা হলে বনের উদ্ভিদ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হবে। অনেক বিরল ও বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী হারিয়ে যাবে। সাফারি পার্ককে কেন্দ্র করে আশপাশে অনেক ধরনের স্থাপনা গড়ে উঠবে। মানুষের আনাগোনো বাড়বে। বন্য প্রাণীর প্রজননসহ বাসস্থান মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বন বিভাগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দেশের অন্যতম ক্রান্তীয় চিরসবুজ ও জীববৈচিত্র্যপূর্ণ বনভূমি হচ্ছে লাঠিটিলা। মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার গোয়ালবাড়ী ইউনিয়নে অবস্থিত এই বনভূমির আয়তন ৫ হাজার ৬৩১ একর। এই বনে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীগুলোর মধ্যে হাতি, উল্লুক, মায়া হরিণ, উল্টোলেজি বানর, আসামি বানর, মুখপোড়া হনুমানসহ বিভিন্ন ধরনের দুর্লভ পাখির বাস। বন বিভাগ লাঠিটিলায় ৯৮০ কোটি টাকার সম্ভাব্য ব্যয় ধরে সাফারি পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। সাফারি পার্কে বছরে ৮ থেকে ১০ লাখ দর্শনার্থী আসবেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।

বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, শুধু লাঠিটিলায় নয়; রাতারগুল, লাউয়াছড়া, ডুলাহাজরা, সাতছড়িতে সরকারি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। সংরক্ষিত বন সংরক্ষণের জন্য কোনও স্থাপনার প্রয়োজন হয় না। সেটাকে প্রাকৃতিকভাবেই থাকতে দেওয়া দরকার। কিছু করার দরকার পড়ে না। মানুষের আগাগোনা বাড়লে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিই হয়। আমরা শুনেছি, দেশের ১ লাখ ৬৫ হাজার একর বনের জমি সরকারের নানা উন্নয়ন কাজের জন্য দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বন রক্ষায় সবার আগে দরকার সরকারের আন্তরিকতা; যা আমরা একেবারেই দেখতে পাই না।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, লাঠিটিলায় সাফারি পার্ক করা হচ্ছে বনকে সংরক্ষণের জন্যই। এই বনে এখন মানুষের এমনিই আনাগোনা বেড়েছে। আমরা পার্ক করলে মানুষের অবাধ যাতায়াত কমে আসবে। প্রাণীদের আমরা সুরক্ষা দিতে পারবো।

লাউয়াছড়া

গত রোজার ঈদে প্রচুর পর্যটক ঘুরতে যান সেখানে লাউয়াছড়ায়। সংরক্ষিত বনে পর্যটকদের এই ভিড় সেখানকার বন্যপ্রাণী তথা জীববৈচিত্র্যের জন্য বিরাট হুমকি বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা। পাশাপাশি তাদের ফেলে আসা বিভিন্ন কোমল পানীয়’র ক্যান ও প্লাস্টিকের বোতল পলিব্যাগসহ বিভিন্ন বর্জ্য বনের পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। তাই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে প্রবেশ সীমিত করার দাবি তাদের।

এদিকে বণ্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ৪৬০ প্রজাতির জীববৈচিত্র্য রয়েছে। ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ৪ প্রজাতির উভচর প্রাণীর বিচরণ এই বনে। এছাড়া এই ক’বছরে বন বিভাগ ১৬৭ প্রজাতির বন্যপ্রাণী এই বনে অবমুক্ত করেছে বলে তারা জানান। ফলে বনের ক্ষতি হচ্ছে না, বরং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় তারা কাজ করছেন।

এ ধরনের অভিযোগ শুধু লাঠিটিলায় বা লাউয়াছড়ায় নয়, বনভূমি আছে এমন সব এলাকায় বন উজাড়ের ঘটনা ঘটছে বলেই এলাকাবাসীর অভিযোগ।

পার্বত্য এলাকা

বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে দেশের পার্বত্য তিন জেলায় বনভূমি নষ্ট করার অভিযোগ রয়েছে। গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ (জিএফও) এর হিসাব অনুযায়ী, ২০০২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দেশে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ প্রাকৃতিক বন উজাড় হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে হার ৯ শতাংশের বেশি। দেশের মোট বনভূমির মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতেই রয়েছে ৪০ শতাংশ ।

পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, পার্বত্য এলাকায় গাছ কেটে, পাহাড় কেটে নানা পর্যটন স্পট বানানো হচ্ছে, পর্যটকদের থাকার জন্য বানানো হচ্ছে আধুনিক হোটেল, রিসোর্ট। আর পরিবেশ মন্ত্রণালয় অভিযানের কথা বললেও তা এত অপ্রতুল যে চোখেই পড়ে না কারও। বরং সরকারি উদ্যোগে বন ধ্বংস এখন সবারই জানা।

এর বিরোধিতা করেন প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসেইন। তিনি বলেন, আমরা বন ধ্বংস করছি না। আমরা খোলা জায়গায় আরও গাছ রোপণ করে বনভূমি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি। সাঙ্গুসহ যে কয়টি রিজার্ভার আছে পার্বত্য এলাকায় সেখানে কাজ করা হচ্ছে। তবে এটা ঠিক পাহাড়ি এলাকা দুর্গম হওয়ার কারণে আমরা সব জায়গায় যেতে পারি না। অনেক এলাকায় পাহাড় কেটে গাছ কাটার অভিযোগ আমরা পাই। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকায় আমাদের যাওয়াটা খুবই দুরুহ। এসব প্রতিকূলতার মধ্যে আমরা বন বাঁচাতে কাজ করে যাচ্ছি।

পরিবেশ মন্ত্রণালয় কী বলছে

পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে বনভূমি থাকা আবশ্যক। বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে বনভূমি সৃজন কষ্টসাধ্য।

বর্তমানে দেশে বৃক্ষাচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ মোট ভূমির ২২.৩৭ শতাংশ এবং বনাচ্ছাদন ১৪.০১ শতাংশ। আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ দেশের বৃক্ষাচ্ছাদন ২৫ শতাংশে এবং বনাচ্ছাদনের পরিমাণ মোট ভূমির ১৬ শতাংশে উন্নীত করতে কাজ করছে সরকার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জন্মশতবার্ষিকীকে সারাদেশে ১ কোটি চারা বিতরণ ও রোপণ করা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ম্যানগ্রোভসহ ১ লাখ ৬০ হাজার ৩৭৮ হেক্টর ব্লক, ২৬ হাজার ৪৫৩ সিডলিং কি.মি. স্ট্রিপ বাগান রোপণ এবং বিক্রয় বিতরণের ১০ কোটি ৫৯ লাখ চারা বিতরণ ও রোপণ করা হয়।

এদিকে টেকসই বন ও জীবিকা (সুফল) প্রকল্পের আওতায়, ৭৭ হাজার ৬০০ হেক্টর অবক্ষয়িত বনে বনায়ন করে বন পুনরুদ্ধার করার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এছাড়া, বিগত ২০১৯ হতে ২০২১ পর্যন্ত বন অধিদফতর ৪ হাজার ৭২৯ হেক্টর বনভূমি জবরদখল মুক্ত করে বনায়ন করে পুনরুদ্ধার করেছে।

পরিবেশমন্ত্রী জানান, বর্তমানে অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুযায়ী, এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বন অধিদফতর প্রায় ৭ হাজার ২২০ হেক্টর সমতল ভূমি ও শাল বন পুনরুদ্ধার, ১ লাখ ৩০ হাজার ৫৮০ হেক্টর পাহাড়ি বন পুনরুদ্ধার, ৫০০ হেক্টর আগর বন, ১৫ হাজার কিলোমিটার. খাঁপ বাগান, ৫০ হাজার হেক্টর ম্যানগ্রোভ বনসহ অন্যান্য বাগান করা হবে। বনাচ্ছাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০২১-২০ ম্যানগ্রোভসহ ২৯ হাজার ১২৪ হেক্টর ব্লক বাগান এবং গোলাপাতাসহ ১ হাজার ৫৭৪ কিলোমিটার স্ট্রিপ বাগান করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

অনুষ্ঠানসূচি

দিবসটি উপলক্ষে পরিবেশ মেলা এবং জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলার আয়োজন করেছে বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গণভবন হতে ভার্চুয়ালি যুক্ত হবেন এবং একই সঙ্গে ৫ জুন হতে ১১ জুন পর্যন্ত পরিবেশ মেলা ও ৫ জুন হতে ৪ জুলাই পর্যন্ত জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলা ২০২২ এর উদ্বোধন ঘোষণা করবেন। এছাড়াও অনুষ্ঠানে জাতীয় পরিবেশ পদক, বঙ্গবন্ধু অ্যাওয়ার্ড ফর ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন এবং বৃক্ষরোপণে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় পুরস্কার দেবেন।

এদিকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস-২০২২ উপলক্ষে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), রিভার ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি), জেসিআই ও ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ এর যৌথ উদ্যোগে সকালে দূষণমুক্ত নদীর দাবিতে মোহাম্মদপুর বসিলা ব্রিজের নিচে বুড়িগঙ্গা নদীতে এক ‘গণ গোসল’ কর্মসূচির আয়োজন করেছে। এই কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার।

বাপা জানায়, এছাড়াও দিবসটিকে উদযাপন উপলক্ষে দেশব্যাপী বাপা আঞ্চলিক শাখা ও  অঞ্চলগুলোতে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হবে।

/আইএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আরও কমলো সোনার দাম  
আরও কমলো সোনার দাম  
 ১ পদে ২৩৮ জনকে চাকরি দেবে ভূমি মন্ত্রণালয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
 ১ পদে ২৩৮ জনকে চাকরি দেবে ভূমি মন্ত্রণালয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস
চুয়াডাঙ্গার তাপমাত্রা ৪২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস
৬ মামলায় জামিন পেলেন বিএনপি নেতা গয়েশ্বর
৬ মামলায় জামিন পেলেন বিএনপি নেতা গয়েশ্বর
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
সিনিয়র শিক্ষককে ‘দেখে নেওয়ার’ হুমকি জুনিয়র শিক্ষকের
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
ভুল সময়ে ‘ঠিক কাজটি’ করবেন না
স্কুল ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি